কোভিডে যদি স্বাদ ও ঘ্রাণশক্তি হারিয়ে ফেলেন শেফ!
কথায় আছে ঘ্রাণেই অর্ধ-ভোজন। আবার সত্যিকার অর্থেই খাবারে স্বাদ অনুভবে গন্ধের বিকল্প নেই। তাই হঠাৎ করে যদি আপনি ঘ্রাণশক্তি হারান- তাহলে কীভাবে খাবার চাখবেন? আগে না ভেবে থাকলে, অতিমারি চলাকালে কিন্তু এবার ভাবতে হবে।
বিশ্বমারির মধ্যে বহুবার এ প্রসঙ্গে আলোচনা হয়েছে।
স্বাভাবিকভাবে 'ঘ্রাণহীনতা' অ্যানসোমিয়া রোগের উপসর্গ। সাধারণত মাত্র ৫ শতাংশ মানুষ এর শিকার হন।
তবে কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হওয়ার পর ঘ্রাণ এবং স্বাদের অনুভূতি হারিয়ে ফেলার ঘটনা ঘটেছে অনেকের ক্ষেত্রে। তাই ইতোপূর্বের বিরল এ উপসর্গগুলো নতুন করে বৈশ্বিক আলোচনার বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়েছে।
সার্স কোভ-২ জীবাণুতে সংক্রমিতরাই শুধু এমন অবস্থায় পড়ছেন তা নয়, পাশাপাশি যারা সুস্থ হয়ে উঠেছেন তাদের কেউ কেউ দীর্ঘসময় ধরে এ দুই অনুভূতি শূন্য থাকছেন। রোগ থেকে সেরে ওঠার কালে চারপাশের পরিবেশ ও খাদ্যের সুগন্ধও বঞ্চিত তারা।
তাই হঠাৎ করে যদি স্বাদ বা গন্ধের অনুভূতি হারিয়ে ফেলেন তাহলে কী করবেন?
এজন্য আপনার সহায়তায় এগিয়ে এসেছেন ডাচ রন্ধনশৈলি লেখিকা ও শেফ ইয়োক-ই বুন। তিনি নিজেও অ্যানসোমিয়া আক্রান্ত। ফলে গন্ধের অনুভূতি নেই তার। চার বছর বয়সে প্রচণ্ড ঠাণ্ডার কারণে তার টনসিল কেটে ফেলতে হয়েছিল, তখন থেকেই এ অবস্থা।
তার জিহ্বায় স্বাদগ্রন্থি অবশ্য অক্ষত আছে। তবে ঘ্রাণের অনুভূতি না থাকার কারণে তিনি মূল পাঁচটি স্বাদ; টক, ঝাল, মিষ্টি, লবণাক্ত এবং উমামি খুবই হালকাভাবে অনুভূব করতে পারেন। চর্বির স্বাদও পান , তবে অনেকটা কম। তিনি স্বাদ গ্রহণের ৯৪ শতাংশ সহজাত ক্ষমতা হারিয়েছেন বলে জানান তার চিকিৎসকরা।
এই প্রতিবন্ধকতায় রান্না নিয়ে বুনের আগ্রহ বা উৎসাহে মোটেই ভাটা পড়েনি। ইতোমধ্যেই, তিনি পাঁচ পাঁচটি বহুল বিক্রিত রান্নার বই লিখেছেন। তাই প্রশ্ন জাগে, ঘ্রাণ ও স্বাদের অনুভূতি হারানো মানুষের পক্ষে কীভাবে এত সফল রেসিপি লেখা সম্ভব? বুন অবশ্য নিজের মগজ এবং মুখমণ্ডলের স্নায়ু ব্যবহার করেই এ সফলতা অর্জন করেছেন।
স্নায়ু নিয়ন্ত্রণে মনোযোগী হোন:
কান থেকে শুরু করে চোখ, নাক এবং চোয়ালের এই তিনদিকে বিস্তৃত আমাদের ট্রাইগমিনাল নার্ভ। মুখমণ্ডলের এ স্নায়ু আকস্মিক বিপদ যেমন; ধোয়া বা বিষাক্ত বাতাস থেকে রক্ষা করার কাজ করে। তবে খাদ্যের বেশকিছু উপাদানও এই স্নায়ুটি শনাক্ত করতে পারে।
''আমি এ স্নায়ু ব্যবহার করে খাবারের স্বাদ বুঝি, নিজের ইচ্ছেমতো এটি ব্যবহার করা ক্ষমতা আমার আছে। এর মাধ্যমে আমি আদা, মিন্ট, মাস্টার্ড এবং গোল মরিচের স্বাদ বুঝতে পারি। গোল মরিচ আর আদার স্বাদ উষ্ণ এবং জিহ্বায় সুড়সুড়ির মতো অনুভূতি জাগায়, অন্যদিকে মিন্ট বা মুলা ঠাণ্ডার অনুভূতি দেয়।''
তিনি জানান, খাবারের চেহারা দেখেও অনেক কিছু বোঝা সম্ভব। বিশেষ করে, রঙ খুব গুরুত্বপূর্ণ।
''আমি সাদা রঙা বা বর্ণহীন খাবার পছন্দ করি না। কারণ সাদা রঙ আমার মস্তিষ্কে গন্ধের স্মৃতি তৈরি করে না। তাছাড়া, খাবারে পরত এবং নাম শব্দও এক্ষেত্রে অনেক বড় ব্যাপার। যেমন হ্যাজেলনাট বললে আপনি শক্ত এবং ওয়ালনাট বললে একটি অপেক্ষাকৃত নরম কাঠবাদামের কথা বুঝবেন।''
শব্দের সঙ্গে অনুভূতির সম্পর্ক:
''চর্বি কম থাকায় হ্যাজেলনাট ভাঙ্গলে বেশ মটমট শব্দ হয়, ওয়ালনাট কিন্তু হালকা মুচমুচে শব্দ করে। স্বাদ স্মৃতি চিন্তার দিক থেকে আপনি একটু লক্ষ্য করলেই আপেল এবং গাজরের মধ্যে সূক্ষ্ম পার্থক্যটাও ধরতে পারবেন।''
ছোট্ট থেকেই বুনের নিজ জগতে খাদ্যের একটি বড় ভূমিকা ছিল। রান্না ভালোবাসা শিখেছেন তখন থেকেই।
তিনি বলেন, ''দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ১৯৪৪-৪৫ সাল নাগাদ 'ডাচ হাঙ্গার উইন্টার' দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। আমার মা ওই খাদ্য সঙ্কট থেকে প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন। তাই ছোটবেলায় তার কাছে খাবারের গুরুত্বটা বুঝতে শিখেছি।''
''স্বাদের অনুভূতি অনেক কম থাকার পরও আমি সব সময় খাবার তৈরিতে অংশগ্রহণ করেছি। ছাত্রাবস্থায় প্রথম আমি নানা ধরনের রান্নাবান্না নিয়ে পরীক্ষা শুরু করি, আর তখন থেকেই নিজের আবিষ্কৃত রেসিপিগুলো লিখে রাখছি,'' তিনি যোগ করেন।
স্বাদের অনুভূতি কম থাকায় কারণে তিনি সঙ্গত কারণেই বেশি মশলা এবং কড়া সুগন্ধিযুক্ত খাবার বেশি পছন্দ করেন। এক্ষেত্রে মেক্সিকো এবং ভারতীয় রন্ধনশৈলী তার সবচেয়ে বেশি প্রিয়।
এপ্রসঙ্গে তিনি বলেন, ''এ দুই অঞ্চলের মানুষ খাবারে নানা ধাপে যেভাবে মশলা যোগ করেন, তা আমি সত্যিই খুব বেশি ভালোবাসি। তাছাড়া নানা ধরনের মরিচের ব্যবহার সত্যিই রোমাঞ্চকর।''
কোভিডে স্বাদ-ঘ্রাণ হারানো লোকদের নিজ বুদ্ধিমত্তা ও স্নায়ু ব্যবহারে যত্নবান হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন ইয়োক-ই বুন। বলছেন নিজস্ব অভিরুচি অনুসারে রান্না করে খাওয়ার কথা। এতে তারা যে জিনিষটির স্বাদ পান, তা খাবারে ব্যবহার করতে পারেন।
পাশাপাশি সতর্কতার অংশ হিসেবে হাতের কাছে আগুন নেভানো এবং ধোঁয়া শনাক্ত করার যন্ত্র রাখার কথাও বলেছেন।
'ঘ্রাণের অনুভূতি হারানো খুবই বাজে ব্যাপার। তারপরও একটু চেষ্টা করলেই আপনি জীবনকে কিছুটা আনন্দময় করে তুলতে পারবেন,'তিনি যোগ করেন।
- সূত্র: সিএনএন