বাবা-মায়ের একটি প্রিয় সন্তান থাকা কি খারাপ?
ঠিক যেই মুহূর্তে জোয়ানার দ্বিতীয় সন্তান জন্মাল, তখন থেকেই তিনি জানেন দুই সন্তানের মধ্যে একটিকে তিনি বেশি ভালোবাসেন। যুক্তরাজ্যের কেন্টভিত্তিক এই মায়ের মতে, তিনি তার দুই সন্তানকেই ভালোবাসেন, কিন্তু ছোটটা তাকে যেভাবে বোঝে বলে তার মনে হয়। বড় সন্তানের ব্যাপারে কখনোই তার মনে সে ধরনের অনুভূতি জাগেনি।
যখন জোয়ানার প্রথম সন্তানের ডেলিভারি হলো, তাকে কিছু শারীরিক জটিলতার কারণে জোয়ানার কাছ থেকে তৎক্ষণাৎ অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। ফলে পুরো ২৪ ঘণ্টা তিনি তার সন্তানের মুখ দেখতে পারেননি। জোয়ানার বিশ্বাস, শুরুর এই বিচ্ছেদটাই প্রথম সন্তানের প্রতি তার আবেগে কিছুটা ঘাটতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু দ্বিতীয় সন্তানের সঙ্গে তিনি শুরু থেকেই সময় কাটাতে পারায়, তার প্রতি জোয়ানার মনে বেশি প্রাধান্যের জায়গা সৃষ্টি হয়।
"আমাদের সম্পর্কের সারসংক্ষেপ এভাবে দাঁড় করানো যায়: বড় ছেলের সঙ্গে কথা বলতে আমাকে আগে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে রাখতে হয়। কিন্তু ছোটটার সঙ্গে আমার সম্পর্ক এতটাই গভীর যে, আমি যদি তাকে রাত আড়াইটার সময়ও কল দিই, সে আমার সঙ্গে দেখা করতে শত শত মাইল ড্রাইভ করে চলে আসবে। আমার ছোট ছেলেটা পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো মানুষ। সে যত্নশীল, দয়ালু, বন্ধুত্বপূর্ণ। সে এমন একজন মানুষ যে সবাইকেই সাহায্য করতে সবসময় প্রস্তুত," বলেন তিনি।
যদিও নিজের এ ধরনের অনুভূতি নিয়ে জোয়ানাকে বছরের পর বছর ধরে আত্মদ্বন্দ্বে ভুগতে হয়েছে, কিন্তু এখন তিনি বাস্তবতাকে মেনে নিয়েছেন। "আমি এখন এমনকি একটি বইও লিখতে পাড়ি যে কেন আমি এক সন্তানকে অন্যটির চেয়ে বেশি ভালোবাসি। ব্যাপারটি অনেক কঠিন ছিল সত্যি, কিন্তু আমি অনুতপ্ত নই।"
তবে সবাই তো আর জোয়ানা নয়। তাই অধিকাংশ বাবা-মায়ের যেকোনো এক সন্তানের প্রতি অধিক অনুরক্তির বিষয়টি থাকে সূক্ষ্ম, এবং এ নিয়ে কখনো আলাপ-আলোচনাও হয় না। বলা যেতে পারে, একটি বেশি প্রিয় সন্তান থাকাটাই বোধহয় পিতৃত্ব-মাতৃত্বের সবচেয়ে বড় ট্যাবু। কিন্তু তবু গবেষকরা প্রমাণ পেয়েছেন যে, অধিকাংশ বাবা-মায়েরই একটি প্রিয় সন্তান থাকে।
এমন অনেক তথ্য-প্রমাণও মিলেছে যে বাবা-মায়ের কম পছন্দের সন্তান হওয়া অনেকের ব্যক্তিত্বের উপর বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলে, এবং ভাইবোনদের মধ্যে তীব্র বিদ্বেষ ও বিতণ্ডারও জন্ম দেয়। তাই স্বাভাবিকভাবেই, বাবা-মায়েরা তাদের মনের মধ্যে লালিত সত্যটাকে প্রকাশ্যে আসতে দিতে চান না।
গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, বেশিরভাগ সন্তানরাও ঠিকঠাক বুঝে উঠতে পারেন না যে তাদের বাবা-মায়ের প্রিয় সন্তান আসলে কে। তবে মূল ইস্যুটি হলো, বাবা-মায়েরা কীভাবে তাদের সন্তানের মনে ফেভারিটিজমের মনোভাবটিকে সামলায়।
"এমন নয় যে প্রত্যেক বাবা-মায়েরই একটি প্রিয় সন্তান থাকে। কিন্তু অনেকেরই থাকে," বলেন যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ম্যাসাচুসেটস মেডিকেল স্কুলের মনস্তত্ত্ব ও শিশুরোগের সহযোগী অধ্যাপক জেসিকা গ্রিফিন।
"তথ্য-উপাত্ত থেকে ধারণা করা যায়, মায়েরা সাধারণত সেইসব সন্তানদের বেশি পছন্দ করে, যাদের সঙ্গে তাদের নিজেদের মূল্যবোধের সাদৃশ্য রয়েছে, যারা পরিবারের সঙ্গে বেশি মেলামেশা করে। কে বেশি গুণসম্পন্ন বা ক্যারিয়ারের প্রতি বেশি উচ্চাকাঙ্ক্ষী, তা নিয়ে মায়েরা মাথা ঘামায় না," বলেন তিনি।
তবে কারণ যা-ই হোক, কিছু কিছু গবেষণা থেকে দেখা যায়, অনেক বাবা-মায়ের প্রায় নিশ্চিতভাবেই একটি প্রিয় সন্তান থাকে – তারা সেটি স্বীকার করুক বা না করুক। যুক্তরাষ্ট্রের এক গবেষণায় ৭৪ শতাংশ পর্যন্ত মায়েরা এবং ৭০ শতাংশ বাবারা তাদের একটি সন্তান তাদের কাছে বেশি প্রাধান্য পেয়ে থাকে। কিন্তু নিজমুখে সেটি স্বীকার করেছেন কেবল ১০ শতাংশ বাবা-মা।
যেসব ক্ষেত্রে বাবা-মায়েরা তাদের একটি সন্তানের প্রতি বেশি প্রাধান্য স্বীকার করে, সেখানে সন্তানের জন্মের ক্রম একটি বড় ভূমিকা পালন করে। একটি জরিপে দেখা গেছে, দুইটি সন্তান আছে এমন ৬২ শতাংশ বাবা-মাই তাদের কনিষ্ঠ সন্তানকে বেশি পছন্দ করে। অন্যদিকে তিন বা ততোধিক সন্তান আছে এমন ৪৩ শতাংশ বাবা-মাই তাদের শেষ সন্তানকে বেশি পছন্দ করে, এক-তৃতীয়াংশ মাঝের সন্তানকে বেশি পছন্দ করে, আর মাত্র ১৯ শতাংশ প্রথম সন্তানকে বেশি পছন্দ করে।
এ ব্যাপারে নিউ ইয়র্ক সিটির মাউন্ট সিনাই হসপিটালের ড. বিজায়েতি সিংহ বলেন, "বাবা-মায়েরা সাধারণত সেই সন্তানকে বেশি পছন্দ করে, যারা অনেকটা তাদের মতো, কিংবা যাদের মধ্যে তারা তাদের নিজেদের অভিভাবকত্বের সাফল্যের ছায়া খুঁজে পায়। আর এক্ষেত্রে ছোট সন্তানকেই বেশি পছন্দ হওয়ার কথা, কেননা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাবা-মায়েরা অনেক অভিজ্ঞ হয়ে ওঠে, এবং ছোট সন্তানকে মানুষ করার সময় তারা বেশি আত্মবিশ্বাসী ও দক্ষ হয়ে থাকে।"
সিংহ আরও জানান, অধিকাংশ বাবা-মাই তাদের যেকোনো একটি সন্তানকে বেশি পছন্দ করা নিয়ে মনে মনে অপরাধবোধে ভোগে। পাশাপাশি যেসব সন্তান বুঝতে পারে যে তাদের বাবা-মা তাদের চেয়ে তাদের অন্য কোনো ভাই বা বোনকে বেশি ভালোবাসে, তারা এতে মানসিকভাবে আঘাত পায়, এবং তাদের মধ্যে বিভিন্ন নেতিবাচক অনুভূতির উদ্রেক ঘটে; আত্মবিশ্বাসের অভাবে ভোগে তারা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই নেতিবাচক ব্যাপারগুলো তাদের ব্যক্তিত্বকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
কিন্তু বাবা-মা যা-ই ভাবুক, আর সন্তানের উপর যেমন প্রভাবই পড়ুক, গ্রিফিন মনে করেন বাবা-মায়ের একটি বেশি প্রিয় সন্তান থাকা খুবই স্বাভাবিক ও প্রত্যাশিত ব্যাপার। এ ব্যাপারে তাদের অপরাধবোধে ভোগার কোনো কারণ নেই। তার মতে, বেশিরভাগ সন্তান কখনো আঁচও করতে পারে না যে তাদের বাবা-মায়ের একটি বেশি প্রিয় সন্তান রয়েছে।
এছাড়া গ্রিফিন আরো বিশ্বাস করেন, একটি প্রিয় সন্তান থাকা মানে কখনোই অন্য সন্তানদের কম ভালোবাসা নয়। যদি কোনো বাবা-মা বা সন্তান এই বেশি প্রিয় হওয়ার ব্যাপারটি নিয়ে মানসিকভাবে অবসাদগ্রস্ত অনুভব করে বা মনে করে যে এটি তাদের সম্পর্ককে প্রভাবিত করছে, তাহলে তাদেরকে পেশাদার থেরাপিস্ট বা মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হতে বলেন তিনি। পাশাপাশি এটিও জানান যে কিছু ছোটখাট কৌশল অবলম্বনের মাধ্যমেই অধিকাংশ ক্ষেত্রে এসব অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যাপার এড়ানো সম্ভব।
গ্রিফিন বলেন, যদিও বাবা-মায়েরা সহজে তাদের ফেভারিটিজমের কথা স্বীকার করবে না, তবে যদি তারা তা করে, তাহলে নিশ্চিতভাবেই এক্ষেত্রে তারা নিজেদেরকে বিচ্ছিন্ন বলে ভাববে না। কারণ চারপাশে তাদের মতো অনেক বাবা-মাই রয়েছে।
"এমন অনেক দিনই আসবে যখন আমরা একটি সন্তানের চেয়ে অন্যটিকে বেশি প্রাধান্য দেব," তিনি বলেন। "এর পেছনে আলাদা আলাদা বেশ কিছু কারণ থাকতে পারে। কিন্তু যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি আমাদের মনে রাখতে হবে তা হলো, একটি সন্তানকে বেশি ভালোবাসার অর্থ এই নয় যে আপনি আপনার অন্য সন্তানদের কম ভালোবাসেন।"
- সূত্র: বিবিসি