উসাইন বোল্টের চেয়েও জোরে দৌড়াতে পারে আপনার বাসার বিড়াল
টোকিও অলিম্পিকে ১০০ মিটার স্প্রিন্টে স্বর্ণ জিতেছেন ইতালিয়ান দৌড়বিদ মার্সেল জ্যাকবস। শতমিটার দৌড়াতে তিনি সময় নিয়েছেন ৯.৮০ সেকেন্ড। ১০০ মিটারের নারী এককে স্বর্ণ জিতেছেন জামাইকান অ্যাথলেট ইলেইন থম্পসন-হেরাহ। তিনি সময় নিয়েছেন ১০.৬১ সেকেন্ড।
কিন্তু কিংবদন্তি জামাইকান স্প্রিন্টার উসাইন বোল্টের রেকর্ডের ধারেকাছেও ছিলেন না এদের কেউ। অলিম্পিকের আটবার স্বর্ণপদক জেতা বোল্টের ৯.৫৮ সেকেন্ডের বিশ্ব রেকর্ড এখনো ভাঙতে পারেনি কেউ। মজার ব্যাপার হচ্ছে, বোল্টের ঘণ্টাপ্রতি ২৭ মাইল দৌড়ানোর গতিও একটি গৃহপালিত বিড়ালের সর্বোচ্চ গতির চেয়ে কম।
বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুতগতির প্রাণী হচ্ছে চিতাবাঘ। চিতাদের সাথে দৌড়ে বোল্টও কোন কূল কিনারা করতে পারবেন না।
আপনি ভাবতে পারেন, একটি প্রাণী কত দ্রুত দৌড়াবে সেটা নির্ভর করে পেশির আকারের উপর। পেশি যত বড়, সামর্থ্য তত বেশি, গতিও তত বেশি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এটা সঠিক হলেও, একটি হাতি কিন্তু কখনোই একটি হরিণের চেয়ে বেশি জোরে দৌড়াতে পারবে না। তাহলে সর্বোচ্চ গতির ব্যাপারটা কীভাবে নির্ণয় করা যায়?
সম্প্রতি জার্মান বায়োকেমিস্ট মিখাইল গুন্টারের অধীনে বিজ্ঞানীদের একটি দল নির্ণয় করার চেষ্টা করেছে প্রাণিজগতে সর্বোচ্চ গতির নির্ণায়ক কী। 'জার্নাল অব থিওরেটিকাল কিংডম' নামক একটি জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে তাদের গবেষণা প্রবন্ধ।
সেখানে প্রাণীর আকার, তাদের পায়ের আকার, পেশীর ঘনত্ব ও এরকম আরও জৈবিক নির্ণায়ককে নিয়ে একটি মডেল তৈরি করার হয়েছে।
এই গবেষণায় বহুপদী প্রাণীদের জৈবিক বিবর্তন এবং বিবর্তনের ফলে রূপ নেয়া তাদের হাঁটার ধরণের উপর আলোকপাত করা হয়েছে।
গুন্টার বলেন, 'বিবর্তনের কারণ অনুসন্ধান করার চেষ্টা করেছি আমরা। এবং অনুসন্ধান করার চেষ্টা করেছি, বিবর্তনের ফলে প্রাণীর শরীর কেন ও কীভাবে প্রভাবিত হয়। যান্ত্রিকভাবে বললে, গতির মতো বিবর্তনবাদী প্রয়োজন প্রাণীর শরীরের গঠনকে কীভাবে বদলে দিয়েছে সেই প্রশ্নটিও রাখা হয়েছে এখানে।'
এই বিষয়ে সর্বশেষ গবেষণাটি করেছিলেন আরেক জার্মান বিজ্ঞানী মায়রিয়াম হার্ট। তার দল গবেষণায় দেখিয়েছে, প্রাণীর মেটাবলিজম বা বিপাকের উপরই নির্ভর করে গতির সক্ষমতা। বিপাকের মাধ্যমে প্রাণীদেহ খাবার থেকে জ্বালানি বা শক্তি উৎপাদন করে, যেই শক্তির একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ যায় শরীরের পেশিগুলোয়। সেই শক্তিকে ব্যবহার করেই দৌড়ানোর ক্ষমতা প্রায় প্রাণীদেহ।
হার্টের দল দেখিয়েছে ছোট প্রাণীদের তুলনায় বড় প্রাণীদের জ্বালানি দ্রুত শেষ হয়ে যায়। কেননা ভারী দেহকে নড়াতে বেশি শক্তি ক্ষয় করতে হয় তাদের।
গুন্টার এবং তার দল অবশ্য এই গবেষণার সাথে একমত না। তারা ভিন্ন একটি ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করেছেন। সেই মর্মে শরীরের ধরণ, দৌড়ানোর জ্যামিতি ও শরীরে ভিন্নধর্মী শক্তিদের ভারসাম্য রাখা সংক্রান্ত ৪০টিরও বেশি পরিমিতি নিয়ে একটি বায়োমেকানিকাল মডেল তৈরি করেছেন তারা।
এই গবেষণা প্রবন্ধের সহ-লেখক রবার্ট রকারফেলার বলেন, প্রাণীদের গতি সঞ্চার বাধাগ্রস্ত হয় দুটি কারণে। প্রথমটি হচ্ছে বাতাসের টান। পা সামনে আগানোর চেষ্টা করার সময় যেই শক্তি গতিকে বাধাগ্রস্ত করে সেটি। এই বাতাসের টান প্রাণীর ভর বাড়ার সাথে সাথে বেড়ে যায় না। এই সূত্র অনুযায়ী যেই প্রাণীর ভর বেশি সেই প্রাণীর গতিও বেশি হবে।
দ্বিতীয় প্রতিবন্ধকটি আবার প্রাণীর ভর বাড়ার সাথে সাথে বাড়ে। এই প্রতিবন্ধকের নাম জড়তা। স্থিতি অবস্থা থেকে গতিশীল অবস্থায় যেতে যেই শক্তিটি আমাদের বাধাগ্রস্ত করে, সেটিই জড়তা। যেহেতু বড় প্রাণীদের বেশি ভরকে সাথে নিয়ে সামনে এগুতে হয়, তাই তাদের জন্য জড়তাকে উপেক্ষা করা কঠিন। এই ক্ষেত্রে তাই ছোট প্রাণীরা গাণিতিক সুবিধাটা পায়।
এই দলের গবেষণা অনুযায়ী বাতাসের টান ও জড়তা উভয়কে উপেক্ষা করার জন্য সবচেয়ে যথার্থ ভর হচ্ছে ১১০ পাউন্ড। চিতাবাঘের গড় ওজনও এমনই।
বিভিন্ন প্রাণী ১০০ কেজি ওজন ধারণ করলে কেমন গতিতে দৌড়াবে সেটিও নির্ণয় করার চেষ্টা করেছে গুন্টারের গবেষণা দল। এমন ওজনের গৃহপালিত বিড়াল দৌড়াতে পারবে ঘণ্টায় ৪৬ মাইল গতিতে। এই ওজনের একটি মাকড়শা দৌড়াতে পারবে ঘণ্টপ্রতি ৩৫ মাইল গতিতে। এই দৌড়ে মানুষ থাকবে সবার পিছনে। এমন ওজনের একজন গড়পড়তা মানুষ দৌড়াতে পারবে ঘণ্টাপ্রতি সর্বোচ্চ ২৪ মাইল গতিতে।
গতির সুচাগ্রতার জন্য শরীরের আকারই একমাত্র নির্ণায়ক না। পায়ের দৈর্ঘ্যের উপরও নির্ভর করে গতি। যেসব প্রাণীর পা লম্বা তারা তাদের শরীরকে দ্রুত সামনে নিয়ে যেতে পারে।
চারপায়ী প্রাণীরা কেন মানুষের চেয়ে দ্রুত দৌড়ায় এই ব্যাপারে গুন্টার বলেন, 'আমাদের পা মাত্র দুইটি, এজন্য না কিন্তু। আমাদের শরীর মাটির সাথে লম্বালম্বি অবস্থায় থাকে, যে কারণে মধ্যাকর্ষণের পূর্ণ বলই আমাদের নিচের দিকে টানে। দ্বিপদ প্রাণীরা বিবর্তিত হয়ে শক্ত মেরুদণ্ডের অধিকারী হয়েছে। এবং এই প্রক্রিয়ায় তারা গতির থেকে স্থিতিকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে।'
যেসব প্রাণীর ধড় মাটির সাথে সমান্তরালে থাকে তাদের মেরুদণ্ড আরও নমনীয় হয়। যে কারণে মাটিতে পা রেখে চলাচলের সর্বোচ্চ ব্যবহারটা করতে পেরেছে তারা।
শক্তি বা জ্বালানি ফুরিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটি সম্পূর্ণ খারিজ করে দিয়েছে গুন্টারের দল। তাদের বিশ্লেষণে দেখানো হয়েছে, শক্তি শেষ হওয়ার আগে যেকোনো প্রাণী তার সর্বোচ্চ গতির অন্তত ৯০ শতাংশ ব্যবহার করতে পারে।
তাত্ত্বিকভাবে এই গবেষণা বেশ সাড়া ফেলে দিলেও এখনো প্রাণীদের নিয়ে গবেষণাগারে পরীক্ষা চালাননি তারা। গুন্টার ও রকারফেলার দুইজনই এ ব্যাপারে একমত যে, এই গবেষণার উপসংহার টানতে হলে তাদের পরীক্ষা চালাতে হবে। সেক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রাণী ধরে এনে গবেষণাগারে তাদের গতি পরিমাপ করতে হবে তাদের।
উসাইন বোল্টের রেকর্ড কি আদৌ কেউ কখনো ভাঙতে পারবে? হয়তো পারবে, হয়তো পারবে না। দৌড়ের বায়োমেকানিক্স বলছে, আমাদের শারীরিক ক্ষমতা প্রায় শিখরে পৌঁছে গিয়েছে। কেউ বোল্টের রেকর্ড ভাঙলেও তার সেই রেকর্ড মানবসমাজের জন্যই থাকবে। কেননা, প্রাণীজগতে সেই রেকর্ড তেমন কিছুই না।
- সূত্র: ওয়্যারড