ইউক্রেন সেনাবাহিনী কেন তুর্কি ড্রোনের প্রশংসায় পঞ্চমুখ?
যুদ্ধক্ষেত্রে সফল অস্ত্র হিসেবে খ্যাতি-কুখ্যাতি দুই-ই অর্জন করেছে তুরস্কের তৈরি বায়রাক্তার সিরিজের ড্রোন (টিবি-২)। নগোরনো-কারাবাখ যুদ্ধে আজারবাইজানের জয়ী হওয়ার অন্যতম নির্ধারক ছিল মনুষ্যহীন এ আকাশযানের (ইউএভি) ব্যবহার। ইউক্রেনীয় বাহিনীর কাছেও বিপুল জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে তুর্কি অস্ত্রটি।
জনপ্রিয়তা এতটাই যে ড্রোনটি নিয়ে একটি গানও বেঁধেছে ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনী। তাদের ফেসবুক পেইজে গানটি কথা ও সুর প্রকাশিত হয়, তার একটি লাইন এমন – "দানবদের বিরুদ্ধে এবার আমরা পাল্টা আঘাত হানছি, বায়রাক্তারের মৃত্যু থাবায় রুশ দস্যুরা যাচ্ছে পরপারে।"
ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় তাদের টুইটার পেইজে পুলিশ বাহিনীর একটি কুকুরের ছবি পোস্ট করেছে। এটিসহ কিয়েভ চিড়িয়াখানায় সদ্যজাত একটি লেমুরের নামও রাখা হয়েছে বায়রাক্তার। আসলে চলমান যুদ্ধে ড্রোনটি দিয়ে অনেক রাশিয়ান ট্যাংক ও মিসাইল সিস্টেম ধবংসের দাবি করেছে ইউক্রেন, এজন্যই তারা এটির প্রশংসায় ভাসছে।
যুদ্ধে নিজেদের তৈরি অস্ত্রের সফলতা পাওয়া মাত্র লুফে নেয় সব দেশ। তা আরো বাড়িয়ে-ছাপিয়ে প্রচার করে। কিন্তু, ভৌগলিকভাবে তুরস্কের কাছেই রাশিয়ার অবস্থান। আছে জ্বালানি ও খাদ্য আমদানিতে মস্কো নির্ভরতা, আর জটিল ভূ-রাজনৈতিক সমীকরণ। এসব কারণে আঙ্কারার প্রতিক্রিয়া হয়েছে ইউক্রেনীয়দের বিপরীত। তুর্কি সরকার এখন কিয়েভের কাছে এই অস্ত্র বিক্রির গুরুত্বকে খাটো করে দেখানোর চেষ্টা করছে।
তাছাড়া, ইউক্রেন সংকটে মধ্যস্ততায় উদ্যমী আঙ্কারা। রাশিয়ার শ্যেনদৃষ্টিতে পড়লে সে সুযোগও হারাবে। সব ভেবেচিন্তেই যেকোনো উচ্ছ্বাস চেপে রাখছেন তুর্কি কর্মকর্তারা।
ইতোমধ্যেই, গত ১০ মার্চ যুদ্ধ শুরুর পর- প্রথমবারের মতো তুরস্কে এক বৈঠকে অংশ নেন রাশিয়া ও ইউক্রেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদ্বয়।
ন্যাটো সদস্য তুরস্ক প্রতিবেশী ইউক্রেনকে রুশ আগ্রাসন মোকাবিলায় ট্যাংক বিধবংসী অস্ত্র ও ক্ষেপণাস্ত্র দিলেও, ড্রোন বিক্রিকে আর দশটা সাধারণ বাণিজ্যিক লেনদেনের মতো করে উপস্থাপন করছেন তুর্কি কর্মকর্তারা। তার ওপর আবার, বায়রাক্তার ড্রোন প্রস্তুতকারক বাইকার-মাকিনা কোম্পানির সহ-প্রতিষ্ঠাতা তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের আপন জামাতা সেলজুক বায়রাক্তার।
ড্রোন নিয়ে আত্মপ্রচার তাই এরদোয়ান প্রশাসনের মধ্যস্ততার চেষ্টাকে ভেস্তে দিবে এমন আশঙ্কা করা হচ্ছে। পদস্থ একজন কর্মকর্তার কথা শুনলেই তা বোঝা যায়।
চলতি মাসে ডেইলি সাবাহ পত্রিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তুরস্কের উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী ইয়াভুজ সেলিম কিরান যেমন বলছিলেন, "তুরস্ক এটি কোনো সহায়তা হিসেবে দেয়নি। তুরস্কের একটি কোম্পানি থেকে ইউক্রেন এই ড্রোন কিনেছে।"
অবশ্য তিনি ড্রোনের সফলতা নিয়ে প্রশংসা করে একে 'যুগান্তকারী' বলে উল্লেখ করেন।
"ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনীর অন্যতম প্রতিরোধ অস্ত্র হয়ে আমাদের পণ্যটি তার গুণগত মান ও সাফল্য আরো একবার প্রমাণ করেছে। অনেক দেশই এখন ইউএভি-টি কিনতে সারবেঁধে অপেক্ষা করছে।"
তুরস্কের এই সতর্ক আচরণের আরেক কারণ; এরদোয়ান-পুতিন সম্পর্ক। এরদোয়ান দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টায় পুতিনের সাথে একটি বেশ জটিল জোট সমীকরণ গড়ে তুলেছেন। ন্যাটো মিত্রদের ক্ষুদ্ধ করে এর আগে মস্কোর কাছ থেকে অত্যাধুনিক আকাশপ্রতিরক্ষা ব্যবস্থা (এস-৪০০) কেনে আঙ্কারা। একইসঙ্গে, লিবিয়া ও সিরিয়ায় আবার রাশিয়ার বিরোধী শিবিরকে সাহায্য করেছে।
এরদোয়ান ইউক্রেন আগ্রাসনের নিন্দা জানালেও, রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিরোধিতা করেছেন। কারণ, পর্যটন খাতসহ শক্তিধর প্রতিবেশীটির ওপর গম ও সিংহভাগ জ্বালানি আমদানিতে নির্ভরশীলতা রয়েছে আঙ্কারার।
অন্যদিকে, এরদোয়ান ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদমির জেলেনস্কির সাথেও প্রতিরক্ষা সহযোগিতার সম্পর্ক গভীর করেন। গত মাসে তারা নতুন প্রজন্মের ড্রোন তৈরিতে দুই দেশ একসাথে কাজ করবে, এমন একটি সমঝোতায় পৌঁছান। ফলে ২০১৯ সালে তুরস্কের ইস্তাম্বুল-ভিত্তিক বায়কার কোম্পানির তৈরি কমপক্ষে ২০টি ড্রোন ক্রয়ের যে চুক্তি কিয়েভ করেছিল- তার আওতা আরো প্রসারিত হয়।
বায়কারের সহ-প্রতিষ্ঠাতা সেলজুক বায়রাক্তার ও তার দুই ভাই। সেলজুক যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত ম্যাসেচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে স্নাতকোত্তর বৃত্তি পেয়ে পড়াশোনা করেছেন।
ইউক্রেনের কাছে ড্রোন বিক্রি ছিল তুরস্কের বৃহত্তর 'ড্রোন কূটনীতির' অংশ, যার মাধ্যমে নিজস্ব পররাষ্ট্রনীতির অগ্রাধিকার অনুসারে, ক্রেতা দেশের সাথে সামরিক অংশীদারিত্ব মজবুত করছে আঙ্কারা। এরমধ্যেই তুরস্কের সবচেয়ে বিখ্যাত বায়রাক্তার টিবি-২ ড্রোন কিনেছে বা অর্ডার দিয়েছে প্রায় এক ডজন দেশের সরকার।
যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়া-ভিত্তিক ফরেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের বিশেষজ্ঞ অ্যারন স্টেইন বলেন, "ড্রোনগুলি বিক্রি করা এখন তুরস্কের পররাষ্ট্রনীতির শীর্ষ অগ্রাধিকারের মধ্যে রয়েছে। এটি দেশটির অন্যতম মূল্যবান রপ্তানি পণ্য। অনেক দেশের কাছেই তা সেরা পছন্দ। কার্যকারিতায় এটি অপেক্ষাকৃত কম দামের চীনে তৈরি ড্রোনের চেয়ে এগিয়ে, বাজারের অন্য প্রতিযোগী- আমেরিকা ও ইসরায়েলের তৈরি একই মানের ড্রোনের দাম আবার খুবই বেশি।"
সে বিবেচনায় উৎপাদন ও মোতায়েনে সস্তা টিবি-২ বাজারমূল্য ৫০ লাখ ডলার। বিভিন্ন রণাঙ্গনে ড্রোনটি পরীক্ষিত ও মারাত্মক বলে প্রমাণিত। উত্তর আফ্রিকার মরুভূমি থেকে ককেশাস পর্বতমালা- বিস্তৃত অনেক অঞ্চলে এটি সাড়া জাগানো সফলতা পায়। এসব অঞ্চলে রাশিয়ার অস্ত্রের বিরুদ্ধেও লড়েছে টিবি-২। তুরস্ক তার নিজ দেশের বিচ্ছিন্নতাকামী কুর্দি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধেও এর ব্যবহার করেছে।
উল্লেখ্য, টিবি-২ এর সমশ্রেণির ইসরায়েলের একটি হ্যারন ড্রোনের দাম প্রায় ১ কোটি ডলার, আমেরিকার তৈরি একই শ্রেণির ড্রোন কিনতে ক্রেতা দেশকে ২ কোটি ডলার পর্যন্তও দিতে হয়। কিছুক্ষেত্রে তা বেশিও হতে পারে। অন্যদিকে, চীনে তৈরি এমন ড্রোনের দাম সর্বনিম্ন ১০ লাখ ডলার হলেও, সেগুলো খুব বেশি দুর্ঘটনা-প্রবণ। তাই দাম ও নির্ভরযোগ্যতার বিচারেও টিবি-২ সেরা।
এই ড্রোনের ক্রমবর্ধমান চাহিদার কারণে ২০২১ সালে তুরস্কের প্রতিরক্ষা খাতের রপ্তানি ৪০ শতাংশ বেড়ে ৩২২ কোটি ডলারে উন্নীত হয় বলে জানিয়েছে দেশটির রপ্তানিকারক সমিতি। চলতি বছরের প্রথম দুই মাসে নাটকীয় হারে বেড়েছিল ইউক্রেনে তুরস্কের অস্ত্র রপ্তানি, যা ৫৮.৪ মিলিয়ন ডলার ছিল বলে জানানো হয়।
ইউক্রেনের হাতে থাকা ড্রোনগুলোর মধ্যে একমাত্র টিবি-২ একসঙ্গে চারটি লেসার রশ্মি নিয়ন্ত্রিত বোমা/ক্ষেপণাস্ত্র বহন করতে পারে। স্টেইন বলেছেন, "কাজের দিক থেকে ইউক্রেনের কাছে এই ড্রোন খুবই মূল্যবান হয়ে উঠেছে। ইউক্রেন সুযোগ পেলে ড্রোনটি আরো কিনতেই থাকতো। কারণ, রুশ বাহিনীর মধ্যে চরম ক্ষোভের জন্ম দিচ্ছে এই অস্ত্র।"
অবশ্য, রাশিয়ার মতো বিশাল শক্তির বিরুদ্ধে স্থলযুদ্ধে অবধারিত পরাজয় এড়াতে পারবে না ইউক্রেন। তারপরও কৌশল বুঝে এটি ব্যবহার করে তারা রুশ বাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে পারছে। ফলে তুলনামূলক দুর্বল একটি প্রতিপক্ষ পেয়েছে আগ্রাসী বাহিনীকে আঘাত হানার শক্তি"- মন্তব্য করেন ইস্তাম্বুল-ভিত্তিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক ইড্যামের প্রতিরক্ষা অধ্যয়ন শাখার পরিচালক ক্যান কোসাপোগলু।
সমর বিশারদরা বলছেন, নিচু দিয়ে ওড়া টিবি-২ ড্রোন রুশ বাহিনীর জন্য সহজ লক্ষ্যবস্তু। পুতিনের বাহিনী ইউক্রেনের আকাশপথ পুরোপুরি দখলে নেওয়ার পর, এই আধিপত্য হারিয়ে যাবে।
যুদ্ধের এ পর্যায়ে মস্কোর দাবি, রুশ বাহিনী এপর্যন্ত চারটি বাইরাক্তার ড্রোন এবং তারা যেসব ঘাঁটি থেকে উড্ডয়ন করেছিল, সেগুলো ধবংস করেছে।
প্রভাবশালী আরেক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক চ্যাথাম হাউজের রাশিয়া ও ইউরেশিয়া অধ্যয়ন শাখার গবেষণা ফেলো ম্যাথু বোলিগ মনে করছেন, "ড্রোনগুলো যখন চ্যালেঞ্জের মুখ পড়তে থাকবে, তখনই তারা ধবংস হতে থাকবে। ফলে যুদ্ধের শুরু থেকেই রাশিয়া আকাশপথে আধিপত্যের যে লক্ষ্য নিয়েছে, তা প্রতিষ্ঠিত হবে।"
- সূত্র: ফিন্যান্সিয়াল টাইমস