আফ্রিকায় খুঁজে পাওয়া সবচেয়ে প্রাচীন মরদেহটি একটি শিশুর
আফ্রিকায় এখন পর্যন্ত পাওয়া সবচেয়ে প্রাচীন মরদেহ ভাবা হচ্ছে সম্প্রতি পূর্ব কেনিয়ায় আবিষ্কৃত একটি শিশুর মরদেহকে। শিশুটিকে মাথার নিচে বালিশ দিয়ে শায়িত অবস্থায় পাওয়া যায়।
ধারণা করা হচ্ছে, আড়াই থেকে তিন বছর বয়সী এই শিশুটিকে ৭৮ হাজার বছর আগে কবর দেয়া হয়। উত্তর কেনিয়ার পাঙ্গা ইয়া সাইদি গুহার মুখে তাকে পাওয়া যায় বলে। বুধবার 'ন্যাচার' জার্নালের নতুন এক গবেষণায় এই তথ্য উঠে আসে।
গুহার পলিমাটি ও মৃতদেহের হাড় পরীক্ষা করে গবেষকরা মনে করছেন যে শিশুটিকে ইচ্ছা করেই কবর দেয়া হয়েছিল। খুব সম্ভবত একটি গোষ্ঠীর শেষকৃত্যের রীতিনীতির সঙ্গে এই কবর দেয়া জড়িত। গবেষকদের মতে, এটি তৎকালীন সময়ের মানুষের প্রতীকী চিন্তাভাবনা ও জটিল মনস্তত্ত্বের প্রমাণ দেয়।
টিকে থাকা হাড়ের টুকরাগুলো সাজানো অবস্থা দেখে বোঝা যায় যে শিশুটিকে বাম পাশে আলতোভাবে শুইয়ে দেয়া হয়েছিল এবং পা ভাঁজ করে বুকের উপর রাখা ছিল।
গবেষকরা এও মনে করেন যে শিশুটির ছোট্ট শরীরকে একটি আবরণ দিয়ে আচ্ছাদিত করে দেয়া হয়েছিল, যা কোনো পশুর চামড়ার আবরণ হতে পারে। সেই সাথে মাথার অবস্থান ঠিক রাখতে বালিশ জাতীয় একটি জিনিস দেয়া হয়েছিল মাথার নিচে।
স্পেনের বুর্গোসের ন্যাশনাল রিসার্চ সেন্টার অন হিউম্যান এভোল্যুশন-এর পরিচালক মারিয়া মারতিনন-টরেস বলেন, 'যেসব কবরে মাথার নিচে বালিশ দেয়া হয় সেখানেই এই ধরনের অঙ্গভঙ্গি দেখা যায়। মাথার নিচের বালিশ সরে গেলেই মাধ্যাকর্ষণের কারণে মাথা কাত হয়ে পড়ে।'
সংবাদ সম্মেলনে মারিয়া আরো বলেন, 'শিশুটির মাথার নিচে যত্ন করে বালিশ দেয়া, মূলত তাকে দেয়া সম্মান থেকে অনুমান করতে পারি যে আফ্রিকায় একদম শুরুর দিকে মানুষ শারীরিক ও প্রতীকী জগতে নিবিষ্ট থাকত।'
এই আবিষ্কারের গুরুত্ব কী
৪০ হাজার বছর আগে নিয়ানডারথাল, আর্কাইক মানবজাতি হারিয়ে যায় এবং হোমো স্যাপিয়েন্সদের ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যে পাওয়া যায় ১ লাখ ২০ হাজার বছর আগে, সেখানে এই শিশুর কঙ্কাল থেকে বুঝা যায় যে, এটিই আফ্রিকায় ইচ্ছাকৃত কবর দেয়ার সবচেয়ে পুরনো প্রমাণ।
এই মহাদেশে কেন খুব কম সংখ্যক কবর পাওয়া গেছে তার কারণ এখনো জানা যায়নি। মাঠপর্যায়ে কাজের অভাব কিংবা প্রাচীনকালে বিভিন্নরকম সমাধি প্রক্রিয়ার বৈচিত্র্যের কারণেও এরকম হতে পারে।
'প্রত্নতত্ত্ববিদরা বিগত ১৫০ বছর ধরে পূর্বে ও ইউরোপে টানা খননকাজ চালিয়ে যাচ্ছে। একই পরিমাণ কাজ যদি আফ্রিকায় হত, তাহলে হয়তো আমরা আরো প্রাচীন কবরের সন্ধান পেতাম', বললেন গবেষণার সহলেখক ও ম্যাক্স প্লাংক ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মাইকেল পেট্রাগ্লিয়া।
শিশুটির দেহের কিছু হাড় প্রথম পাওয়া যায় ২০১৩ সালে পাঙ্গা ইয়া সাইদিতে। কিন্তু ২০১৭ এর আগপর্যন্ত পুরো কঙ্কাল পাওয়া যায়নি। পরে এটির ডাকনাম দেয়া হয় 'তোতো' (Mtoto) , সোয়াহিলি ভাষায় যার অর্থ হলো 'শিশু'।
গবেষণার আরেক সহলেখক ইমানুয়েল দিয়েমা জানান, 'আমরা এখনো পুরোপুরি জানিনা যে আমরা কতখানি কি খুঁজে পেয়েছি। হাড়গুলো খুবই নমনীয় ছিল বলে মাঠপর্যায়েই তা গবেষণা করা সম্ভব হয়নি। তবে আমরা এটিকে পরীক্ষা করতে খুবই আগ্রহী।'
প্রত্নতত্ত্বের 'বিতর্কিত অংশ'
লন্ডনের ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামের মানব বিবর্তন গবেষণা সেন্টারে মানবজাতির উৎপত্তি নিয়ে গবেষণা করেন লুইস হামফ্রে। হামফ্রে জানান, শিশুর কবর থেকে যে প্রতীকী আচরণের চিহ্ন পাওয়া গেছে তা প্রত্নতত্ত্বের একটি 'বিতর্কিত ক্ষেত্র'। তবে শিশুটিকে কবর দেয়ায় যে যত্ন প্রকাশ পেয়েছে এ ব্যাপারে তিনি একমত।
হামফ্রে বলেন, 'এমন কাজের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত আছে সতর্কের সাথে কবর দেয়া যাতে তাদের ইচ্ছামত একটি শারীরিক অবস্থা পাওয়া যায়। দেহ আচ্ছাদিত করার কারণ হতে পারে দেহের সাথে কোনো মূল্যবান জিনিস দিয়ে দেয়া হয়েছিল। মৃতদেহকে কিভাবে রাখা হচ্ছে তার থেকে সামাজিক সংস্থা, প্রতীকী আচরণ, সম্পদ ও প্রযুক্তির কথা বোঝা সম্ভব।'
গবেষকরা সম্মত হয়েছেন যে শিশুটির দেহ হুট করেই গুহায় এসে উপস্থিত হয়নি। গুহার খননকাজে নানা রংয়ের পলিমাটি ও মাটির ধরন দেখে বোঝা যায় যে এটি ইচ্ছাকৃত কবর ছিল। শিশুটির দেহের হাড়ের মাইক্রোস্কোপিক ফিচার ও হাড়ে লেগে থাকা মাটির কেমিক্যাল কম্পোজিশন দেখে গবেষকরা ধারণা করছেন যে কবর দেয়ার সময় দেহটি 'সজীব' ছিল, যা পরে মাটিতে পচে মিশে যায়।
- সূত্র- সিএনএন