লম্বা সময় বাড়ির বাইরে? আপনার হয়ে গাছে পানি দেবে এই বাংলাদেশি ‘ওয়াটারিং ডিভাইস’
তিন সপ্তাহের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছিলেন জুবায়ের হোসেন এবং তার স্ত্রী সুমাইয়া তাসনীম। ফিরে এসে দেখেন, পানির অভাবে মারা গেছে তাদের প্রিয় বাগানের প্রায় সব গাছ! বিষয়টি খুবই মর্মাহত করে তাদের।
কাজের উদ্দেশ্যে বাড়ির বাইরে থাকলেও কীভাবে গাছে পানি দেওয়া যায়, এমন এক প্রযুক্তির কথা তখন থেকেই ভাবতে থাকেন এ ইঞ্জিনিয়ার দম্পতি। শেষে নিজেদের প্রয়োজন মেটাতে তৈরি করে ফেলেন একটি যন্ত্র, যা গাছে পানি দেওয়ার প্রায় সব মুশকিল-আসান!
তাদের তৈরি এ ডিভাইসের ভিডিও ফেসবুকে দিতেই দারুণ সাড়া পড়ে যায় বাগানপ্রেমীদের মধ্যে। এরপর সাধারণের কথা মাথায় রেখে বছরখানেক নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর অবশেষে ডিভাইসটি বাজারজাত করেছেন তারা।
বঙ্গটেক নামে তাদের প্রতিষ্ঠান থেকে তৈরি এ ডিভাইসের নাম দিয়েছেন 'স্মার্ট ওয়াটারিং ডিভাইস'। এক মাসের মধ্যে দেশের নানা প্রান্ত তো বটেই, দেশের বাইরে থেকেও অসংখ্য অর্ডার পাচ্ছেন তারা।
শুরুটা হয়েছিল নিজেদের সমস্যা সমাধান করার মধ্যে দিয়ে। বঙ্গটেক-এর চিফ অপারেটিং অফিসার সুমাইয়া তাসনীম জানালেন, এখন দেশ ও দেশের বাইরের অনেকের সমস্যাই সমাধান করে দিচ্ছে তাদের এ ডিভাইস।
"নভেম্বরের ২০ তারিখ [২০২৪] আমাদের প্রডাক্ট বাজারে এসেছে। কিন্তু এর আগে বছরখানেক কাজ করতে হয়েছে। মানুষের হাতে একটি ফাইন-টিউনিং প্রডাক্ট আমরা দিতে চেয়েছি। এখন আলহামদুলিল্লাহ ভালো সাড়া পাচ্ছি।"
যেভাবে কাজ করে এ যন্ত্র
ধরুন কাজের উদ্দেশ্যে কিংবা ভ্রমণের জন্য কোথাও যেতে হচ্ছে আপনাকে। এদিকে শখের গাছগুলো তো বাড়িতে! নিয়ম করে পানি কে দেবে? অথবা ছাদবাগানের গাছগুলোতে নিয়মিত পানি দেওয়া ঝামেলা মনে হয়? এসব ক্ষেত্রে আপনার সহযোগী হতে পারে এ যন্ত্রটি। আপনার বাগানে পানি দেওয়ার সমস্ত দায়িত্ব নিজের করে নেবে এটি।
যন্ত্রটিতে প্রাথমিকভাবে দরকার হয় পানি ও বিদ্যুৎ সংযোগের। পানির জন্য ইনপুট ও আউটপুট লাইন রয়েছে যন্ত্রে। আউটপুট লাইনের পাইপ দিয়ে একাধিক গাছে সংযোগ দেওয়া যায়। নির্দিষ্ট গাছে পানির পরিমাণ যেমন বাড়ানো-কমানো যায়, পানির গতিও ঠিক করে দেওয়া যায় ইচ্ছেমতো।
যন্ত্রটি মূলত পরিচালিত হয় একটি সফটওয়্যার দিয়ে, যার নাম 'স্মার্ট ওয়াটারিং সিস্টেম'। জুবায়ের হোসেন জানালেন, বিনামূল্যের এ একটি অ্যাপ্লিকেশন দিয়েই নিয়ন্ত্রণ করা যায় যন্ত্রটির সবকিছু।
প্রথমত, এ ডিভাইসটি দিয়ে গাছে পানি দেওয়ার দিনক্ষণ বা সিডিউল ঠিক করে দেওয়া যায়। এটি হতে পারে প্রতিদিন, প্রতি সপ্তাহ কিংবা তিন দিনে একবার।
যেভাবে ইচ্ছা, যতক্ষণের জন্য ইচ্ছা সময় নির্ধারণ করে দিলেই যন্ত্রটি নিজ দায়িত্বে পানি দিয়ে দেবে গাছে। ফলে আপনি পৃথিবীর যে প্রান্তে থাকুন না কেন, গাছে পানি দেওয়া বন্ধ থাকবে না। বাড়ির যেকোনো পানির উৎসের সংযোগ পেলেই বাগানে পানি দেওয়ার সব দায়িত্ব এ যন্ত্রের, বললেন জুবায়ের।
সিডিউল করা ছাড়াও যন্ত্রটিতে ওয়াইফাই সংযুক্ত থাকলে অ্যাপ্লিকেশন ব্যবহার করে যখন ইচ্ছা পানি দেওয়া যায়। এছাড়া অল্প দূরত্বের জন্য রয়েছে ব্লুটুথ প্রযুক্তি।
জুবায়ের হোসেন জানালেন, তাদের অ্যাপ্লিকেশনটি ব্যবহার করার জন্য ব্যবহারকারীকে কোনোরকম অর্থ খরচ করতে হয় না। অত্যন্ত শক্তিশালী একটি সার্ভার ব্যবহার করে এটি তৈরি করেছেন তিনি, যাতে মানুষ দীর্ঘমেয়াদি সেবা পেতে পারেন।
দেশে তৈরি দেশি পণ্য
একই ধরনের যন্ত্র বিদেশে পাওয়া গেলেও এত বেশি ফিচার নিয়ে দেশে তৈরি প্রথম পণ্য এ স্মার্ট ওয়াটারিং ডিভাইস, জানালেন সুমাইয়া তাসনীম।
তার মতে, এ ধরনের যন্ত্র বাণিজ্যিকভাবে বাংলাদেশে তারাই প্রথম তৈরি করেছেন। বিদেশে যে পণ্যগুলো পাওয়া যায়, সেগুলোর দামও যেমন বেশি, তেমনি নেই এত বেশি ফিচারও। সে তুলনায় দেশে তৈরি এ ডিভাইসটি নিয়ে আশাবাদী তারা।
"আমরা চেষ্টা করেছি যাতে একটা সুন্দর জিনিস মানুষের হাতে পৌঁছানো যায়। ডিভাইসের ডিজাইন, আউটার—সবকিছু আমরা বাংলাদেশেই করেছি। আমরা চেষ্টা করেছি 'মেড ইন বাংলাদেশ' বলে যাতে সস্তা মনে না হয়," বললেন জুবায়ের।
তিনি আরও জানান, গাছের মধ্যে কানেকশন দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় যেসব সরঞ্জাম লাগবে, সেগুলো তাদের ওয়েবসাইটেই পাওয়া যাবে। "এতে করে গ্রাহকদের আর কষ্ট করে অন্য কোথাও খোঁজার প্রয়োজন পড়বে না।"
অ্যাপ্লিকেশনটির বিষয়ে জুবায়ের বলেন, "ইউজারের সঙ্গে বছরভর ব্যবসা করার ইচ্ছা আমাদের নেই। আমরা চাচ্ছি, ইউজারদের বেটার ফিল দিতে।"
মিলছে দারুণ সাড়া
"ডিভাইসটি ব্যবহারের পর আমার ছাদবাগান এখন আরও সবুজ আর সতেজ থাকে। প্রতিদিন সকালে বাগানে গিয়ে দেখি, গাছগুলো যেন আরও প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে। আগে পানি দিতে ভুল হয়ে গেলে গাছগুলো ক্লান্ত দেখাত। এখন আর সে সমস্যা নেই।
সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো একবার সিডিউল করে রাখলে আর কোনো চিন্তা করতে হয় না। এটি এমন একটি ডিভাইস, যা আপনার গাছের পানি দেওয়ার দায়িত্ব পুরোপুরি নিজের হাতে তুলে নেয়," নিজের ব্যক্তিগত ব্লগে এমনটাই লিখেছেন গাজীপুরের কাপাসিয়ার বাসিন্দা সাজেদুল হক।
সাজেদুলের বাগানে প্রায় ৫০টির মতো গাছ রয়েছে। তিনি বলেন, "ভ্রমণ করতে পছন্দ করি বলে এমনই একটি প্রযুক্তি খুঁজছিলাম। বাসায় থাকলে পানি দেওয়া নিয়ে তেমন সমস্যা হতো না। তবে বেড়াতে গেলে বা ঘুরতে গেলে গাছের পানি দেওয়া মিস হতো। এ ডিভাইসটি ব্যবহারের পর গাছে পানি দেওয়ার কাজটা অনেক সহজ হয়ে গেছে।"
জুবায়ের-সুমাইয়া দম্পতি জানান, সাজেদুলের মতো আরও অনেকেই তাদের যন্ত্রটি ব্যবহার করে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন। ইতোমধ্যে দেশের বাইরেও অনেকে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। কেউ নিজেদের জন্য, আবার কেউ এ ডিভাইস নিয়ে বিদেশে ব্যবসা করতে আগ্রহী।
সুমাইয়া বলেন, "আমরা দেশের বাইরে থেকেই বেশি সাড়া পাচ্ছি। আমাদের দেশে যেমন কাজের লোক পাওয়া যায়, কিন্তু বাইরের দেশে গাছের পানি দেওয়ার জন্য লোক রাখা বিলাসিতা! এজন্য বাইরের দেশে চাহিদা অনেক বেশি।"
জুবায়ের যোগ করেন, "দেশে অনলাইনে বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, কানাডাসহ কয়েকটি দেশে স্যাম্পল পাঠানো হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে এ ডিভাইসের চাহিদা বেশি।"
যেভাবে পাওয়া যাবে
বঙ্গটেক-এর ওয়েবসাইট থেকে খুব সহজেই ডিভাইসটি অর্ডার করা যাবে। এর দুটি সংস্করণ রয়েছে—একটি প্রফেশনাল, অন্যটি লাইট। প্রফেশনাল ভার্সনটি ওয়াইফাই এবং ব্লুটুথ দিয়ে পরিচালিত হয়। লাইট ভার্সনটি শুধু ব্লুটুথে কাজ করে।
লাইট ভার্সনের দাম পাঁচ হাজার টাকা। আর প্রফেশনাল ভার্সনটি সাত হাজার টাকায় পাওয়া যাবে।
জুবায়ের জানান, "ইতোমধ্যে বিদেশি ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে আমরা ডিভাইস রপ্তানি শুরু করেছি। ভবিষ্যতে নিজেরাই সরবরাহ করার পরিকল্পনা রয়েছে। দেশের চাহিদা মিটিয়ে আমাদের এ পণ্যটি বিদেশে বাংলাদেশের পণ্য হিসেবে পরিচিতি পাবে, এটাই আমাদের প্রত্যাশা।"
ছবি: জুনায়েত রাসেল/টিবিএস