ডমেস্টিক বন্ডেড ওয়্যারহাউজ দেশের বেকারত্ব সমস্যার সমাধান করতে পারে
করোনা পরিস্থিতি আমাদের যেমন অনেক কিছু শিখিয়ে দিয়ে গেছে, তেমনি আমাদের মস্তিষ্কে নতুন কিছু পরিকল্পনাকে পুনরুজ্জীবিত করেছে। কথায় আছে, জীবন যখন সহজভাবে চলে তখন জীবন সম্পর্কে ভাববার প্রয়োজন হয় না। আমার চাকরি/ব্যবসা সব সহজ ভাবে চলে আসছিল তাই নতুন করে কিছু ভাববার প্রয়োজন পড়েনি। কিন্তু করোনায় যখন চাকরিচ্যুত হতে থাকল মানুষ, তখন প্রয়োজন হলো নতুন পরিকল্পনা ও পথ অনুসরণের। আজকের লেখাটিতে উদ্যোক্তা বানানোর একটা উপায় নিয়ে কথা বলতে যাচ্ছি।
সময় এসেছে তৈরি পোশাক রপ্তানি করার পাশাপাশি লোকাল মার্কেটের ওপরেও গুরুত্ব দেওয়ার। আমাদের লোকাল মার্কেট প্রায় ৮ বিলিয়ন ডলারের মার্কেট। এখানে এখনও পাকিস্তান, ভারত, থাইল্যান্ড ও চীনের পোশাকের আধিপত্য রয়েছে। আমাদের দেশ বিশ্বের অন্যতম সুইং হাব। এবং আমাদের তৈরি পোশাক বিশ্বের সকল ব্র্যান্ডের আউটলেটে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। আমাদের এই দক্ষতা, এই সুযোগটা রপ্তানির পাশাপাশি লোকাল মার্কেটেও লাগাতে পারি এবং নতুন নতুন উদ্যোক্তা বানিয়ে বেকার সমস্যার সমাধান করতে পারি। এই উদ্যোক্তরা ডমেস্টিক মার্কেটে নিজেদের জায়গা দখল করতে পারলে সহজেই আন্তর্জাতিক মার্কেটেও তাদের জায়গা করে নিতে পারবে।
লোকাল মার্কেট নিয়ে কিছু পরিসংখ্যান দেই; দেশের পোশাক কেনাবেচার স্হানীয় মার্কেট প্রায় ৬-৮ বিলিয়ন ডলারের। এর মধ্যে অধিকাংশই আমদানিনির্ভর মেয়েদের ও বাচ্চাদের পোশাক।
এই স্থানীয় চাহিদা মেটাতে দেশের ২৫০ টি স্পিনিং কারখানা, ৫০০ টির মতো ফেব্রিক কারখানা ও ২০০ টির মতো ডাইয়িং ফিনিশিং মিল উৎপাদন করে যাচ্ছে। এদের উৎপাদন আমাদের দেশকেন্দ্রিক। এসব কারখানা দেশের পোশাকের চাহিদা মেটায়।
প্রতিবছর আমাদের বিভিন্ন উৎসব যেমন- ইদ ও পহেলা বৈশাখের কথা যদি বলি, এবং পহেলা বৈশাখের পোশাকের বাজারও চোখে পড়ার মতো, প্রায় ১,০০০ থেকে ১,২০০ কোটি টাকা।
যেখানে ইদের সময় প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকার ব্যবসা চলে, সেখানে দেশীয় পোশাক থেকে আসে মাত্র ৪ হাজার কোটি টাকা। বাকি পুরোটাতেই চলে ভারতীয় ও পাকিস্তানি পোশাকের আধিপত্য। কিন্তু গত কয়েক দশকে বাংলাদেশে গড়ে উঠেছে অনেক ফ্যাশন হাউস। ঢাকা ও ঢাকার বাইরে ফ্যাশন হাউসের সংখ্যা প্রায় ৫০ হাজারের বেশি।
লোকাল মার্কেটকে উন্নতির জন্য ও প্রয়োজনীয় কাঁচামাল আনার সুবিধার্থে ট্রেডিং বন্ড সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে বাইরের দেশ থেকে 'ডিউটি পে এপারেল' আনার পরিবর্তে ফেব্রিক ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী আনতে হবে। এবং বিদেশ থেকে এপারেল (পোশাক) আনা বন্ধ করে দিতে হবে। ডিউটি ফ্রি বা শুল্কমুক্ত ফেব্রিক এনে ছোট থেকে বড় ফ্যাক্টরিগুলোতে দিয়ে কাপড় বানিয়ে লোকাল মার্কেটে বিক্রি করতে হবে। এবং পাশাপাশি কর আদায় করার জন্য সরকার সিগারেটের প্যাকেটে যে ট্যাক্স ট্যাগ সরবরাহ করে সেটা পোশাকের গায়েও লাগিয়ে দিতে হবে। তাহলে করও আদায় হবে, সেইসঙ্গে উদ্যোক্তারাও উপকৃত হবেন।
শুধু যে লোকাল ফ্যাক্টরিগুলোই এ সুবিধা পাবে এমনটি নয়। যদি গার্মেন্টস পণ্য উৎপাদনকারী ফ্যাক্টরিগুলো এই সুবিধা পেতে চায়, তাহলে তাদের তৈরি পোশাক লোকাল মার্কেটে বিক্রির ক্ষেত্রে তাদেরকেও কর দিতে হবে ৷ কিন্তু যদি রপ্তানি করে তাহলে কর দিতে হবে না।
কেবল উদ্যোক্তা ও কারখানা, যারা ম্যানুফেকচার করে তারাই এই সুযোগ ভোগ করবে। কিন্তু যারা ফেব্রিকের ব্যবসা করে তাদের ক্ষেত্রে এটি প্রযোজ্য হবে না।
কয়েক বিলিয়ন ডলারের লোকাল মার্কেট পুরোটা ধরার মতো ক্ষমতা আমাদের আছে। আমরা উপরোক্ত পলিসি অনুসরণ করে এগোলে ২০৩০ সাল নাগাদ আমাদের নতুন অনেক উদ্যোক্তা তৈরি হবে এবং দেশের সুইং হাবের আরও উন্নতি হবে। দেশে অনেক নারী উদ্যোক্তা ভালো করার চেষ্টা করছেন। কর্তৃপক্ষকে তাদের সুযোগ সুবিধার ব্যবস্থা করে দিতে হবে।
গ্রামে গ্রামে সুইং হাব গড়ে তুলতে হবে। সেখান থেকে কম খরচে পণ্য তৈরি করে লোকাল মার্কেটের চাহিদা পূরণ করতে হবে। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সংস্থা এফবিসিসিআই, ডিসিসআই তারা এ ব্যাপারে নজর দিলে শুধু তৈরি পোশাক না দেশিয় বাজারে আমরা পণ্য বৈচিত্রতাসহ রপ্তানি বৃদ্ধি করতে পারবো।
প্রথম অবস্থাতে প্রতি উদ্যোক্তাদের ৫ থেকে ১০ লক্ষ টাকার মধ্যে শুল্কমুক্ত আমদানির সুযোগ করে দিতে হবে এবং পরবর্তী সময়ে পোশাকের ওপর কর দিতে হবে।
আমার বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতার আলোকে এটি লিখলাম। দীর্ঘ ২ যুগের বেশি সময় ধরে পোশাক ব্যবসার সঙ্গে আমি জড়িত। দেশের ৪ কোটি ৮২ লাখ প্রকৃত বেকার সমস্যার সমাধানে এটি প্রভাব ফেলতে পারে এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতির বিশাল উন্নতি হতে পারে। আমার অনুরোধ রইলো, একটি বছর পরীক্ষামূলকভাবে ডমেস্টিক বন্ডেড ওয়্যারহাউজ নিয়ে কাজ করা উচিত।
ডমিস্টিক ইন্ডাস্ট্রিগুলো রক্ষা করার জন্য প্রত্যেকেরই কাজ করা উচিত। কেবল আমরা এই বিষয়টিতে নজর দিচ্ছি না। কারণ বিশ্ব মহামারির এই পরিস্থিতিতে ব্যবসায়িক ক্ষতির পাশাপাশি অধিক শুল্ক আমাদের মাথাব্যাথার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। আমি ভারত ও তুরস্কের বাজারে ১৯৯৭ সাল থেকে কাজ করছি, আর ইন্দোনেশিয়া বাজারে ২০১৮ থেকে। তারা তৈরি পোশাক আমদানি শুল্ক অনেক বাড়িয়ে রেখেছে আর ভারতে সাফটা আছে, কিন্তু তাদের জিএসটি ৫ শতাংশ থেকে তারা ১২ শতাংশ করার চিন্তা করছে।
আমাদের উদ্যোক্তারা কীভাবে আমাদের অভ্যন্তরীণ বাজারে জায়গা করে নিতে পারবে সে বিষয়ে এখন ভাবা দরকার। আমাদের নিজেদের আভ্যন্তরীণ বাজার কে আর ছোট করে দেখার সুযোগ নেই।
অভ্যন্তরীণ বাজারে ফোকাস করতে ডিউটি ফ্রি পণ্য ও কাঁচামাল আমদানী আমাদের জন্য ইতিবাচক হতে পারে। বিশেষ করে, মেয়েদের পোশকের ক্ষেত্রে পরীক্ষা মূলকভাবে স্বল্প পরিসরে নারী উদ্যোক্তাদের এ সুযোগ দেওয়া যেতে পারে। বর্তমানে ভারত পাকিস্তান এই বাজার দখল করে রেখেছে; এক্ষেত্রে যারা স্বল্প পরিসরে ৫ থেকে ১০ লাখ টাকা পুঁজি নিয়ে ব্যবসা করেন তাদেরকে শুল্কমুক্ত উপায়ে বিদেশ থেকে ফেব্রিক আমদানি করে পোশাক তৈরি করে, পরবর্তীতে সিগারেটের মতো শুল্ক ব্যাচ লাগিয়ে লোকাল মার্কেটে পোশাক বিক্রির নিয়ম চালু করতে পারলে হয়তো একটি দীর্ঘমেয়াদী সমাধান আসতে পারে। এতে আমাদের ছোট ছোট পরিসরে রপ্তানির সম্ভাবনা তৈরি হবে।
- লেখক: চেয়ারম্যান, এএসকে অ্যাপারেল অ্যান্ড টেক্সটাইল সোর্সিং ও হেড অফ অপারেশন, বুনন।