প্যাঙ্গোলিন: যেখান থেকে করোনা ভাইরাস এল
গত ডিসেম্বরে চীন থেকে উৎপত্তি হওয়া প্রাণঘাতি করোনাভাইরাস বর্তমানে বাংলাদেশসহ বিশ্বের ২০৯টি দেশ ও অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে। বিজ্ঞানীরা সন্দেহ করছেন, চীনের বাজারে চোরাই পথে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করা প্যাঙ্গোলিন প্রাণী থেকে করোনাভাইরাস বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে।
প্যাঙ্গোলিন হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি চোরাই পথে পাচার হওয়া স্তন্যপায়ী প্রাণী, যেটিকে বাংলাদেশে অনেকে বনরুই বলে চেনেন। এই প্রাণীটির দেহে এমন একটি ভাইরাস পাওয়া গেছে, যা কোভিড-১৯ এর সাথে 'ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত।'
এটা খাদ্য হিসেবে যেমন ব্যবহৃত হয়, তেমনি ব্যবহৃত হয় ঐতিহ্যবাহী ওষুধ তৈরির জন্য। ঐতিহ্যবাহী চীনা ওষুধ তৈরির ক্ষেত্রে প্যাঙ্গোলিনের গায়ের আঁশের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে এবং তাদের মাংসও চীনে একটি উপাদেয় খাবার বলে গণ্য করা হয়। খবর বিবিসি বাংলা।
হংকং বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ড. টমি ল্যাম বলেছেন, চীনে পাচার হওয়া মালয়ান প্যাঙ্গোলিনের মধ্যে এমন দুই ধরনের করোনাভাইরাস পাওয়া গেছে, যা মানুষের মধ্যে দেখা দেয়া মহামারির সাথে সম্পর্কিত।
নেচার সাময়িকীতে প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রে বিজ্ঞানীরা বলছেন, এসব প্রাণী নিয়ে নাড়াচাড়া করার ক্ষেত্রে অত্যন্ত সতর্ক হওয়া প্রয়োজন এবং ভবিষ্যতে করোনাভাইরাসের মতো কোন মারাত্মক রোগ বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি কমাতে হলে প্যাঙ্গোলিনের মত বন্য প্রাণী বিক্রি কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা উচিত।
তবে তারা এটাও বলছেন যে, মানুষের মধ্যে রোগ ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকির ক্ষেত্রে প্যাঙ্গোলিনের ভূমিকা বুঝতে হলে আরও পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষা প্রয়োজন।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, বাদুড়ের দেহেও করোনাভাইরাস আছে এবং তার সঙ্গে মানুষের দেহে সংক্রমিত ভাইরাসের আরও বেশি মিল আছে। কিন্তু একটি অংশ, যা মানুষের দেহের কোষ ভেদ করে ভেতরে ঢুকতে ভাইরাসটিকে সহায়তা করে, তার সঙ্গে এর মিল নেই।
সহ-গবেষক সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এডওয়ার্ড হোমস বলেন, এর অর্থ হলো বন্যপ্রাণীদের মধ্যে এমন ভাইরাস আছে যা মানুষকে সংক্রমিত করার ক্ষেত্রে নিজেদের মানিয়ে নিতে পারে।
তিনি বলছেন, 'করোনাভাইরাসের সাথে বাদুড়ের নিশ্চয়ই সম্পর্ক আছে, হয়তো প্যাঙ্গোলিনও সম্পর্কিত, তবে অন্য কোন প্রাণীর জড়িত থাকারও জোর সম্ভাবনা আছে।'
ঠিক কীভাবে ভাইরাসটি একটি প্রাণীর শরীর থেকে বেরিয়ে অন্য একটি প্রাণীর শরীরে এবং তারপর সেখান থেকে মানুষের শরীরে ঢুকলো, তা এখনও বিজ্ঞানীদের কাছে রহস্য হয়েই রয়েছে। খুব সম্ভবত হর্সশু প্রজাতির বাদুড় এবং প্যাঙ্গোলিন – দুই ধরণের প্রাণীই এতে জড়িত কিন্তু এর ঘটনাক্রম এখনও অজানা।
ডা. ল্যাম বলছেন, চোরাই পথে আসা মালয়ান প্যাঙ্গোলিনে এ ভাইরাস পাওয়া যাবার পর এই প্রশ্নটাও উঠছে যে- এই প্যাঙ্গোলিনের শরীরে ভাইরাস ঢুকলো কীভাবে? সেটা কি পাচারের সময় আশপাশে থাকা বাদুড় থেকে এসেছিল, নাকি দক্ষিণ পূর্ব-এশিয়ায় তাদের যে প্রাকৃতিক আবাসস্থল সেখানেই ঘটেছিল?
এ ব্যাপারে প্রাণী সংরক্ষণবিদরা বলছেন, এখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত অবৈধ বন্যপ্রাণী পাচার রোধের জন্য বিভিন্ন দেশের সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করা।
চীন অবশ্য কোভিড-১৯ সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার পর বন্যপ্রাণীর মাংস খাওয়া নিষিদ্ধ করার পদক্ষেপ নিয়েছে এবং ভিয়েতনামেও এমন কিছু পদক্ষেপের কথা বিবেচনা করা হচ্ছে।
লন্ডনের জুলজিক্যাল সোসাইটির অধ্যাপক এন্ড্রু কানিংহ্যাম বলছেন, এই গবেষণাপত্র থেকে এক লাফে কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছে যাওয়া ঠিক হবে না। কোভিড-১৯ এর উৎস আসলে এখনো অজানা। হয়তো এটা কোন প্রাকৃতিক প্যাঙ্গোলিন ভাইরাসই ছিল অথবা হয়তো প্যাঙ্গোলিন ধরা এবং হত্যা করার সময় অন্য কোনো প্রাণী থেকে এসেছিল।