মস্তিস্ক কেন অতি-প্রাকৃতিক শক্তি বা ভূতে বিশ্বাস করতে চায়?
অতি-প্রাকৃতিক ঘটনার অনুসন্ধানী হ্যালি স্টিভেন্স ২০০৬ সালে দক্ষিণ ইংল্যান্ডের এক গ্রামীণ এলাকার এক বিপণীকেন্দ্রে ব্যাখ্যার অতীত কিছু ঘটনার কথা শুনেছিলেন। প্রায় সঙ্গেসঙ্গেই অনুমতি নিয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে তিনি একা একা অন্ধকার করিডর জুড়ে ঘুরে বেড়ান।
অনেক খুঁজেও তিনি ভুতুরে কোনো কার্যকালাপ না পেয়ে, বেশ হতাশ হয়েই ফিরছিলেন। চলে এসেছেন বিপণীকেন্দ্রের কাঁচের জানালার কাছে, ঠিক তখনি সজোর এক আওয়াজে কেঁপে উঠলেন তিনি। শব্দটা জানালা থেকেই এসেছে। কেউ বা কোনোকিছু যেন প্রচন্ড শক্তিতে সেখানে আঘাত করছে।
অথচ বিপণীকেন্দ্র তখন বন্ধ। ভেতরে হ্যালি একাই। অন্য কারো থাকার কথাও নয়। তাহলে এই শব্দের উৎস কে? ব্যাখ্যাই বা কী?
হ্যালি জানতেন, ১২ শতকে অ্যাংলো-স্যাক্সনদের তৈরি প্রাচীন এক দূর্গের ধবংসাবেশের উপরই তৈরি হয়েছে অধুনা শপিংমলটি। এই মফস্বল শহরের আশেপাশের কিছু এলাকায় খনন কাজ চালিয়ে সেই আমলের পুরোনো কবরস্থানও খুঁজে পেয়েছেন প্রত্নতাত্বিকেরা।
এসব ভাবতে ভাবতে ভয়ের হিমশীতল স্রোত বইছিল তার শরীরে। সারা রাত তিনি ঘটনাটির যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা দাড় করানোর চেষ্টাও করেছেন। আসলে কী সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি সবশেষে?
হ্যালি জানান, ''আসলে, আমি নিশ্চিত করে জানি না কী ঘটেছিল।''
এভাবে ২১ শতকে এসেও ব্যাখ্যার অতীত, অপ্রত্যাশিত ও আকস্মিক ঘটনায় ভীত আর চমকিত হচ্ছে মানুষ। কখনো ভাসমান টেবিল, কখনোবা অস্পষ্ট ছায়ার দৌরাত্মে ভয় পাচ্ছে।
আসলেই কী আধি-ভৌতিক অভিজ্ঞতা ব্যাখ্যার অতীত? নাকি বিজ্ঞানের ভিন্ন একটি শাখা এর উত্তর দিতে সক্ষম।
ঈশ্বর বনাম ভূত! নাকি বিজ্ঞান?
পশ্চিমা বিশ্বের অনেক স্থানেই ঈশ্বরে আস্থা রাখা মানুষের সংখ্যা কমছে। অথচ অতি-প্রাকৃত ঘটনায় বিশ্বাস দিনে দিনে পাচ্ছে জনপ্রিয়তা। বিজ্ঞানে অগ্রসর এসব দেশে আধি-ভৌতিকে আস্থা বাড়ছে মানুষের।
২০১৯ সালে ইউগভ পরিচালিত এক জরিপে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি ১০ জনের মধ্যে ৪ জন ভূত বা প্রেতাত্মায় বিশ্বাস করেন। সমীক্ষায় অংশ নেওয়া, এক- তৃতীয়াংশ জানান, তারা একবার হলেও অশরীরী উপস্থিতি অনুভব করেছেন।
ব্রিটেনেও এমন বিশ্বাস সমান জনপ্রিয়। ঐশ্বরিক কোনো সত্ত্বায় আস্থা না থাকলেও, সিংহভাগ ব্রিটিশ ভূতকে ঠিকই মানে।
অতি-প্রাকৃত ঘটনা নিয়ে অনেকে ব্যঙ্গ করলেও, বিজ্ঞান কিন্তু তা পুরোপুরি উড়িয়ে দেয় না। এনিয়ে বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানও কম হচ্ছে না।
এমনই একজন অনুসন্ধানকারী লন্ডনে অবস্থিত গোল্ডস্মিথ কলেজের অ্যানোম্যালিস্টিক সাইকোলজি ইউনিটের পরিচালক এবং মনোবিজ্ঞানী ক্রিস্টোফার ফ্রেঞ্চ। তিনি অতি-প্রাকৃত ঘটনার পেছনে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা খুঁজে বেড়ান।
ফ্রেঞ্চ জানান, অধুনা মানুষের বিবর্তন হয়েছে হাজার হাজার বছর ধরে। দীর্ঘ এই সময়ের বড় অংশই প্রকৃতির নানা বিপদ থেকে আমাদের হাতে আত্মরক্ষার উপায় ছিল না। তাই অজানা-আকস্মিক বিষয়কে আমাদের মস্তিস্ক বিপদ হিসাবে ভুল করে শনাক্ত করে এবং ভয়ের সংকেত পাঠায়। আমাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতেই এমন কৌশল নেয় সে। 'তাই বলা যায়, জন্মলগ্ন থেকেই আমাদের মস্তিস্ক অদ্ভূত সবকিছুতে বিশ্বাস করতে সাহায্য করছে।'
প্রতিক্রিয়াশীল ও যৌক্তিক মনের দ্বন্দ্ব:
নিজ পর্যবেক্ষণের স্বপক্ষে ইসরাইলি-মার্কিন মনোবিজ্ঞানী ড্যানিয়েল কানেম্যানের একটি তত্ত্ব তুলে ধরেন ফ্রেঞ্চ। ওই সূত্র অনুযায়ী, আমাদের চিন্তা করার দুইটি ধারা রয়েছে। এরমধ্যে প্রথমটি হচ্ছে; প্রতিক্রিয়াশীল। এই প্রক্রিয়ায় আমরা তাৎক্ষণিক কোনো ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেই, এবং মাঝেমধ্যেই তার কারণে কোনো ঘটনার ভুল ব্যাখ্যা করা হয়।
দ্বিতীয় প্রক্রিয়াটি অনেক ধীর গতির। তবে বেশিরভাগ ঘটনার ব্যাখ্যায় এই প্রক্রিয়াই সঠিক উত্তর দিতে পারে।
আমরা মানুষেরা নিজেদের যুক্তির মাধ্যমে পরিচালিত প্রাণী ভাবলেও, চিন্তার বেলায় করি উল্টোটা। কানেম্যানের সূত্র অনুসারে, সিংহভাগ ক্ষেত্রে আমরা প্রতিক্রিয়াশীল পন্থাতে চিন্তা করি। সেজন্য বিবর্তনই দায়ী।
ব্যাখ্যায় ফ্রেঞ্চ বলেন; প্রস্তরযুগের একজন মানুষের কথা ভাবুন। সে যদি তার গুহার কাছে ঝোপঝাড়ে হঠাৎ নড়াচড়া ও গড়গড় আওয়াজ শোনে; তাহলে সে তক্ষণাৎ ধরে নেবে সেখানে কোনো শিকারি জন্তু ওঁতপেতে রয়েছে। ফলে সে সেখান থেকে পালিয়ে গিয়ে প্রাণে বাঁচতে পারবে। কিন্তু, সে যদি চিন্তার দ্বিতীয় এবং ধীরগতির প্রক্রিয়াটি অনুসরণ করে, তাহলে হয়তো সে বন্য পশুটির শিকারে পরিণত হবে।
এভাবে, আদিকাল থেকে সম্ভাব্য শিকারী প্রাণীর হাত থেকে বেঁচেছে মানুষ। প্রতিক্রিয়াশীল চিন্তাশক্তি সেখানে অগ্রিম সতর্কতার ব্যবস্থা হিসেবে কাজ করেছে। আমাদের জেনেটিক গড়ন এবং মস্তিস্ক আজো সেই স্মৃতি বহন করে, সেভাবেই তাৎক্ষণিক বেশকিছু ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। তাই কোনো ঘটনার ব্যাখ্যা ভুল হওয়াটা সহজাত কারণেই হয়। তথাকথিত ব্যাখ্যার অতীত কিছুই নেই; তবে আমাদের চিন্তাশক্তির গতি-প্রকৃতি সেখানে মূল বাধা হিসাবে কাজ করে।
- সূত্র: ডিসকভার ম্যাগাজিন