‘ব্যবসায়ী হওয়া কি আমার অপরাধ?’, সাংসদদের তোপের মুখে বাণিজ্যমন্ত্রী
দ্রব্যমূল্য ও ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটে নিয়ন্ত্রনে ব্যর্থতা হওয়া নিয়ে জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের সংসদ সদস্যদের কঠোর সমালোচনার মুখে পড়েছেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি।
মঙ্গলবার জাতীয় সংসদে 'বাণিজ্য সংগঠন বিল-২০২২' পাসের আলোচনায় অংশ নিয়ে তারা এই সমালোচনা করেন।
বিরোধী সাংসদেরা বলেন, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকার ব্যর্থ হয়েছে। বাণিজ্যমন্ত্রী একজন অভিজ্ঞ ব্যবসায়ী হয়েও সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয়েছেন।
জবাবে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, তিনি ব্যবসা করছেন ৪০ বছর আর রাজনীতি করছেন গত ৫৬ বছর ধরে। তিনি বিরোধীদের কাছে জানতে চান 'ব্যবসায়ী হওয়া কি তার অপরাধ?'
বিল পাসের আলোচনায় অংশ নিয়ে জাতীয় পার্টির সাংসদ পীর ফজলুর রহমান বলেন, "বাণিজ্যমন্ত্রী সজ্জন মানুষ। কিন্তু তিনি সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না। যে কারণে প্রায় সময় সিন্ডিকেট দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে। মন্ত্রী একজন অভিজ্ঞ ব্যবসায়ী হয়েও কেন তিনি সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না?"
তিনি বলেন, "সত্য স্বীকার করতে হবে। বাণিজ্যমন্ত্রী সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি। সিন্ডিকেট করে তেলের দাম বাড়িয়ে হাজার কোটি টাকা নিয়ে গেছে। কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেননি তিনি।"
সুনামগঞ্জ-৪ এর এই সাংসদ বলেন, "আজকে সংবাদপত্রে এসেছে তিনি (বাণিজ্যমন্ত্রী) গতকাল বাজারে গিয়েছেন এবং তিনি ২৮ টাকা কেজিতে ৫ কেজি পেঁয়াজ কিনেছেন। এখন মাননীয় মন্ত্রী যদি ঘোষণা দিয়ে একটু কাঁচাবাজার, সবজি বাজারসহ অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজারে যেতেন মানুষও ওই বাজারে যেতে পারত এবং মন্ত্রীর মতো কম দামে জিনিস কিনতে পারত। কারণ উনি যতই ভ্যাট কমিয়ে মূল্য কমানোর চেষ্টা করছেন, প্রকৃতপক্ষে বাজারে পণ্যের দাম অত কমেনি।"
জাতীয় পার্টির আরেক সাংসদ মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাদের স্বার্থরক্ষার জন্য কঠোরভাবে বাজার নজরদারি করতে হবে। সরকারের সহযোগিতা ছাড়া সিন্ডিকেট মূল্য বৃদ্ধি করতে পারে না।
তিনি যোগ করেন, "বলা হয় যুদ্ধের কারণে দাম বেড়েছে। যেসব পণ্য আমদানি করা হয় সেগুলোর দাম বাড়তে পারে। যেগুলো যুদ্ধের আগে আমদানি করা হয়েছে এবং যেগুলো দেশি পণ্য সেগুলোর কেন দাম বাড়বে?"
প্রয়োজনে ভর্তুকি দিয়ে হলেও নিত্যপণ্যের দাম কমানোর দাবি জানান তিনি।
জাতীয় পার্টির সংরক্ষিত নারী আসনের সাংসদ রওশন আরা মান্নান বলেন, "সরকার ধরলে দাম কমে আবার যখন সরকার শিথিলতা দেখায় তখন আবার দাম বাড়ে। একটার দাম কমলে আরেকটার দাম বাড়ে এটা একটা লুকোচুরি খেলার মতো।"
চাঁদাবাজির কারণে দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে উল্লেখ করে জাতীয় পার্টির সাংসদ শামীম হায়দার পাটোয়ারি বলেন, সাধারণ মানুষ এখন পুষ্টিমানের সঙ্গে আপস করতে বাধ্য হচ্ছে। শ্রীমঙ্গলে যে লেবু ২ টাকা সেটা ঢাকায় ২২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে বাণিজ্যমন্ত্রীকে আবার যুদ্ধ করতে হবে।
একই পার্টির সাংসদ ফখরুল ইমাম বলেন, "অ্যাপোলো হাসপাতালে গেলে লক্ষাধিক টাকা বিল এলে, বাজারে গেলে বেশি দাম দেখে বাণিজ্যমন্ত্রীর কথা মনে পড়ে।"
বিএনপির সাংসদ হারুনুর রশীদ বলেন, গ্যাসের অভাবে ঢাকায় হাহাকার চলছে। গ্যাসের দাম, তেলের দাম সব বাড়ানো হচ্ছে। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকার ব্যর্থ হয়েছে। এ ক্ষেত্রে কিছু উদ্যোগ সরকার নিয়েছে। কিন্তু সেখানে স্বচ্ছতার অভাব আছে।
তিনি বলেন, "ব্যবসায়ীরা জনপ্রতিনিধি হয়ে সম্পদের পাহাড় গড়ছেন কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। ক্ষমতার বলয়ে থেকে সিন্ডিকেট বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। তারেক রহমান লন্ডন থেকে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করছেন, বিএনপির কারণে দ্রব্যমূল্য বাড়ছে, এসব অপ্রাসঙ্গিক কথা না বলে সরকারকে দৃশ্যমান পদক্ষেপ নিতে হবে।"
একই দলের সাংসদ রুমিন ফারহানা বলেন, "তেলের দাম বৃদ্ধি নিয়ে হইচই হলো। ১৫ দিনে সিন্ডিকেট এক হাজার কোটি টাকা উঠিয়ে নিয়েছে। সরকার আর সিন্ডিকেটের মধ্যে পার্থক্য নেই।"
দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণ হিসেবে যুদ্ধকে দায়ী করা যাবেনা উল্লেখ করে গণফোরামের সাংসদ মোকাব্বির খান বলেন, ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হয়। তার অনেক আগে এই সংসদ অধিবেশনে তিনি দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের দাবি জানিয়েছিলেন। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির অজুহাত হিসেবে যুদ্ধকে সামনে নিয়ে আসলে হবে না। যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট মূল্য বাড়িয়ে পকেট কেটে অনেক টাকা নিয়ে গেছে।
বিরোধী সাংসদদের বক্তব্যের জবাবে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, যুদ্ধের কারণে ভোজ্যতেলের দাম বেড়েছে, এটা তিনি কখনো বলেননি। প্রতি মাসে তেলের দাম নির্ধারণ করা হয়। এখন বিশ্ব বাজারে ভোজ্যতেলের দাম বেড়েছে।
মন্ত্রী আরও বলেন, সরকার কোথাও ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে না। ব্যবসায়ীদের সহায়তা করে। যে কেউ চাইলে তেল আমদানি করতে পারে। সরকার সিন্ডিকেট এটা ভাবার কোনো কারণ নেই।
তিনি যোগ করেন, "একটি টিসিবির ট্রাক থেকে আড়াই শ মানুষকে পণ্য দেওয়া হয়। ছবি দেখানো হয় পণ্যের জন্য মানুষ দৌড়াচ্ছে। ৩০০ জন লাইনে দাঁড়ালে ৫০ জন পাবেন না। কিন্তু ২৫০ জন যে পণ্য পেয়েছেন সেটা দেখানো হয় না।"
বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, "সিন্ডিকেট বলে যাদের কথা বলা হচ্ছে তারা কেউ রাজনীতি করেন না, তারা কেউ এমপি নন। সরকার চেষ্টা করে যাচ্ছে।"
প্রধানমন্ত্রী প্রতিনিয়ত ফলোআপ করছেন বলে উল্লেখ করেন তিনি।