পাকিস্তানের রাজনীতিতে বাপ-বেটার সুদিন
কদিন আগেই পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনে বিরোধী দলগুলো। কিন্তু গত ৩ এপ্রিল অনাস্থা ভোট বাতিল করেন ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির ডেপুটি স্পিকার কাশিম সুরি। এরপর ইমরানের পরামর্শে পার্লামেন্টও ভেঙে দেন প্রেসিডেন্ট আরিফ আলভি। কিন্তু গতকালই এসব সিদ্ধান্তকে বাতিল ঘোষণা করেছেন পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্ট।
সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে শনিবার অনুষ্ঠিত হবে অনাস্থা ভোট। প্রধানমন্ত্রী ইমরানের বিদায় এখন একপ্রকার নিশ্চিতই বলা চলে।
পাকিস্তানের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দৌড়ে এগিয়ে আছেন শাহবাজ শরিফ। বাবা যখন দেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্য লড়ছেন, তখন পাঞ্জাব প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী হতে আইনি লড়াইয়ে রত ছেলে হামজা শাহবাজ। বাবা সুপ্রিম কোর্টে লড়ে এক লড়াই জিতেছেন। ছেলে লড়ছেন লাহোর হাই কোর্টে (এলএইচসি)। সব মিলিয়ে পাকিস্তানের রাজনীতিতে এখন বাপ-বেটার সুদিনই চলছে বলা যায়।
৮ এপ্রিল শুক্রবার এলএইচসির দ্বারস্থ হন পিএমএল-এন নেতা হামজা শাহবাজ। পাঞ্জাবের নতুন মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচন যে 'সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ' হয়, সেজন্য আদালতের সাহায্য প্রার্থনা করেন তিনি।
হামজার পিটিশনে বিবাদী করা হয়েছে পাঞ্জাব প্রদেশের চিফ সেক্রেটারি, পাঞ্জাব অ্যাসেম্বলির (পিএ) স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকার এবং প্রাদেশিক পুলিশ প্রধানকে।
এলএইচসির প্রধান বিচারপতি আমির ভাট্টি পিটিশনটি গ্রহণ করেন। এর সঙ্গে একইরকমের আরেকটি পিটিশন গ্রহণ করেন তিনি। দ্বিতীয় আবেদনটি করেন পিএর ডেপুটি স্পিকার সরদার দোস্ত মাজারি। উল্লেখ্য, বিরোধী দলে যোগদানের জন্য সম্প্রতি তার ক্ষমতা থেকে কেড়ে নেন স্পিকার চৌধুরী পারভেজ এলাহি।
তবে স্পিকারের আদেশকে আদালতে চ্যালেঞ্জ করা যাবে না দাবি করে হামজার পিটিশন নিয়ে আপত্তি তোলেন রেজিস্ট্রার। কিন্তু এলএইচসির প্রধান বিচারপতি সে আপত্তিতে কান দেননি।
শুনানির শুরুতে হামজার আইনজীবী সিনেটর আজম নাজির তারার বলেন, ৬ এপ্রিল প্রাদেশিক আইনপ্রণেতাদের অ্যাসেম্বলি ভবনে প্রবেশ করতে বাধা দেওয়া হয়। প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচনের জন্য ভোট অধিবেশন ৬ এপ্রিল অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকলেও পরে তা পিছিয়ে ১৬ এপ্রিল নিয়ে যাওয়া হয়।
বিচারক তখন কৌঁসুলিকে জিজ্ঞেস করেন, 'ভোটের তারিখ যখন ঘোষণা করা হয়েছে, তখন সমস্যা কোথায়?'
আইনজীবী জবাব দেন, প্রদেশটি বেশ কয়েকদিন প্রধান নির্বাহীবিহীন থাকবে। একে তিনি 'গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা' বলে সতর্ক করেন।
তিনি আরও জানান, পাঞ্জাবের অ্যাডভোকেট জেনারেল ৫ এপ্রিল সুপ্রিম কোর্টকে আশ্বাস দিয়েছিলেন যে পরের দিন অধিবেশন অনুষ্ঠিত হবে।
ডেপুটি স্পিকারকে এ বিষয়ে জানানো হলে তিনি অধিবেশন ডাকেন। গতকাল সুপ্রিম কোর্ট এক 'ঐতিহাসিক' সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছে বলেও মন্তব্য করেন এই আইনজীবী।
এরপর এলএইচসির প্রধান বিচারপতি পাঞ্জাবের অ্যাডভোকেট জেনারেলকে তলব করেন এবং পিটিশনটি গ্রহণ করেন।
সংক্ষিপ্ত বিরতির পর শুনানি আবার শুরু হলে বিচারককে জানানো হয় যে পাঞ্জাবের অ্যাডভোকেট জেনারেল ইসলামাবাদে আছেন। তিনি আদালতে হাজির হতে পারবেন না। তখন বিচারপতি ভাট্টি ১১ এপ্রিল সোমবারের জন্য সব বিবাদীর প্রতি নোটিশ জারি করার সিদ্ধান্ত নেন।
কিন্তু পিএমএল-এনের আইনজীবী প্রতিবাদ করে বলেন, সোমবার অনেক দেরি হয়ে যাবে। আগামীকালের মধ্যে নোটিশের উত্তর দেওয়ার সময় নির্ধারণ করা উচিত। তিনি বলেন, সুপ্রিম কোর্ট রোববারও মামলার শুনানি করেছে।
জবাবে বিচারপতি ভাট্টি বলেন, সুপ্রিম কোর্ট স্বতঃপ্রণোদিত নোটিশ দিয়েছিলেন। আদালতকে নিয়মানুযায়ী কাজ করতে হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'সংবিধান ও আইন অনুযায়ী শুনানি হবে। আপনি আজ মামলা করেছেন। রেকর্ড পাওয়া গেলেই কেবল আমরা এগোতে পারব।'
এলাহি, মাজারি, পাঞ্জাবের চিফ সেক্রেটারি ও প্রাদেশিক পুলিশ প্রধানকে নোটিশ দিয়েছেন আদালত। প্রাদেশিক সচিবের কাছ থেকে পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচনের একটি রেকর্ডও চান বিচারক। তারপর ১১ এপ্রিল পর্যন্ত শুনানি মুলতবি করেন।
যা আছে হামজার পিটিশনে
পিটিশনে পিএমএল-এন নেতা বলেন, মুখ্যমন্ত্রী পদের নির্বাচন অনুষ্ঠান আটকে রাখা হয়েছে বৈষম্যের উপর ভিত্তি করে। এর উদ্দেশ্য, সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতাগুলোকে পদদলিত করা এবং সরকারি কার্যালয় ও কর্তৃপক্ষকে ব্যবহার করে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করা। যা স্পষ্টতই স্বেচ্ছাচার, অযৌক্তিক, এবং এখতিয়ার-বহির্ভূত।
পিটিশনে বলা হয়েছে, বুজদারের পদত্যাগের পর প্রাদেশিক অ্যাসেম্বলিতে হামজা ও এলাহির মনোনয়নপত্র জমা দেওয়া হয়। পরে তা গৃহীতও হয়। নতুন মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচনের জন্য ৩ এপ্রিল অধিবেশন ডাকা হলেও তা স্থগিত করা হয়।
ফলে ডেপুটি স্পিকার ৬ এপ্রিল সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় অধিবেশন করার নির্দেশ দেন। কিন্তু অ্যাসেম্বলি প্রাঙ্গণ বন্ধ করে সদস্যদের ভবনে প্রবেশ আটকে দেওয়া হয়।
পিটিশনে আরও বলা হয়, জনপ্রতিনিধিদের ইচ্ছা বুঝিয়ে দেবার জন্য যেসব রাজনৈতিক দল পিটিশনকারীকে মুখ্যমন্ত্রী পদে নির্বাচিত করেছে ও সমর্থন দিয়েছে, তারা [পিএ] ভবনের পাশেই একটি হোটেলে 'মক' অধিবেশন করে। সেখানে আবেদনকারীর পক্ষে একটি প্রস্তাবও পাস করে তারা।
পিটিশনে বলা হয়, এই পরিস্থিতিতে 'অভূতপূর্ব' সাংবিধানিক সংকট দেখা দিয়েছে।
অপ্রীতিকর ক্রিয়াকলাপ ও নিষ্ক্রিয়তাকে—যেমন নির্বাচন না করে অ্যাসেম্বলি স্থগিত করা, পিএ প্রাঙ্গণ সিল কর দেওয়া, সাংবিধানিক ম্যান্ডেট পালনে আইনপ্রণেতাদের বাধা দেওয়া—অকার্যকর ও বেআইনি ঘোষণা করার অনুরোধ জানান হামজা আদালতকে।
পিএমএল-এন নেতা আদালতকে 'অবিলম্বে' প্রাদেশিক অ্যাসেম্বলির অধিবেশন ডাকতে এবং নির্বাচন প্রক্রিয়া স্থগিত না করেই নির্বাচন সম্পন্ন করতে নির্দেশ জারি করার আহ্বান জানান।
অধিবেশনে যোগ দিতে এবং ভোট দিতে ইচ্ছুক আইনপ্রণেতাদের ওপর যেন কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ করা না হয়, তা নিশ্চিত করতে বিবাদীদের নির্দেশ দেওয়ার জন্যও আদালতের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচন
গত মাসে পদত্যাগ করেন পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী উসমান বুজদার। ফলে পাঞ্জাব অ্যাসেম্বলিকে (পিএ) এখন নতুন নেতা নির্বাচন করতে হবে। পিএমএল-কিউ-এর চৌধুরী পারভাইজ এলাহি এবং পিটিআই থেকে বেরিয়ে আসা আইনপ্রণেতাদের (জাহাঙ্গীর খান তারিন ও আলিম খান গ্রুপ) সমর্থনপুষ্ট পিএমএল-এন নেতা হামজা শাহবাজ পরবর্তী মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার দৌড়ে এগিয়ে থাকবেন বলে আশা করা হচ্ছে।
মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার জন্য ৩৭১ সদস্যের অ্যাসেম্বলিতে একজন প্রার্থীকে কমপক্ষে ১৮৬ ভোট পেতে হয়।
পাঞ্জাব অ্যাসেম্বলিতে পিটিআইয়ের ১৮৩ জন, পিএমএল-কিউয়ের ১০ জন, পিএমএল-এনের ১৬৫ জন, পিপিপির ৭ জন, স্বতন্ত্র ৫ জন এবং রাহ-ই-হকের একজন আইনপ্রণেতা রয়েছেন।
নির্বাচনের ভাগ্য নির্ধারণ করবে জাহাঙ্গীর তারিন গ্রুপের সমর্থন। এ গ্রুপের হাতে অন্তত ১৬ এমপিএর ভোট রয়েছে।
বৃহস্পতিবার বিরোধীরা এলাহির বিরুদ্ধে (যিনি একইসঙ্গে পিএর স্পিকারও) অনাস্থা প্রস্তাব পেশ করে।
গতকাল সুপ্রিম কোর্ট প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাবের বিষয়ে ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির ডেপুটি স্পিকারের রুল বাতিল করে দেন। এর পরপরই পাঞ্জাবের ক্ষমতাসীন জোট আবারও তাদের এমপিএদের হামজাকে ভোট দেওয়ার বিরুদ্ধে সতর্ক করে বলে দিয়েছে, নির্দেশ না মানলে তাদের অপসারণ করা হবে।
ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে প্রধানমন্ত্রী ইমরানকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য যৌথ বিরোধী দলের পিটিআই থেকে বেরিয়ে আসা এমএনএদের প্রয়োজন না-ও হতে পারে। কারণ প্রাক্তন সরকারের মিত্রদের সমর্থনসহ প্রয়োজনীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে তাদের। কিন্তু পাঞ্জাব অ্যাসেম্বলিতে মুখ্যমন্ত্রী পদে জেতার জন্য পিটিআই থেকে বেরিয়ে আসা কিছু আইনপ্রণেতার সমর্থন প্রয়োজন বিরোধীদের।
বুধবার ডেপুটি স্পিকার দোস্ত মুহাম্মদ মাজারির অধিবেশন ডাকার 'আদেশ'কে 'অবৈধ' আখ্যা দিয়ে পিএ বন্ধ করে দেওয়ার পর সেখানে পিএমএল-এনের নেতৃত্বাধীন বিরোধীদের প্রবেশ করতে বাধা দেওয়া হয়।
অ্যাসেম্বলি সচিবালয় জানিয়েছে, ডেপুটি স্পিকারের স্বাক্ষর করা পূর্ববর্তী বিজ্ঞপ্তি অনুসারে ১৬ এপ্রিল অ্যাসেম্বলির অধিবেশন আহ্বান করা হবে। স্পিকার হিসবে এলাহি নিজের ক্ষমতা ব্যবহার করে অবিলম্বে মাজারির কাছে অর্পিত ক্ষমতা প্রত্যাহারের নির্দেশ দিয়েছিলেন।
পিটিআই-পিএমএল-কিউ জোটে মাজারির বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তান আনেন তার সহআইনপ্রণেতারা। এমনকি তার কাছ থেকে অধিবেশনে সভাপতিত্ব করার ক্ষমতাও কেড়ে নেওয়া হয়। মাজারির আকস্মিক মন বদলকে পিএমএল-এন নেতৃত্বের 'কারসাজি' বলে অভিহিত করা হয়। অভিযোগ তোলা হয়, মাজারিকে 'ভালো কোনো রফা'র প্রস্তাব দিয়ে পিএমএল-এনের নেতারা দলে টেনেছেন।
- সূত্র: ডন