ভুয়া অ্যাকাউন্ট ও বট দিয়ে যেভাবে শীতকালীন অলিম্পিকের প্রোপাগান্ডা চালিয়েছে চীন
বিশ্ববাসী এবারের শীতকালীন অলিম্পিককে দেখেছে চীনের প্রোপাগান্ডা চশমা দিয়েই। খেলাধুলা এবং রাজনৈতিক সম্প্রীতি উদযাপন করা একটি অবিচ্ছিন্ন সাফল্য হিসেবে দেখা হচ্ছে বেইজিং অলিম্পিককে। সমালোচকরা বলছেন, দেশের অন্তঃকোন্দল ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রক্রিয়াকে ঢাকতে একটি প্রোপাগান্ডা ক্যাম্পেইন হিসেবে কাজ করেছে এই অলিম্পিক।
এবার কৃত্রিম বরফ দিয়ে অলিম্পিকের পাহাড়গুলোকে তুষারময় করা হয়েছে। একজন উইঘুর স্কিয়ারকে দেখানো হয়েছে জাতীয় ঐক্যের প্রতীক হিসেবে, যৌন নিপীড়নের অভিযোগ আনা টেনিস খেলোয়াড় পেং শুয়াইকে দেখানো হয়েছে একজন কৌতূহলী দর্শক হিসেবে। বিদেশী সাংবাদিক ও ক্রীড়াবিদরা স্বেচ্ছাসেবকদের ভদ্রতার প্রশংসা করেছেন। প্রশংসা করেছেন বেইজিংয়ের উচ্চ-গতির ট্রেন ও স্বয়ংক্রিয় রোবটগুলোর।
দেশের ভিতরের দর্শক ও পাঠকরা একটি ইভেন্টকে কীভাবে দেখবেন ও কী ভাববেন, তার নিয়ন্ত্রণ অনেক আগে থেকেই চীন সরকারের হাতে। এই অলিম্পিকের মধ্য দিয়ে জনমত নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা দেশের বাইরেও বিস্তার করেছে দেশটি। ডিজিটাল মাধ্যমে নিজেদের বানোয়াট আখ্যানকে আগের চেয়েও বেশি সূক্ষ্মতার সাথে আরও বেশি মানুষের মাঝে পৌঁছে দিতে সক্ষম হচ্ছে বেইজিং।
ইন্টারনেট বট, ভুয়া অ্যাকাউন্ট, ভাড়া করা ইনফ্লুয়েন্সার ও অন্যান্য সরঞ্জামাদির মাধ্যমে একটি আসর কীভাবে উপস্থাপিত হবে তা নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হচ্ছে চীন।
পর্যবেক্ষক সংস্থা চায়না মিডিয়া প্রজেক্টের পরিচালক ডেভিড বান্দুরস্কি বলেন, "চীনা কমিউনিস্ট পার্টির জন্য দেশের জাতীয় ভাবমূর্তি গড়ে তোলার বৃহত্তর রাজনৈতিক লক্ষ্যের মধ্যেই পড়ে এই শীতকালীন অলিম্পিক। শি জিনপিং নিজেই এই অলিম্পিক সম্বন্ধে বলেছেন, 'এটি চীনের গল্প ভালোভাবে তুলে ধরার মাধ্যম'।"
টুইটার চীনে নিষিদ্ধ হলেও এই প্লাটফর্মে চীনের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম থেকে শুরু করে সাংবাদিক, কূটনীতিকরা অলিম্পিকের একটি প্রফুল্ল চিত্র ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। তারা ভেন্যুগুলোর ব্যাপক প্রশংসা করেছেন, উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন অলিম্পিক মাসকট নিয়ে।
অনলাইনে সাধারণ মানুষের আলোচনাকে নিয়ন্ত্রণ করতেও অভিনব কায়দা অবলম্বন করেছে চীন। নিউ ইয়র্ক টাইমস তাদের এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে তিন হাজারেরও বেশি ভুয়া টুইটার অ্যাকাউন্টের একটি নেটওয়ার্ক খুঁজে পেয়েছে যাদের অনলাইন কার্যক্রম চীনের রাষ্ট্রীয় মিডিয়ার পোস্ট শেয়ার করা ও অলিম্পিকের গুণগান গেয়ে একইরকম কমেন্ট করার মধ্যে সীমাবদ্ধ।
সবকটি অ্যাকাউন্টই তৈরি হয়েছে অল্প কিছুদিন আগে। তাদের টুইটগুলো ঘেঁটে দেখা যায়, প্রায় সব টুইটই রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমের বক্তব্যকে সায় দিয়ে লেখা কিছু, অথবা এসব বক্তব্যের রিটুইট।
এসব অ্যাকাউন্টের নেতৃত্ব দিয়েছে 'স্পাইসি পান্ডা' নামের একটি অ্যাকাউন্ট। অলিম্পিক বয়কটের আহ্বানের বিরুদ্ধে অনেকগুলো কার্টুন ও ভিডিও পোস্ট করেছে স্পাইসি পান্ডা, যেগুলো শেয়ার করেছে বাকি অ্যাকাউন্টগুলো।
একটি কার্টুনে স্পাইসি পান্ডা "অলিম্পিককে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রোপাগান্ডা চালাচ্ছে" বলেও দাবি করেছে।
এই পোস্ট শেয়ার করা হয়েছে ২৮১ বার। প্রতিটি শেয়ারই এসেছে সেসব ভুয়া অ্যাকাউন্ট থেকে।
স্পাইসি পান্ডার মোট ফলোয়ার সংখ্যা ৮৬১। ফলোয়ারদের মধ্যে ৯০ শতাংশের অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে ১ ডিসেম্বরের পর।
প্রথমে হংকংয়ের বিতর্কিত আইন পরিষদ নির্বাচন কতটা বৈধ ছিল, তা নিয়ে সম্মিলিতভাবে পোস্ট দেওয়া শুরু করেছিল অ্যাকাউন্টগুলো। এরপর তারা অলিম্পিকের দিকে ঝুঁকে।
ধারণা করা হচ্ছে, চীনের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম আইচংকিংয়ের সঙ্গেও সংযোগ রয়েছে স্পাইসি পান্ডার। কারণ, স্পাইসি পান্ডার ফলোয়ারদের শুধু দুইটি অ্যাকাউন্টের পোস্টই শেয়ার করতে দেখা যায়। এক, স্পাইসি পান্ডা ও দুই, আইচংকিং।
এরকম বটরূপী অন্যান্য অ্যাকাউন্টকে হ্যাশট্যাগ ক্যাম্পেইন চালাতে দেখা যায়। চীনবিরোধী কোনো হ্যাশট্যাগ যেন টুইটারে ট্রেন্ডিং হয়ে উঠতে না পারে সেজন্য বিপুল মাত্রায় পাল্টা হ্যাশট্যাগ দিতে দেখা যায় তাদের। এরকম হ্যাশট্যাগ ক্যাম্পেইন আগেও চালিয়েছে চীন।
এই অলিম্পিকের মাসকট বিং ডুয়েন ডুয়েন (বরফের স্যুট পরা একটি পান্ডা)-এর প্রচারণা চালাতেও টুইটার বট ব্যবহার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে অস্ট্রেলিয়ান স্ট্র্যাটেজিক পলিসি ইন্সটিটিউটের ইন্টারন্যাশনাল সাইবার পলিসি সেন্টারের গবেষক অ্যালবার্ট ঝাং।
তিনি জানান, হাজার হাজার নতুন বা নিষ্ক্রিয় অ্যাকাউন্ট মাসকটটিকে ভাইরাল হতে সাহায্য করেছে। চীনের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম এই ভাইরাল হওয়াকেই মাসকট ও অলিম্পিকের জনপ্রিয়তার প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করেছে।
চীনের অভ্যন্তরেও অলিম্পিকের জন্য আসা ক্রীড়াবিদ, সাংবাদিক এবং অন্যান্য অংশগ্রহণকারীদের দেশের সাধারণ জনগণ থেকে আলাদা করে রাখা হয়েছে। তাদেরকে সরকার নিয়ন্ত্রিত বদ্ধ বলয়ের মধ্যে রাখার পাশাপাশি অলিম্পিকের সংবাদ সাধারণ চীনারা কীভাবে দেখবে বা পড়বে, সেটিও নিয়ন্ত্রণ করেছে রাষ্ট্র।
এবারের অলিম্পিকের পুরুষ হকিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে ০-৮ গোলের বিশাল ব্যবধানে হেরে বসেছিল চীন। চীনে প্রধান রাষ্ট্রীয় স্পোর্টস চ্যানেল সিসিটিভি ফাইভ এই ম্যাচ সম্প্রচারই করেনি। আরেকটি রাষ্ট্রীয় চ্যানেল পুরুষদের ফিগার স্কেটিং প্রতিযোগিতায় পদকজয়ীদের স্লাইড শো বানালেও মার্কিন স্বর্ণপদকজয়ী নাথান চেনকে রাখেনি তাতে।
এই অলিম্পিকের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক কেলেঙ্কারিটিও উন্মোচিত হয়েছে চীনের বদ্ধ বলয়ের বাইরে। পেশাদার টেনিস খেলোয়াড় এবং তিনবারের অলিম্পিয়ান পেং শুয়াই কমিউনিস্ট পার্টির একজন জ্যেষ্ঠ নেতার বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ এনেছিলেন।
বৈশ্বিক শোরগোলের মাঝে আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির সভাপতি, থমাস বাচ পেংয়ের সঙ্গে দেখাও করেছিলেন। পরবর্তীতে পেংকে কার্লিং এবং ফিগার স্কেটিংসহ বেশ কিছু ইভেন্টে উপস্থিত হতে দেখা যায়। কিন্তু চীনের অভ্যন্তরে কোনো চ্যানেলেই পেংকে দেখানো হয়নি। এই টেনিস তারকার আনা সমস্ত অভিযোগও মুছে দেওয়া হয়েছে।
ডেভিড বান্দুরস্কি এই অলিম্পিক সম্পর্কে বলেন, "আপনাকে প্রথমে বুঝতে হবে, এটা রাষ্ট্রের 'আরেকটি প্রচারণা' না। এই অলিম্পিকে আমরা ব্যাপক সেন্সরশিপ এবং জনমত নিয়ন্ত্রণের দৃষ্টান্ত দেখতে পাই, যা তাদের রাষ্ট্রীয় নীতি।"
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম পর্যবেক্ষণকারী কোম্পানি 'গ্রাফিকা'র সহ-সভাপতি জ্যাক স্টাবস জানান, তার ফার্ম টুইটার-ফেসবুকের মতো 'বিদেশী' সোশ্যাল মিডিয়াগুলোতে চীনের আরেকটি প্রোপাগান্ডা নেটওয়ার্ক খুঁজে পেয়েছে।
অলিম্পিক কতটা পরিবেশবান্ধব এবং চীন-রাশিয়ান সম্পর্ক কেন আরও জোরদার করা উচিত, তা নিয়ে প্রচারণা চালিয়েছে নেটওয়ার্কটি।
চীনে টুইটার, ফেসবুকের মতো সব বিদেশী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমই নিষিদ্ধ। কিন্তু এরপরও এসব প্লাটফর্মে কীভাবে চীনা প্রচারণা চলছে, তা নিয়ে মুখ খোলেনি সরকার। তবে গতবছর চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র বলেছিলেন, পশ্চিমের নেতিবাচক চিত্রায়নের বিরুদ্ধে লড়াই করার 'একটি অতিরিক্ত মাধ্যম' হিসেবে এসব সাইট ব্যবহার করা হয়।
ভিপ্পি মিডিয়া নামের একটি আমেরিকান কোম্পানি চীনের কনস্যুলেট জেনারেলের সঙ্গে তিন লাখ মার্কিন ডলারের একটি চুক্তি করেছিল অলিম্পিকের প্রচারণা চালানোর স্বার্থে। এই চুক্তি অনুযায়ী, ইন্সটাগ্রাম, ইউটিউব এবং টিকটকে বেইজিং অলিম্পিকের প্রচারণা চালাতে বেশ কিছু "সোশ্যাল মিডিয়া তারকাদের" নিয়োগ দিয়েছে ভিপ্পি মিডিয়া।
কোম্পানিটির প্রতিষ্ঠাতা ভিপিন্দর জাসওয়াল বলেন, "তারা খুব পরিষ্কারভাবেই বলেছে, এই চুক্তি শুধু ও শুধুমাত্র অলিম্পিককে কেন্দ্র করে। এর সাথে রাজনীতির কোনো সম্পর্ক নেই।"
কিন্তু, দুঃখজনক হলেও সত্য, এসব প্রচারণার কারণেই ঢেকে গেছে অলিম্পিকের অন্ধকার দিকগুলো। এছাড়া, অনেক কর্মী আশা দেখলেও চীনের মানবাধিকার রেকর্ডের বিরুদ্ধেও কোনো প্রতিবাদ দানা বাঁধতে পারেনি। বরং, অলিম্পিক ও চীনকে ঘিরে সব প্রশংসামূলক বাণীই সব জায়গায় প্রচারিত হয়েছে।
সূত্র: দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস।