ফুটবল পাগলের দেশ ব্রাজিলে প্রথম ক্রিকেট ব্যাটের কারখানা
জায়গাটা ব্রাজিলের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে, একটি কারখানা জানালা দিয়ে চোখ বাইরে রাখলে দেখা মেলে মনোরম দৃশ্যের। সবুজে ঘেরা পর্বত মালা। সেই কারখানায় বসে পাইন কাঠ দিয়ে একের পর এক শীল্পকর্ম তৈরি করে যাচ্ছেন ৬৩ বছর বয়সী লুইজ রবার্তো ফ্রান্সিসকো। তার শিল্পকর্ম আসলে ক্রিকেট ব্যাট। যে দেশে ফুটবলের 'চাষ' হয়, সেখানে ক্রিকেট খেলাটার নামই তো অজানা। ক্রিকেট ব্যাট তাই শিল্পকর্মের পর্যায়েই পড়ে এখানে।
ব্রাজিল; দেশটির নাম শুনলে যে কারও মাথায় আগে ফুটবলের নাম আসবে। অনেক আগে থেকেই ফুটবল আর ব্রাজিল মিলেমিশে একাকার। পাঁচবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নদের ফুটবলেই নাওয়া খাওয়া। পেলে থেকে শুরু করে কার্লোস দুঙ্গা, রোনালদো, রোনালদিনহো, কাকা, নেইমারদের ফুটবলে বুদ হয়ে থেকেছে গোটা দুনিয়া। ফুটবল পাগল ব্রাজিলেই ক্রিকেট ব্যাটের কারখানার গর্বিত মালিক হয়েছেন ফ্রান্সিসকো। এটাই ব্রাজিলে ক্রিকেট ব্যাট তৈরির প্রথম কারখানা, যার নাম রয়্যাল ব্যাটস।
১ লাখ ৭০ হাজার জনসংখ্যার ছোট্ট শহর পোকোস দে কালদাসে ফ্রান্সিসকোর ক্রিকেট ব্যাট তৈরির কারখানা। অথচ এই কাজ শুরুর আগে ক্রিকেট ব্যাট কখনও ধরেও দেখেননি তিনি, তাই ব্যাট সম্পর্কে কোনো ধারণাও ছিল না ফ্রান্সিসেকোর। ইউটিউব দেখে নিজে নিজেই ব্যাট বানানো শেখেন তিনি। তবে কী ধরনের কাঠ দিয়ে ব্যাট তৈরি করা হয়, তা নিয়ে চিন্তার শেষ ছিল না ফ্রানসিস্কোর।
বারবার পরীক্ষা চালিয়ে তিনি নিশ্চিত হন, ব্যাট তৈরির জন্য পাইন গাছের কাঠ সবচেয়ে ভালো। সময়ের সাথে সাথে তিনি বুঝতে পারেন কাঠের উপর ২ টন পরিমাণের চাপ প্রয়োগ করলে তা ক্রিকেট ব্যাটের জন্য প্রয়োজনীয় ঘনত্ব তৈরী করে। এরপর শুরু হয় ফুটবলের দেশে ক্রিকেট ব্যাট তৈরির কাজ। শুরুটা অল্প পরিসরে হলেও সেটা এখন রূপ নিয়েছে কারখানায়।
পাঁচবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নদের দেশে প্রথম ক্রিকেট ব্যাটের কারখানা গড়ে তোলার নেপথ্যে আরেকটি নাম বড় করে, ম্যাট ফেদারস্টোন। ইংল্যান্ডে জন্ম নেওয়া সাবেক এই ক্রিকেটার ইংলিশ ঘরোয়া ক্রিকেট খেলেছেন। স্বপ্ন না ছুঁতে পারলেও ক্রিকেটেই বসবাস তার। তাই দেশ ছেড়ে ব্রাজিলে গিয়েও ক্রিকেট ছেড়ে থাকতে পারেননি তিনি। একটা সময়ে ব্রাজিল জাতীয় ক্রিকেট দলের অধিনায়কত্ব করা ফেদারস্টোনই ব্রাজিল ক্রিকেট কনফেডারেশনের (সিবিসি) চেয়ারম্যান।
ফুটবলের দেশে ক্রিকেটকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কঠিন কাজটি ৫১ বছর বয়সী ফেদারস্টোনের কাঁধে। খেলা ছাড়ার পর ২০০০ সালে স্ত্রীকে নিয়ে ব্রাজিলে পাড়ি জমান তিনি। বোর্ডপ্রধান হিসেবে সাবেক এই ইংলিশ ক্রিকেটারের লক্ষ্য, আগামী তিন বছরের মধ্যে ব্রাজিল থেকে অন্তত ৩০ হাজার ক্রিকেটার বের করা। মাত্র ১৯ জন স্টাফ নিয়ে ব্রাজিলে ক্রিকেট ছড়িয়ে দেওয়ার চ্যালেঞ্জ নেওয়া ফেদারস্টোনের চেষ্টাতেই ব্রাজিলে এখন ক্রিকেটারের সংখ্যা ৫ হাজারেরও বেশি।
করোনাভাইরাস চলাকালীন সব কিছু স্থবির হয়ে পড়ে। ক্রিকেটকে জনপ্রিয় করতে সবার আগে যে জিনিসটার দরকার, সেই ক্রিকেট ব্যাটের খরায় পড়ে যায় ব্রাজিল। ক্রিকেট ব্যাট তৈরি করতে পারেন এমন একজনের খোঁজ শুরু করেন ফেদারস্টোন। এ সময় লুইজ রবার্তো ফ্রান্সিসকো পেয়ে যান তিনি।
অ্যালুমিনিয়াম প্লান্টে এক সময় ইলেকট্রিশিয়ানের কাজ করা ফ্রান্সিসকো বলেন, 'সে (ফেদারস্টোন) জানায়, ক্রিকেট ব্যাট তৈরি করতে পারেন, এমন কাউকে খুঁজছেন তিনি। সে জানতে চায় আমি কাজটা করতে পারব কিনা। আমি তার প্রস্তাব গ্রহণ করি।' এরপর শুরু হয় ব্যাট তৈরির কার্যক্রম। একটি দুটি করে বানাতে বানাতে এখন ব্যাটের কারখানাই গড়ে ফেলেছেন ফ্রান্সিসকো।
কাঠ কেটে কীভাবে ব্যাট তৈরি করা হয়, ইউটিউব দেশে শিখেছেন ফ্রান্সিসকো। ব্যাটের সুইট পয়েন্টে ঘনত্ব ঠিক রাখতে কীভাবে আঁশগুলোর ওপর চাপ দিতে হয় সেটাও ইউটিউব থেকে শেখা তার। যদিও শুরুতে ক্রিকেট ব্যাট তৈরি করার কোনো যন্ত্র তখন তার কাছে। নিজেই বানিয়ে ফেলেন যন্ত্র। তার ভাষায়, 'এই কাজ করতে ব্রাজিলে তখন কোনো যন্ত্র ছিল না। আমি অনেক কিছু চেষ্টা করে দেখার পর নিজেই এমন একটি যন্ত্র বানাই।'
শুরুতে কাঠ বাছাইও নিয়েও বিপাকে পড়তে হয়। দীর্ঘ দিন ধরে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ক্রিকেট ব্রাজিল (সিবিসি) ও ফ্রান্সিসকো পাইন কাঠ বেছে নেন। ফ্রান্সিসকো এখন পুরোদস্তর কাঠমিস্ত্রী, ব্যাট তৈরিতে তিনি সিদ্ধহস্ত। তার বানানো ব্যাটের একেকটির মূল্য ২০ ডলার। যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ১৮৪৬ টাকা। ব্রাজিলে ক্রিকেট প্রসার পাচ্ছে, ফ্রান্সিসকোও বাড়াচ্ছেন তার কাজের ব্যাপ্তি। ক্রিকেট ব্যাটের পাশাপাশি স্টাম্পও বানান তিনি। এ ছাড়া মাঠে দর্শকদের বসার উপযোগি চেয়ারও বানান তিনি।