যুদ্ধের ব্যবসা, চীনের হুমকি মোকাবিলায় ফুলেফেঁপে উঠেছে বৈশ্বিক অস্ত্র বাণিজ্য: সিপ্রি
ভারত, অস্ট্রেলিয়া ও জাপান—বিশ্বের সবচেয়ে বেশি অস্ত্র আমদানিকারক দেশের মধ্যে শীর্ষে রয়েছে। সুইডিশ থিঙ্ক ট্যাঙ্ক- স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (সিপ্রি) বৈশ্বিক প্রতিরক্ষা ব্যয় নিয়ে প্রস্তুতকৃত সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এ খাতের হালচিত্র।
২০১৬-২১ এ পাঁচ বছরে বৈশ্বিক অস্ত্র বিকিকিনির তথ্য পর্যালোচনা করে তুলে ধরেছে সিপ্রি। প্রতিবেদনে প্রকাশ, অস্ত্র আমদানিতে এ সময় শীর্ষে ছিল এশিয়া ও ওশেনিয়া। আলোচিত সময়ে মহাদেশ দুটির রাষ্ট্রগুলো মোট বৈশ্বিক প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম বিক্রির ৪৩ শতাংশ কেনে। পাশাপাশি শীর্ষ ১০ অস্ত্র আমদানিকারকের ৬টিই ছিল এ অঞ্চলের।
প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে পশ্চিমা হুমকি মোকাবিলায় নৌশক্তি বাড়িয়ে চলেছে চীন। প্রতিবেশীদের সাথে দেশটির রয়েছে সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধ। এ উত্তেজনাকে পুঁজি করে চীনের প্রতিবেশীদের সশস্ত্র হওয়ার তাগিদ দিচ্ছে পশ্চিমা দেশগুলো। চীনের সাথেও শক্তি প্রদর্শন করে উত্তেজনা জিইয়ে রাখছে তারা। পরস্পর এই চোখ রাঙানিতে ফুলেফেঁপে উঠেছে তাদের অস্ত্র বিক্রি। ফলতঃ চীনের সাথে দ্বন্দ্ব এবং পশ্চিমাদের উৎসাহই ছিল ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে অস্ত্র আমদানির সবচেয়ে বড় কারণ।
সিপ্রির আর্মস ট্রান্সফার প্রোগ্রাম- এর জ্যেষ্ঠ গবেষক সিমন ওয়েজেমান প্রতিবেদনে লিখেছেন, "এশিয়া আর ওশেনিয়ার অনেক রাষ্ট্রের সাথে চীনের উত্তেজনা- এ অঞ্চলে অস্ত্র বাণিজ্যের প্রধান চালিকাশক্তির ভূমিকা রেখেছে।"
২০১২-১৬ মেয়াদের তুলনায় ২০১৭-২১ মেয়াদে অস্ত্র আমদানি দক্ষিণ এশিয়ায় ২১ শতাংশ এবং দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় ২৪ শতাংশ কম হয়েছে, কিন্তু ওশেনিয়া মহাদেশে তা ৫৯ শতাংশ বাড়ে- প্রধানত অস্ট্রেলিয়ার আমদানি ৬২ শতাংশ বৃদ্ধির কারণে। পূর্ব এশিয়ায় বেড়েছে ২০ শতাংশ।
দক্ষিণ এশিয়ার শীর্ষ অস্ত্র আমদানিকারক ভারত:
বৈশ্বিক অস্ত্র বাণিজ্যের আমদানিভাগে দ. এশিয়ার সার্বিক অবদান ২১ শতাংশ কমলেও; এসময়ে শীর্ষ ক্রেতার আসন ভারতের দখলেই ছিল। মোট আঞ্চলিক আমদানির ২১ শতাংশের মধ্যে ভারত একাই কিনেছে ১১ শতাংশ। আগামী কয়েক বছরে বেশ কয়েকটি সরবরাহক দেশ থেকে আরো বৃহৎ পরিসরে অস্ত্র কেনার পরিকল্পনাও রয়েছে নয়াদিল্লির।
২০১২-১৬ এর তুলনায় ২০১৭-২১ এ তাইওয়ানের অস্ত্র আমদানিও ৬৮ শতাংশ কমেছে। তবে তাদের আমদানিও আগামী বছরগুলোয় বৃদ্ধির পথেই রয়েছে। অস্ত্র আমদানিকারক শীর্ষ ১০ দেশের র্যাঙ্কিং তালিকায় আরো রয়েছে চীন, দক্ষিণ কোরিয়া ও পাকিস্তান।
বিশ্বের সকল অঞ্চলের মধ্যে ২০১৭-২১ পাঁচ বছরে সবচেয়ে বেশি অস্ত্র আমদানি করেছে ইউরোপ মহাদেশের দেশগুলো। ২০১২-১৬ সালের তুলনায় এ সময় তারা ১৯ শতাংশ বেশি কিনেছে গুরুত্বপূর্ণ সমরাস্ত্র। তাদের ক্রয় ছিল মোট বৈশ্বিক অস্ত্র বাণিজ্যের ১৩ শতাংশ।
ইউরোপের বৃহৎ সমরাস্ত্র আমদানিকারকের মধ্যে ছিল- যুক্তরাজ্য, নরওয়ে ও নেদারল্যান্ডস।
এদিকে গেল ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনে সচকিত হয়েছে ইউরোপের প্রায় সকল দেশ। জার্মানি, পোল্যান্ড, লিথুনিয়া ও ডেনমার্ক তাদের প্রতিরক্ষা বাজেট উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বৃদ্ধির ঘোষণা দিয়েছে। এতে চলতি বছর ইউরোপে অস্ত্র আমদানি আরো নাটকীয় হারে বেড়ে যাওয়ার অনুমান করছে সিপ্রি।
ওয়েজেমান অবশ্য বলছেন, ঊর্ধ্বমুখী এ প্রবণতা আসলে শুরু হয় ২০১৪ সালে রাশিয়ার ক্রিমিয়া উপদ্বীপ দখলের পর থেকেই, যা এখন যুদ্ধের কারণে অতিরিক্ত মাত্রায় বাড়ার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে।
তিনি এবিষয়ে লিখেছেন, "ইউরোপের অধিকাংশ দেশের সাথে রাশিয়ার সম্পর্কের মারাত্মক অবনতি এ অঞ্চলে অস্ত্র আমদানি বৃদ্ধিতে উৎসাহ যুগিয়েছে। বিশেষত, ইউরোপের যেসব দেশ তাদের স্থানীয় শিল্পের মাধ্যমে প্রতিরক্ষার সকল চাহিদা পূরণ করতে পারে না- তারা এখন বিপুল পরিমাণে অন্য দেশ থেকে কিনছে।"
আমেরিকার সাথে প্রতিরক্ষা সম্পর্ক দৃঢ় রাখতেও অনেক ইউরোপিয় দেশ মার্কিন সমরাস্ত্র কেনে। ওয়েজেমানের মন্তব্য, "অস্ত্র হস্তান্তরের এ বাণিজ্য আন্তঃআটলান্টিক নিরাপত্তা সম্পর্কের ক্ষেত্রেও কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে।"
ইয়েমেন: দারিদ্র্যপীড়িত যে দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধে উপসাগরীয় ধনী আরব দেশগুলো হাজারো কোটি ডলারের অস্ত্র কিনেছে
উপসাগরীয় আরব দেশগুলোয় চলে রাজতান্ত্রিক শাসন। মানবাধিকার পরিস্থিতি ন্যাক্কারজনক। শাসকগোষ্ঠী বিলাসিতায় মত্ত আর উন্নাসিক। অথচ আরব বিশ্বের সবচেয়ে দরিদ্র দেশে সামরিক আগ্রাসন চালিয়েছে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো সম্পদশালী দেশ। যদিও, ইয়েমেনিদের প্রতিরোধে তাদের সম্মুখযুদ্ধে লজ্জাজনক পরিণতির শিকার হতে হয়।
এরপর থেকেই নির্বিচার বিমান হামলা ও গোলাবর্ষণ করে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয় ইয়েমেনের বেসামরিক অবকাঠামো। ভ্রাতৃঘাতি এ যুদ্ধে আরব দুনিয়ায় বিভাজন গভীর হলেও—বিপুল মুনাফা করছে অস্ত্র রপ্তানিকারকরা।
গত ২০১৭-২১ মেয়াদে মধ্যপ্রাচ্যে অস্ত্র আমদানি আগের পাঁচ বছরের চেয়ে বেড়েছে ২.৮ শতাংশ। অনাহার পীড়িত দেশটিতে নির্দয়ভাবে ফেলা হয়েছে শত শত কোটি ডলারের বোমা। যার বেশিরভাগ যোগান দিয়েছে আমেরিকা, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সের মতো মানবাধিকার নিয়ে তথাকথিত সোচ্চার দেশ।
ইরানের সঙ্গেও পশ্চিমারা উত্তেজনা তৈরি করেছে। উপসাগরীয় দেশগুলোও মার্কিনীদের অনুসরণ করেছে ইরান-বিরোধিতায়। ইয়েমেন যুদ্ধ ও ইরানের সাথে বিরোধ কেন্দ্র করেই তারা আবার বিপুল সমরাস্ত্র কিনছে।
আগের পাঁচ বছরের তুলনায় ২০১৭-২১ মেয়াদে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ সমরাস্ত্র আমদানিকারক সৌদি আরবের অস্ত্র ক্রয় ২৭ শতাংশ বাড়ে। একইসময়ে, রিয়াদের আঞ্চলিক প্রতিযোগী কাতারের অস্ত্র আমদানি বাড়ে বিস্ময়কর ২২৭ শতাংশ। ফলে দেশটি বৈশ্বিক অস্ত্র আমদানিতে ২২তম স্থান থেকে ষষ্ঠস্থানে উঠে আসে।
২০১২-১৬ এর তুলনায় পরের পাঁচ বছরে সংযুক্ত আরব আমিরাতের অস্ত্র ক্রয় কমেছে ৪১ শতাংশ। ফলে বিশ্বের তৃতীয় বৃহৎ অস্ত্র আমদানিকারক থেকে দেশটি নবম স্থানে নেমে এসেছে। তবে আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই সৌদি আরব, আরব আমিরাত, কাতার ও কুয়েত উল্লেখযোগ্য মাত্রায় নতুন সমরাস্ত্রের সরবরাহ পেতে চলেছে।
ওয়েজেমান উল্লেখ করেন, "তেলের বাজার এখন চড়া। টাকা নিয়ে তাদের কোনো ভাবনা নেই। ফলে তারা মুক্তহস্তে বড় অস্ত্রের অর্ডার দিতে পারবে, আর তেমনটাই আশা করা হচ্ছে।"
অস্ত্র বাণিজ্যের রমরমায় ২০১৭-২১ মেয়াদে আমেরিকার অস্ত্র রপ্তানি বেড়েছে ১৪ শতাংশ। ২০১২-১৬ মেয়াদে আমেরিকা মোট বৈশ্বিক অস্ত্র বিক্রির ৩২ শতাংশ করেছিল, যা এখন দাঁড়িয়েছে ৩৯ শতাংশে।
মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোই মার্কিন অস্ত্রের সবচেয়ে বড় ক্রেতা, তারা কিনেছে ৪৩ শতাংশ। এসময় ফ্রান্স মোট অস্ত্র রপ্তানির ১১ শতাংশ করে আমেরিকা ও রাশিয়ার পর, তৃতীয় বৃহৎ অস্ত্র সরবরাহক দেশের স্থান দখল করেছে।
গত পাঁচ বছরে রাশিয়ার চেয়ে দ্বিগুণ অস্ত্র বিক্রি করেছে আমেরিকা। এসময়ে রাশিয়ার অস্ত্র রপ্তানি ২৬ শতাংশ কমে বৈশ্বিক হিসাবের ১৯ শতাংশে নেমে আসে।
রুশ অস্ত্রের বড় ক্রেতা: ভারত ও ভিয়েতনাম। দেশদুটি তাদের অস্ত্র সংগ্রহের উৎসে বৈচিত্র্য আনছে। স্থানীয়ভাবে নিজেরাও উৎপাদনের উদ্যোগ নিচ্ছে। একারণেই রাশিয়ার অস্ত্র রপ্তানিতে ভাটা পড়ে।
চলমান ইউক্রেন সংকটে রাশিয়ার অস্ত্র বাণিজ্য আরেকদফা বাধাগ্রস্ত হলো। পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কারণে এখন অনেক দেশের জন্যই রুশ অস্ত্র ক্রয় অসম্ভব হয়ে পড়বে।
- সূত্র: দ্য ইউরেশিয়ান টাইমস