শীর্ষ ঋণগ্রহীতা বেক্সিমকো, এস আলম এখন শীর্ষ খেলাপি—এক ডজনের বেশি ব্যাংককে ঝুঁকিতে ফেলেছে
দেশের শীর্ষ ঋণগ্রহীতা বেক্সিমকো ও এস আলম – শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর থেকে শীর্ষ খেলাপি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এতে এক ডজনের বেশি ঋণ প্রদানকারী পড়েছে গভীর সংকটে, ব্যাংকখাতের স্থিতিশীলতার জন্য যা ব্যাপক ঝুঁকিও তৈরি করেছে।
গত বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত, খেলাপি তালিকায় শীর্ষে ছিল বেক্সিমকো। এই খেলাপির মোট পরিমাণ ছিল ২৩ হাজার ১২০ কোটি টাকা। অন্যদিকে, এস আলম গ্রুপ ১১ হাজার ৭৩৪ কোটি টাকার খেলাপি নিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল। বাংলাদেশ ব্যাংকের করা শীর্ষ ১০ খেলাপির একটি তালিকায় এ তথ্য দেওয়া হয়েছে, যা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডও দেখেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুসারে, শীর্ষ ১০ ঋণখেলাপির মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৫১ হাজার ৮৫৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে সম্মিলিতভাবে বিতর্কিত এ দুই ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর খেলাপি ঋণ ৩৪ হাজার ৮৫৪ কোটি টাকা—যা ব্যাংকখাতের ২ লাখ ৮৪ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণের ১২ শতাংশেরও বেশি। তবে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে ব্যাংকগুলোকে তাঁরা কোনো অর্থ পরিশোধ না করায়—তাদের খেলাপির খেলাপির পরিমাণ আরও বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এমনটাই জানান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন জ্যেষ্ঠ নির্বাহী কর্মকর্তা।
এই দুই গ্রুপকে অর্থায়নের সাথে জড়িত অন্তত ২০টি ব্যাংক। তবে ব্যাংকাররা বলছেন, বেক্সিমকোর ভাইস চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান কারাগারে থাকায় এবং এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলম মাসুদ বিদেশে অবস্থান করায়—-এদের কারো সাথেই তাঁরা যোগাযোগ করতে পারছেন না।
ইসলামী ব্যাংকের আগের পর্ষদ ভেঙে অন্তর্বর্তী সরকার নতুন পর্ষদ গঠন করে দেয়। নতুন পর্ষদের একজন পরিচালক টিবিএসকে জানান, এই ব্যাংকের শীর্ষ ঋণগ্রহীতা সাইফুল আলম, যার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নেওয়া ঋণের পরিমাণ অন্তত ১ লাখ কোটি টাকা। নিজের প্রতিনিধিদের মাধ্যমে তিনি ১০ হাজার কোটি টাকা পরিশোধের প্রতিশ্রুতি দিলেও—এখন তার নাগাল পাওয়া যাচ্ছে না।
সোনালী ব্যাংকের চেয়ারম্যান মো. মুসলিম চৌধুরী টিবিএসকে বলেন, 'রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মধ্যে খেলাপি ঋণ কমের দিক থেকে আমরা অনেকটা ভালো অবস্থানে রয়েছি। আমাদের নিয়মিত গ্রাহক ছিল বেক্সিমকো গ্রুপ। ৫ আগস্টের পর এই গ্রুপ ঋণ পরিশোধ না করায় খেলাপি হয়েছে। বর্তমানে আমাদের খেলাপি ঋণ ১৬ শতাংশ হলেও ডিসেম্বরে সর্বোচ্চ বাড়লে ১৬ শতাংশে গিয়ে দাঁড়াবে।'
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, বড় বড় গ্রুপ ব্যাংকখাত থেকে ব্যাপক পরিমাণ ঋণ বের করে নিয়েছে, কিন্তু তাদের সম্পদের মান– খুবই কম। এসব গ্রুপের বিদেশে সম্পদ রয়েছে—সেগুলো ফিরিয়ে আনতে সরকারের উদ্যোগ নিতে হবে।
তিনি আরও বলেন, 'আমরা সব সরকারের আমলেই এমন কিছু ব্যবসায়ীদের দুর্নীতির চিত্র দেখেছি। তবে তাদের বিরুদ্ধে কোন সময়েই দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এই সরকার তাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নিলে—পরবরতীতে দেশের জন্য উদহরণ হয়ে থাকবে।'
বেক্সিমকো, এস আলমের মোট ঋণ ২ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা
২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বেক্সিমকো গ্রুপ ও এস আলমকে দেওয়া ২ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকার ঋণ এপর্যন্ত শনাক্ত করতে পেরেছে বাংলাদেশ ব্যাংক, যা কিনা ব্যাংকখাতের মোট ঋণের ১৫ দশমিক ১৭ শতাংশ।
২০২৩ সালের ডিসেম্বরের শেষে একটি স্ট্রেস টেস্ট করে বাংলাদেশ ব্যাংক, যার ফলাফলে দেখা যায়, শীর্ষ তিন ঋণগ্রহীতা ঋণখেলাপি হলে তা ব্যাংকখাতের স্থিতিস্থাপকতার ক্ষেত্রে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। বিশেষত এতে করে মূলধন পর্যাপ্ততার ক্ষেত্রে সংকট তৈরি হবে। খেলাপি ঋণও ৩ শতাংশ বাড়বে।
এই দুই ধরনের অভিঘাতে, ব্যাংকখাতের সিআরএআর অনুপাত (ক্যাপিটাল টু রিস্ক ওয়েটেড অ্যাসেস্ট রেশিও) কেন্দ্রীয় ব্যাংক নির্দেশিত ন্যূনতম হারের চেয়েও নিচে নামবে। এমনটাই জানানো হয় ওই ট্রেস টেস্টের প্রতিবেদনে।
হাইকোর্টের কাছে বাংলাদেশ ব্যাংকের পাঠানো এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, বেক্সিমকো মোট ১৬টি ব্যাংক ও সাতটি ব্যাংক-বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছে ৫০ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে, যার মধ্যে আটটি ব্যাংকের কাছে ২৩ হাজার ১২০ কোটি টাকা খেলাপি ঋণে পরিণত হয়েছে।
বেক্সিমকোর ঋণখেলাপির কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন জনতা ও সোনালী ব্যাংক। বেক্সিমকোর মোট খেলাপি ঋণের মধ্যে গত বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত জনতা ব্যাংকের ঋণের পরিমাণ ছিল ১৯ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা এবং সোনালী ব্যাংকের ঋণের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৫৪৪ কোটি টাকা।
এদিকে, বকেয়া বেতন, ভাতার দাবিতে শ্রমিক অসন্তোষের প্রেক্ষিতে, দীর্ঘমেয়াদি সমাধান হিসেবে বেক্সিমকো গ্রুপের ৩২টি কোম্পানির স্বত্ব বিক্রির পরিকল্পনা করছে অন্তর্বর্তী সরকার।
বেক্সিমকো ইন্ডাস্ট্রিয়াল (শিল্প) পার্কের শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর শ্রম ও ব্যবসা পরিস্থিতি পর্যালোচনাপূর্বক সুপারিশ করতে—সরকারের গঠিত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটি, গত ২৮ নভেম্বর তাদের প্রথম বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত নেয়।
বৈঠকে জনতা ব্যাংককে বেক্সিমকোর 'বি' ক্যাটাগরির কোম্পানিগুলো বিক্রির জন্য একটি এক্সপ্রেশন অফ ইন্টারেস্ট (ইওআই) চূড়ান্ত করার নির্দেশ দেওয়া হয়।
শেখ হাসিনার টানা ১৫ বছরের শাসনের প্রথম মেয়াদ – অর্থাৎ ২০০৯ সালেও শীর্ষ খেলাপি ছিল বেক্সিমকো গ্রুপ। কিন্তু, প্রথম মেয়াদেই সালমানকে তার বেসরকারি খাতের উপদেষ্টা নিয়োগ দেন হাসিনা।
তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সংসদে শীর্ষ খেলাপিদের একটি তালিকা তুলে ধরেছিলেন, যেখানে শীর্ষ ছিল বেক্সিমকো গ্রুপ। এরমধ্যে কেবল বেক্সিমকো টেক্সটাইল লিমিটেডের খেলাপির পরিমাণই ছিল ৩৫৩.৮৯ কোটি টাকা। এরপরেও আওয়ামীলীগ সরকারের ১৫ বছরে কোনো ব্যাংক সালমান এফ রহমানকে খেলাপি হিসেবে তালিকাভুক্ত করতে পারেনি, কারণ তিনি তখনকার প্রধানমন্ত্রী হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা ছিলেন।
চার ব্যাংকে এস আলম গ্রুপের ঋণ ১ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা
গত বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত জনতা ও ইউনিয়ন ব্যাংকে এস আলম গ্রুপের খেলাপির পরিমাণ ১১ হাজার ৭৩৪ কোটি টাকা।
দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) বাংলাদেশ ব্যাংকের পাঠানো এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে শেয়ার মালিকানার মাধ্যমে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে থাকা ৮টি ব্যাংকের মধ্যে চারটি ব্যাংক থেকে ১ লাখ ৯০ হাজার কোটি ঋণ নিয়েছে এস আলম গ্রুপ। এরমধ্যে চারটি ব্যাংক থেকে কাগুজে ও ভুয়া প্রতিষ্ঠানের নামে জাল-জালিয়াতি করে ঋণ নিয়ে ৯৩ হাজার ৩৬৪ কোটি টাকা পাচার করা হয় বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা বিভাগ- বিএফআইইউ এর সূত্রগুলো জানিয়েছে।
এরমধ্যে ইসলামী ব্যাংক থেকে ১ লাখ ৫ হাজার ৪৮৩ কোটি টাকা, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক থেকে ৪৭ হাজার ৬১০ কোটি টাকা, ইউনিয়ন ব্যাংকের ২৩ হাজার ৫২৫ কোটি টাকা এবং গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের ১৩ হাজার ২৫০ কোটি টাকা রয়েছে।
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, এস আলমের কর্ণধার সাইফুল আলম মাসুদ ও তার সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো নিজ নিয়ন্ত্রণে থাকা চারটি ব্যাংকের থেকে প্রভাব খাটিয়ে সাইফুল আলমের নামে বা অন্য মধ্যস্তত্বভোগীর নামে এসব অর্থ ঋণ নেয়। এসব ঋণ নেওয়ার সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত তিনি।
এর আগে গত বছরের অক্টোবরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর বলেছিলেন, প্রভাবশালী কিছু ব্যবসায়ীসহ আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠজনরা ব্যাংকখাত থেকে প্রায় ১৭ বিলিয়ন ডলার পাচার করেছে। এরমধ্যে অন্তত ১০ বিলিয়ন ডলার পাচার করেছে এস আলম।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ এর নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান টিবিএসকে বলেন, 'ডিজিএফআইয়ের সহায়তায় এস আলম ব্যাংকগুলো দখল করেছে। এর ফলে এসব ব্যাংকগুলোর ভল্টে যে টাকা ছিল, সেসব তারা লুটপাট করে পাচার করেছে। এখানে ব্যাংকগুলোর সহায়তা ছিল।'
তিনি বলেন, 'কোনো সভ্য, গণতান্ত্রিক দেশে এটা হয় না। সরকারের জবাবদিহিতা না থাকার কারণে এটা সম্ভব হয়েছে। অবশ্যই এস আলম যেহেতু পাচার করেছে তারা বেশি দায়ী। কিন্তু তারা তো কারো না কারো সহযোগিতায় এসব টাকা পাচার করেছে। তাদেরকে অবশ্যই বিচারের আওতায় আনতে হবে। যদি জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা যায়, তাহলে ভবিষ্যতে অর্থ পাচার বন্ধ হবে।'