যে কারণে পুতিনের গার্লফ্রেন্ডকে নিষেধাজ্ঞা দিতে এখনও দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছে আমেরিকা
রাশিয়ার ইউক্রেনে আক্রমণের পর জবাব হিসেবে দেশটির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। রাশিয়ার বড় বড় ব্যাবসায়িক প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে খোদ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন; কেউই বাদ পড়েনি পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কবল থেকে।
তবে রাশিয়াকে জব্দ করার এত আয়োজনের মধ্যে একজনকে বাদ রেখেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। তিনি হচ্ছেন অ্যালিনা কাবায়েভা, পশ্চিমারা যাকে পুতিনের বান্ধবী (গার্লফ্রেন্ড) বলে বিশ্বাস করে।
কাবায়েভা সাবেক একজন অলিম্পিক চ্যাম্পিয়ন। রিদমিক জিমন্যাস্ট ছিলেন তিনি। তার শারীরিক নমনীয়তা ও মাদক কেলেঙ্কারি; দুটোই তাকে বিশ্বমঞ্চে বিখ্যাত করে তোলে। পুতিনের সম্পদ বিদেশে লুকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে সাহায্য করার জন্যও তাকে সন্দেহ করেন মার্কিন কর্মকর্তারা। তবে আপাতত নিষেধাজ্ঞার আওতায় না এলেও তাকে ভবিষ্যতে এ তালিকায় আনতে পারে যুক্তরাষ্ট্র।
কেন মার্কিন কর্মকর্তারা কাবায়েভাকে নিষেধাজ্ঞার আওতায় আনবেন কিনা তা নিয়ে এখনো দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছেন? কারণ, তারা মনে করছেন কাবায়েভাকে নিষেধাজ্ঞা দিলে তা হবে পুতিনের প্রতি একটি ব্যক্তিগত আঘাত। আর এর ফলে রাশিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার চলমান উত্তেজনাকর পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যেতে পারে। পুতিন অবশ্য এক সময়ের রাশিয়ান ভোগ ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদকন্যা ৩৯ বছর বয়সী এ অ্যাথলেটের সাথে কখনো কোনো সম্পর্ক থাকার কথা স্বীকার করেননি।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি ডিপার্টমেন্ট কাবায়েভার জন্য একটি নিষেধাজ্ঞা প্যাকেজ প্রস্তুত করলেও তা আপাতত মুলতুবি রাখা আছে। এ বিষয়ে তারা কোনো মন্তব্য করেনি। তবে মার্কিন কর্মকর্তারা বলেছেন, কাবায়েভার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি এখনো আলোচনার টেবিলে রয়েছে।
ক্রেমলিন দীর্ঘসময় ধরেই পুতিন-কাবায়েভা সম্পর্কের বিষয়টি অস্বীকার করে এসেছে। কাবায়েভা নিজেও পুতিনের সাথে কোনো সম্পর্ক থাকার কথা স্বীকার করেননি।
২০০৮ সালে একটি পত্রিকায় তাদের তথাকথিত সম্পর্ক বিষয়ে লেখা প্রকাশ হলে পুতিন বলেছিলেন, অন্যের ব্যক্তিগত জীবনে নাক গলানো লোকদের তিনি বরাবরই অপছন্দ করে এসেছেন।
রাশিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত গণমাধ্যমগুলোকে পুতিনকে সদাসর্বদা রুশ জাতির কল্যাণরত একজন রাজনৈতিক নেতা হিসেবে দেখিয়ে এসেছে। তাদের সংবাদ পরিবেশনা অনুযায়ী পুতিনের ব্যক্তিগত জীবনে সময় দেওয়ার বিশেষ অবকাশ নেই।
গত শনিবার অ্যালিনা কাবায়েভা তার নামে চালু হওয়া একটি জিমন্যাস্টিকস প্রদর্শনী, অ্যালিনা ফেস্টিভ্যাল-এ নিজের নৈপুণ্য দেখাতে মস্কোর ভিটিবি অ্যারেনাতে জনসমক্ষে আসেন। 'জেড' লোগোওয়ালা এতটি বিলবোর্ডের সামনে তাকে দাঁড়াতে দেখা যায়। এই 'জেড' লোগোটি দ্বারা ইউক্রেনে যুদ্ধরত রাশিয়ান বাহিনীর সমর্থন প্রকাশ করা হয়।
তিনি বলেন, এই আন্তর্জাতিক বিচ্ছিন্নতার কারণে রাশিয়ান জিমন্যাস্টিকস আরও শক্তিশালী হবে। 'এসব থেকে আমরা কেবল জিতব,' বলেন এ অ্যাথলেট।
আগামী মে মাসে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাৎসি জার্মানির বিরুদ্ধে জয়লাভ উদযাপন করবে রাশিয়া। রাশিয়ান বিশ্লেষকেরা বলছেন, ওই দিন ইউক্রেনে সামরিক বিজয়লাভের ঘোষণা দিতে পারেন পুতিন।
পুতিনের দুই প্রাপ্তবয়স্ক কন্যার প্রতি ইতোমধ্যে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। কাবায়েভার বিরুদ্ধে একই পদক্ষেপ নিলে তা ইউক্রেনের জন্য শান্তি-আলোচনা আরও জটিল করে তুলবে বলে মার্কিন কর্মকর্তারা মনে করেন।
এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা প্যাকেজ তৈরি করার জন্য মার্কিন ট্রেজারি ও স্টেইট ডিপার্টমেন্ট বিভিন্ন গোয়েন্দা ও অন্যান্য তথ্যের ভিত্তিতে একত্রে কাজ করে। এরপর প্যাকেজগুলো ঘোষণা করার পূর্বে সেগুলো দ্য ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিল (এনএসসি) দ্বারা স্বাক্ষর করে নিতে হয়। কাবায়েভা'র ক্ষেত্রে শেষ মুহুর্তে এসে এনএসসি তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আপাতত স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
জেলে থাকা রাশিয়ার বিরোধী দলের নেতা অ্যালেক্সি নাভালনি'র একজন প্রতিনিধি মার্কিন আইনপ্রণেতাদের কাছে কাবায়েভার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তার দাবি ছিল পুতিনের ব্যক্তিগত সম্পত্তি লুকাতে সাহায্য করছেন কাবায়েভা। অবশ্য ওই প্রতিনিধি এসব দাবির কোনো প্রমাণ দিতে পারেননি।
মার্কিন ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশের সরকারি কর্মকর্তাদের বরাতে জানা যায়, সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় একটি পাঁচিলঘেরা বিলাসবহুল বাড়িতে দীর্ঘসময় অবস্থান করেছিলেন অ্যালিনা কাবায়েভা। মার্কিন কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সেখান থেকে তিনি ব্যবসায় পরিচালনা করেছেন, নিয়মিত তাকে হেলিকপ্টারে চলাচল করতে দেখা যেত।
এ মাসে ইউক্রেনের পার্লামেন্ট সুইজারল্যান্ড সরকারের কাছে এক লিখিত আবেদনে দাবি করেছিল দেশটি যেন কাবায়েভাকে নিষিদ্ধ করে এবং সেখানে থাকা তার সব রিয়াল এস্টেট জব্দ করে। তবে সুইস সরকার জানিয়েছিল, তাদের কাছে কোনো ধারণাই ছিল না কাবায়েভা দেশটিতে অবস্থান করছিলেন।
অ্যালিনা কাবায়েভার জন্ম উজবেকিস্তানে। খেলাধুলার জন্য পড়ালেখা ছেড়ে দেন কম বয়সেই। ২১ বছর বয়সেই অ্যাথেন্সে অনুষ্ঠিত ২০০৪ সালের অলিম্পিকে রিদমিক জিমন্যাস্টিকস-এ সোনাজয় করেন তিনি। জিমন্যাস্টিকস-এর খেলায় তার সিগনেচার মুভ 'কাবায়েভা' নামে পরিচিতি লাভ করে।
কাবায়েভা'র ঝুলিতে রয়েছে ২১টি ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ মেডেল, ১৪টি ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপ মেডেল, ও দুইটি অলিম্পিক মডেল।
২০০১ সালে একটি নিষিদ্ধ ঔষধ তার শরীরে পাওয়ার কারণে মাদ্রিদ ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপ মেডেল কেড়ে নেওয়া হয়। এরপর এক বছরের জন্য নিষিদ্ধ ঘোষিত হন তিনি।
২০০৮ সালে মস্কোভস্কি করেসপন্দেন্ত নামক একটি রাশিয়ান ট্যাবলয়েড পুতিন ও কাবায়েভা এনগেজড বলে খবর বের করে। সে সময় অবশ্য পুতিন বিবাহিত ছিলেন। পুতিন ওই খবরের রাগান্বিত প্রতিবাদ জানলে কয়েকদিন পর ওই ট্যাবলয়েডের মালিক প্রতিষ্ঠান এটি বন্ধ করে দেয়।
ওই সময়ই জিমন্যাস্টিকস ছেড়ে রাজনীতিতে আসেন অ্যালিনা কাবায়েভা। পুতিনের দল ইউনাইটেড রাশিয়া পার্টির আইনপ্রণেতা হিসেবে নিযুক্ত হন তিনি। তার বেতন হয় ১১ মিলিয়ন রুবল বা প্রায় এক লাখ ৪০ হাজার ডলার।
২০১৪ সালে রাশিয়ার নিউ মিডিয়া গ্রুপ (এনএমজি)-এর চেয়ারউম্যান হওয়ার জন্য পার্লামেন্টের দায়িত্ব ছাড়েন কাবায়েভা। এ গ্রুপটি রাশিয়ার সরকারপন্থী প্রধান প্রধান টেলিভিশন, রেডিও, ও নিউজসাইটের মালিক। তাকে নিয়োগ দেন এনএমজি'র মালিক ইউরি কোভালশুক। রসিয়া ব্যাংকের সবচেয়ে বড় শেয়ারধারী ব্যক্তি হচ্ছেন কোভালশুক।
যুক্তরাষ্ট্র রসিয়া ব্যাংককে নিষেধাজ্ঞা দেয়। ২০১৮ সালে কাবায়েভা'র বাৎসরিক মাইনে ছিল ১২ মিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি। গত ৬ এপ্রিল তার নাম ও ছবি ওয়েবসাইট থেকে মুছে দেয় এনএমজি।
২০১৩ সালে শেক্রেভনেভার সাথে ৩০ বছরের দাম্পত্য জীবন চোকানোর ঘোষণা দেন পুতিন। পরের বছর বিচ্ছেদের যাবতীয় কাজ শেষ হয়।
রাশিয়ার সোচিতে ২০১৪ সালে শীতকালীন অলিম্পিকে মশাল বহনকারী হিসেবে অ্যালিনা কাবায়েভা নির্বাচিত হলে তার ও পুতিনের সম্পর্ক নিয়ে বেশি বেশি সংবাদ আসতে থাকে গণমাধ্যমগুলোতে। গণমাধ্যমে জল্পনা চলছিল পুতিন ব্যক্তিগতভাবে কাবায়েভাকে নির্বাচিত করেছেন। কিন্তু পুতিন জানিয়েছিলেন ওই 'প্রক্রিয়াটিতে তিনি হস্তক্ষেপ করেননি'।
২০১৫ সালে সুইস ও ইউরোপিয়ান কর্মকর্তারা জানিয়েছিলেন, সুইজারল্যান্ডের এক ব্যয়বহুল মা ও শিশু হাসপাতালে পুতিনের সন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন কাবায়েভা। ওই সময় আটদিন পুতিনকে প্রকাশ্যে দেখা যায়নি। এ গুজব সম্পর্কে প্রেসিডেন্টের মুখপাত্র পেসকভ বলেছিলেন, এ তথ্য অবাস্তব।
আপাতত মার্কিন কর্মকর্তারা ধন্দে আছেন অ্যালিনা কাবায়েভা'র ওপর নিষেধাজ্ঞা দিলে তা পুরো ব্যাপারটিতে কীরকম প্রভাব ফেলবে তা নিয়ে। এমনকি ট্রেজারি অফিস-এর একজন কর্মকর্তা মন্তব্য করেছেন, '(কাবায়েভার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হলে) আক্রমণাত্মক জবাব দিতে পারেন পুতিন।'
সূত্র: দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল