ভারতে ভয়াল তাপদাহের নেপথ্য কারণগুলো কী?
গত মার্চের শেষ থেকেই একের পর এক সিরিজ তাপদাহের দীর্ঘ চক্রে পড়েছে প্রতিবেশী ভারত। উত্তাপের মাত্রা এতটাই ভয়াবহ যে ভারতীয় আবহাওয়া বিভাগ (আইএমডি) জানিয়েছে, উত্তরপশ্চিম ভারতে গত এপ্রিলের তাপমাত্রা ছিল ১২২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। দাবদাহ বাংলাদেশের আশেপাশের ভারতীয় রাজ্য বিহার, ঝাড়খণ্ড আর পশ্চিমবঙ্গেও হয়েছে। এপ্রিল মাসে রাজ্যগুলিতে ৪০ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রাও রেকর্ড করা হয়।
তাপপ্রবাহ কতটা সর্বব্যাপী?
আইএমডির আবহাওয়া তথ্যের রেকর্ড অনুসারে, গত ২৭ এপ্রিল নাগাদ গড় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৩৫.৭ ডিগ্রী সেলসিয়াস, গত পাঁচ বছরের এপ্রিলের তুলনায় চলতি বছরের এপ্রিলই ছিল সবচেয়ে উত্তপ্ত।
মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, পাঞ্জাব ও গুজরাটে এপ্রিলের গড় সর্বোচ্চ তাপাঙ্ক ১৯৫১ সালের পর সর্বোচ্চ রেকর্ড হয়েছে। দিল্লি, হরিয়ানা ও উত্তর প্রদেশের মতো রাজ্যের ক্ষেত্রে এটি ছিল ওই সময়ের পর থেকে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উত্তপ্ত মাস। এসব রাজ্যগুলোর বেশিরভাগের ক্ষেত্রেই তাপমাত্রা লাগাতার ৪২ ডিগ্রী সেলসিয়াসের উপরে, যা কিনা বছরের এই সময়ে সাধারণত যা হওয়া উচিত তার চেয়েও ৫-৬ ডিগ্রী বেশি।
আইএমডির সর্বশেষ আবহাওয়া ঘোষণায় বলা হয়েছে, পাঞ্জাব, উত্তরপশ্চিম রাজস্থান ও মহারাষ্ট্রের কিছু অঞ্চলে এখন তাপপ্রবাহের মতো পরিস্থিতি অব্যাহত রয়েছে। অস্বাভাবিক রকম গরমের শিকার হচ্ছে তুলনামূলক ঠাণ্ডা অঞ্চল- হিমাচল প্রদেশ। এছাড়া, মধ্যপ্রদেশ ঝাড়খণ্ড, বিহার, পশ্চিমবঙ্গ ও উড়িষ্যার কিছু এলাকায় নজিরবিহীন গরমে নাভিশ্বাস উঠছে মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীকূলের।
রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ ও উত্তরপ্রদেশের বেশিরভাগ এলাকায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্দ করা হয়েছে ৪৩-৪৬ ডিগ্রী সেলসিয়াস। একই দশা ছিল- উত্তর প্রদেশের পূর্বাঞ্চল, গুজরাটের কিছু এলাকা, উড়িষ্যার প্রত্যন্ত কিছু এলাকা এবং মধ্য মহারাষ্ট্র এবং বিহারের কিছু নির্দিষ্ট এলাকা, ঝাড়খণ্ড, পশ্চিমবঙ্গের গাঙ্গেয় সমভূমি গঠিত কিছু জেলায়। ৪০-৪৩ ডিগ্রী সেলসিয়াস ছিল হরিয়ানা-দিল্লি, পাঞ্জাব, উত্তর প্রদেশের কিছু নির্দিষ্ট এলাকা, চত্তিশগড়, মারাঠাওয়াড়া, তেলেঙ্গানা এবং রায়ালাসিমায়।
আইএমডি জানিয়েছে, আগামী সপ্তাহের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত এমন পরিস্থিতি বজায় থাকার সম্ভাবনা রয়েছে, এরপর পশ্চিম এশিয়া থেকে আসা একটি ঝড়ো মেঘমালা উত্তর ও উত্তরপশ্চিম ভারতজুড়ে নামাবে স্বস্তির বৃষ্টি।
পশ্চিম ও মধ্যভারতে এপ্রিল মাসের শেষদিকেও উষ্ণ ও শুস্ক আবহাওয়া কোনো বিরল ঘটনা নয়, তবে এই বছর তা হয়েছে ১২১ বছরের মধ্যে সবচেয়ে উষ্ণ মার্চ মাসের পর। পুরো ভারতজুড়ে মার্চের গড় তাপমাত্রা ছিল সাধারণের চেয়ে ১.৮৬ ডিগ্রী সেলসিয়াস বেশি।
তাপদাহকে কীভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়?
সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রী বা সাধারণের চেয়ে অন্তত সাড়ে ৪ ডিগ্রী বেশি হলে তাকে একটি তাপদাহ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। সাধারণের চেয়ে ৬.৪ ডিগ্রী বেশি হলে তখন সেটি প্রবল তাপদাহ হিসেবে ঘোষিত হয় বলে আইএমডি জানিয়েছে।
নিশ্চিত রেকর্ড অনুসারে, কোনো এলাকায় তাপমাত্রা সর্বোচ্চ ৪৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস হলেই তাপদাহ ঘোষণা করে আইএমডি। আর ৪৭ ডিগ্রী হলে প্রবল তাপদাহ ঘোষিত হয়।
জলবায়ু পরিবর্তন কতটা দায়ী?
বৈশ্বিক উষ্ণায়ন চক্রের কারণে উষ্ণতা পৃথিবীতে আটকে থাকছে, সূর্যালোক থেকেও অধিক উষ্ণতা শুষে পৃথিবীকে আরও উত্তপ্ত করে তুলছে গ্রিন হাউজ গ্যাস। একে বলা হচ্ছে, 'হিট ট্র্যাপ'- একারণে তাপদাহ আরও ঘন ঘন দেখা দেওয়ার মতো পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করেছেন বিজ্ঞানীরা।
এছাড়া, আকস্মিকভাবে প্রবল বৃষ্টি এবং অনেক সময় বৃষ্টিহীন সময়ের মেয়াদ বাড়বে বলে উল্লেখ করেছে জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক আন্তঃসরকার প্যানেলের (আইপিসিসি) নিজস্ব বিশ্লেষণ।
ভারতের উত্তরাঞ্চলে বৃষ্টিপাতের অভাবই খরতাপের প্রধান কারণ। সাধারণত এ সময়ের উচ্চ তাপমাত্রাকে নিয়মিত বিরতিতে দিনকয়েকের জন্য হলেও শীতল করে আনে বৃষ্টিপাত। কিন্তু, এ বছরের মার্চ ও এপ্রিলে বৃষ্টি সেভাবে হয়নি বললেই চলে।
তবে বিস্ময়কর হলো, ২০১৮ সালের পর সবচেয়ে প্রবল বর্ষণের ঘটনাও কিন্তু এপ্রিলেই হয়েছে। যদিও তার বেশিরভাগ হয়েছে দক্ষিণ ও উত্তরপূর্ব ভারতে। মূলত বিশ্বের উত্তরতম প্রান্তে তাপমাত্রার ফলে সৃষ্ট নিম্নচাপ ভারতে বৃষ্টিবাহক মেঘ বয়ে আনে, যা দ্রাঘিমাংশ অতিক্রম করে মধ্য এশিয়া হয়ে ভারতে আসে। তবে নিম্নচাপ দুর্বল হলে বৃষ্টিও কম হয়। এবছরের মার্চ ও এপ্রিলে প্রশান্ত মহাসাগরে সাধারণের চেয়ে শীতল পরিস্থিতির কারণে নিম্নচাপ কমেছে এবং তা ভারতে বৃষ্টিপাতের জন্য সহায়ক হয়নি।
ভারতে তাপদাহের কী প্রভাব পড়েছে?
অনেক বছর ধরে করা কিছু গবেষণা বলছে, প্রতি দশকেই ভারতে বাড়ছে তাপপ্রবাহের সংখ্যা। ১৯৮১-৯০ মেয়াদে যা ছিল ৪১৩টি। ২০০১-১০ সালের মধ্যে ৫৭৫ এবং ২০১১-২০ দশকে ৬০০টি।
ভারতের ১০৩টি আবহাওয়া কেন্দ্র ক্রমাগত উষ্ণ দিনের সংখ্যা ধারাবাহিকভাবে বেড়ে চলার ঘটনা রেকর্ড করেছে। পূর্ব ভারতের কিছু অংশ- তেলেঙ্গানা,উড়িষ্যা ও অন্ধ্র প্রদেশে উচ্চ তাপের সাথে বাতাসে উচ্চ পরিমাণে আদ্রতা বা জলীয়বাষ্পের উপস্থিতিও লক্ষ করা যাচ্ছে। এতে 'ওয়েট বাল্ব' তাপমাত্রার মতো ভয়াল পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে। খুব মৃদু ধরনের এ অবস্থাও জীবনধারণের জন্য অসহনীয় হয়ে ওঠে, প্রচণ্ড অস্বস্তির শিকার হয় প্রাণিকূল। এতে পানিশূন্যতা ও মৃত্যুর ঘটনাও বাড়ে।
আইএমডির বিজ্ঞানীদের এক গবেষণা অনুসারে, গত ৫০ বছরে ভারতে ১৭ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু ঘটিয়েছে তাপদাহ।