কে ওই ঘুমকাতুরে! কে রয় শুধু জেগে?
বিজ্ঞানের অবিশ্বাস্য অগ্রগতির যুগে কথাটি শুনতে আশ্চর্য ঠেকবে, তবুও এটাই সত্যি। মানুষ এবং অন্যান্য জীব কেন ঘুমায়- তার সঠিক কারণ বিজ্ঞানীরা এখনও চিহ্নিত করতে পারেননি। এবিষয়ে চলমান কিছু গবেষণার আওতায় প্রচলিত আছে নানা তত্ত্ব।
কোনোটায় বলা হচ্ছে, ঘুমের মাধ্যমে আমাদের স্মৃতিশক্তি বা শেখার সক্ষমতা বাড়ে। নিদ্রার সাহায্যে হয়তো আমাদের মস্তিষ্কের নিউরন তার ডিএনএ- এর ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারে। গতবছর নেচার ম্যাগাজিনে প্রকাশিত এক গবেষণায় এমন ইঙ্গিতই দেওয়া হয়েছিল।
আবার ২০১৭ সালের এক গবেষণায় মেলে চমকপ্রদ তথ্য। বিজ্ঞানীরা জানান, মগজ বা কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র না থাকা উল্টো জেলিফেশেরাও ঘুমায়। তাই ঘুমের সঠিক কারণ জানাটা এখনও তন্দ্রার মতোই ধোঁয়াশায় ঢাকা।
তবে বিজ্ঞানীরা জানেন; জীব মাত্রই বিশ্রামের প্রয়োজন হয়। এব্যাপারে বেশি গবেষণা হয়েছে স্তন্যপ্রায়ী এবং পাখিদের নিয়ে। সেসব সূত্রে জানা গেছে, প্রাণীরাজ্যে সবার ঘুমের ধরন এক নয়। আফ্রিকার সাভানা, মহাসমুদ্র বা অস্ট্রেলিয়ার কোনো অরণ্য; একেক পরিবেশে বসবাসকারী নানা প্রজাতির ঘুম ভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে। মনোযোগ দিয়ে অধ্যয়ন করলে দেখা যায়, তাদের ঘুমের ভঙ্গিমা বা পরিমাণও প্রজাতি ভেদে সম্পূর্ণ আলাদা রকমের।
অস্তিত্ব রক্ষার কারণেই বিবর্তনের প্রক্রিয়ায় প্রজাতিদের নিদ্রার পার্থক্য তৈরি হয়েছে, বলে জানান কলম্বাস জু অ্যান্ড অ্যাকুরিয়ামের প্রেসিডেন্ট ও মুখ্য নির্বাহী টিম স্ট্যালফ। তার মতে, 'অভিযোজনের প্রক্রিয়াই এর প্রধান কারণ।'
ঘুমন্ত না জেগে থাকার দশা:
আফ্রিকার তৃণভূমি প্রান্তরে বসবাস করে পৃথিবীর সবচেয়ে লম্বা প্রাণী জিরাফ। ওজন ৩ হাজার পাউন্ড হলেও, স্তন্যপায়ীদের মধ্যে সব চাইতে কম ঘুমানোর উপাধিটি তার দখলে। জিরাফ দিনে মাত্র ৩০ মিনিট ঘুমায়। কিন্তু, এই সময়টা তার গভীর নিদ্রার সময়কে বোঝায়। ২৪ ঘণ্টার বাকি সময়ের মধ্যে সাড়ে ৪ ঘণ্টা জিরাফ চোখ বন্ধ করেই কাটায় বলে ১৯৯৬ সালের এক গবেষণায় উল্লেখ করা হয়।
জিরাফের ঘুম পর্যবেক্ষণ করা বিজ্ঞানীদের জন্য সহজ ছিল না মোটেই। প্রাণীটির বিচিত্র ঘুমের সময়সূচির কারণেই এই সমস্যার পড়েন তারা। তবে অনেক কষ্টের পর তারা বুঝতে পারেন, জিরাফ দিনের বেলা সুযোগ মতো সংক্ষিপ্ত কিন্তু গভীরভাবে বেশ কয়েকবার ঘুমিয়ে নেয়। দাঁড়িয়ে থেকেই তারা নিদ্রার কাজটি সেরে ফেলে। দীর্ঘ পায়ের কারণে জিরাফ মাটিতে শুয়ে থাকা অবস্থায় উঠতে গেলে তার অনেকটা সময় লাগে, ওই সময়ে শিকারি প্রাণীর হাত থেকে আত্মরক্ষার জন্যেই ঘুমের এমন কৌশল রপ্ত করেছে দীর্ঘাকায় জীবটি।
স্তন্যপায়ীদের মধ্যে এরপর সবচেয়ে কম ঘুমকাতুরে প্রাণীটি হচ্ছে; হাতি। অতিকায় আফ্রিকান হাতিদের উপর গবেষণাকারীরা ২০১৭ সালে জানান, তারা দিনে মাত্র দুই ঘণ্টা ঘুমায়, সেটাও অধিকাংশ সময় দাঁড়িয়ে থেকেই।
''মাঝেমধ্যে তাদের কিছু গাছের কাণ্ডে ভর দিয়ে চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখবেন। আসলে ঘুমের সময় শরীরের কিছু ভার পা থেকে সরিয়ে নিতেই তারা এমনটি করে থাকে,'' স্ট্যালফ বলছিলেন।
বন্দি প্রাণীদের ঘুমের ধরনও বন্য প্রাণীর থেকে আলাদা। বিশেষত, চিড়িয়াখানায় বন্দি প্রাণীদের চাইতে তা অনেকটাই আলাদা। দুই ধরনের পরিবেশে একই প্রজাতির প্রাণীর ঘুমানোর এই ব্যবধান আসলে তাদের কতটুকু ঘুম প্রয়োজনীয় সেটা তুলে ধরে।
জিরাফ আর হাতির তুলনায় সিংহ কিন্তু অনেক বেশি নিদ্রাপ্রেমী। 'বনের রাজা' খ্যাত পুরুষ সিংহ দিনের ২০ ঘণ্টা বেশ আয়েশ করেই ঘুমিয়ে কাটায়। সিংহীদের ক্ষেত্রে এর পরিমাণ ১৫ ঘণ্টা। বাঘেরাও প্রায় একই রকম সময় ধরে নিদ্রাদেবীর আরাধনা করে।
মাংশাসী প্রাণীদের এই নিদ্রাপ্রীতি আসলে তাদের নৈশকালীন শিকারের সময়ের সাথে সম্পর্কিত। রাতের আঁধারে তারা তীব্র দৃষ্টিশক্তি কাজে লাগিয়ে ওঁতপেতে শিকার করে। অন্যদিকে, খাবারের সন্ধানে জিরাফ এবং হাতির দলকে বিস্তীর্ণ এলাকায় ঘুরে বেড়াতে হয়। এজন্যেই তাদের ঘুমও সংক্ষিপ্ত।
সবচেয়ে বড় নিদ্রাবীর কারা:
অস্ট্রেলিয়ার সবচেয়ে আদুরে চেহারার প্রাণী হচ্ছে কোয়ালা ভালুক। ভল্লুক প্রজাতির হলেও সে বিপজ্জনক নয় মোটেই। বরং দারুণ নিরীহ আর লাজুক। তাদের প্রধান খাদ্য নাইট্রোজেন সমৃদ্ধ ইউক্যালিপটাস গাছের পাতা। এটা হজম করতে তারা দিনে ১৮ থেকে ২২ ঘণ্টা ঘুমায়। অস্ট্রেলিয়ান কোয়ালা ফাইন্ডেশন এ তথ্য জানিয়েছে।
ভল্লুক প্রজাতির হিংস্র ও বহুভোজী প্রাণীরা হচ্ছে উত্তর আমেরিকা মহাদেশের কালো এবং বাদামী ভাল্লুক; বছরের টানা আট মাস হাইবারনেশন বা গভীর তন্দ্রায় কাটায়। শীতকালের সিংহভাগ সময়টা একারণেই তাদের ভয়ে থাকতে হয় না বনচারীদের। স্ট্যালফ বলেন, ''এই প্রাণীরা পুরো একটি মৌসুম একটানা ঘুমাতে পারে, যা সত্যিই বিস্ময়কর।''
ঘুম নিয়ে বিস্ময় শুধু স্থলভাগে নয়, জলের তলার বাসিন্দারাও তাতে কম যায় না। মাছেরা যেমন চোখ খুলে ঘুমায়। তাদের অবশ্য চোখের পাতাও নেই। কেউ কেউ ঘুমন্ত অবস্থাতেই সাঁতার কাটে, এমন প্রমাণও মিলেছে।
ঘুমের সঙ্গে আড়ি যাদের:
স্তন্যপায়ী ডলফিন তো আরও বিস্ময়কর। ঘুমের সময় তাদের মস্তিষ্কের এক অংশ জেগে থাকে এবং সাঁতার কাটাতে সাহায্য করে। এই ধরনের ঘুমকে ইউনিহেমিস্ফেরিক স্লিপ' বলেন বিজ্ঞানীরা। ঘুমের সময় জেগে থাকা অংশটিতে অবশ্য খুব ধীর গতিতে বৈদ্যুতিক সংকেত প্রবাহিত হয়।
ডলফিনেরা সব সময় সাঁতার কাটার কারণে কিছু বিজ্ঞানী একে ঘুম বলে মানতে রাজি নন। তাই ডলফিনেরা আদতেই ঘুমায় না এমনটাও বলা যেতে পারে। কোলাব্যাঙেরাও কখনও ঘুমায় না।
২০০৮ সালে পিএলওএস বায়োলজিতে প্রকাশিত নিবন্ধে বিজ্ঞানীরা ঘুম সংক্রান্ত ১৯৬৭ সালের এক অধ্যয়নের তথ্যকে আরও দৃঢ় করেন। সেখানে তারা জানান, মানুষ ও প্রাণীদের ঘুমের সঠিক কারণ এখনও রহস্যাবৃত এক অধ্যায়। জীবনের এই অধ্যায়ের পূর্ণ চিত্র পেতে আমাদের আরও বিস্তারিত গবেষণা চালিয়ে যেতে হবে।
- সূত্র: ডিসকভার ম্যাগাজিন