২০ বছর প্রতিষ্ঠান তাকে বাধ্য করেছে আঁতোয়ান হয়ে থাকতে, এখন মোহাম্মদ মামলা করেছেন
১৯৯৬ সালে ৪০ বছর বয়সী মোহাম্মদ আমঘর বিক্রয়কর্মী পদে চাকরির জন্য ইন্টারভিউ দেন। ইন্টারভিউয়ে তার ভবিষ্যৎ বস তাকে অনুরোধ করেন, তিনি যেন তার 'মোহাম্মদ আমঘর' নাম বদলে ঐতিহ্যবাহী ফরাসি নাম গ্রহণ করেন। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার এই অনুরোধ শুনে প্রথমে মোহাম্মদ আমঘর পুরো বাক্যহারা হয়ে পড়েন।
'তোমাকে এই নাম বদলে আঁতোয়ান নাম গ্রহণ করতে হবে,' ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাটি সুনির্দিষ্টভাবে আমঘরকে বলেন। 'তোমার নাম 'ফিলিপে' হতে পারত, কিন্তু এই অফিসে ইতিমধ্যে দুজন 'ফিলিপে' আছে। কাজেই তোমাকে ঐ নাম দেওয়া যাচ্ছে না।'
ওই সময়ে মোহাম্মদ আমঘরের সামনে আর কোনো বিকল্প ছিল না। ফলে বাধ্য হয়ে প্রতিষ্ঠানের উচ্চপদস্থ ওই কর্মকর্তার প্রস্তাবে তিনি রাজি হন। প্রস্তাব গ্রহণ করলেও আমঘর নিজের ওপর যথেষ্ট ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন, এবং লজ্জিত হয়েছিলেন।
'এটা আমার কাছে এক ধরনের বিশ্বাসঘাতকতা মনে হয়েছে,' বলেন আমঘর। প্যারিসে জন্মগ্রহণকারী আমঘরের আলজেরীয় বাবা-মা ফ্রান্সে আসেন ১৯৪৬ সালে। আলজেরিয়া তখনও ফ্রান্সের অংশ। 'বিষয়টা বোঝার চেষ্টা করুন ৪০ বছর বয়স আমার, কিন্তু মোহাম্মদ নাম হওয়ায় আমার পাসপোর্ট যথেষ্ট না, আমি আর সবার মতো খাটি ফ্রেঞ্চ নই।'
চাকরি নেওয়ার পর মোহাম্মদ আমঘর রাতারাতি হয়ে গেলেন আঁতোয়ান। বদলে গেল তার ই-মেইল অ্যাড্রেস। তার বিজনেস কার্ড। ট্রেন এবং প্লেনের টিকেট, এবং ইন্টারগ্রাফ নামের আমেরিকান সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠানে যাবতীয় ব্যবসায়িক মিটিংয়ে, চাকরির বাৎসরিক পারফরমেন্স রিপোর্ট- সর্বত্র তার পরিচয় হয়ে গেল আঁতোয়ান।
দক্ষিণ প্যারিসে অবস্থিত আমেরিকান এই সফটওয়্যার কোম্পানি মোহাম্মদকে সম্পূর্ণ নতুন পরিচয়ে পরিচিত করে তুলল।
এখন মোহাম্মদ আমঘরের বয়স ৬৩ বছর। অবসর নিয়েছেন। গত বছর তিনি দক্ষিণ প্যারিসের ক্রেটেইলের লেবার কোর্টে তার সাবেক প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে বৈষম্য ও নৈতিকভাবে তাকে হয়রানির জন্য মামলা ঠুকেছেন। মামলায় ক্ষতিপূরণ হিসেবে দাবী করেছেন ৪ লক্ষ ৪০ হাজার ইউরো। গত মার্চে মামলাটি কোর্টে ওঠে। এবং প্রথম শুনানি হয়েছে, মামলার রায় ঘোষিত হতে হতে আগামী বছর হয়ে যাবে।
ফরাসি আদালত মোহাম্মদ আমঘরের মামলা বেশ গুরুত্ব সহকারেই গ্রহণ করেছেন। ফরাসি আইন বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে যথেষ্টই কঠোর। তারপর সদ্য ঘটে যাওয়া যুক্তরাষ্ট্রের মিনিয়াপোলিসে জর্জ ফ্লয়েডের হত্যার ঘটনায় সবাই বেশ সচেতন।
আমঘর জানিয়েছেন, তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা যখন তাকে নাম পরিবর্তনের অনুরোধ করেন, তখন এর বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার মতো অবস্থা তার ছিল না। কারণ তখন সদ্য তিনি তার পুরনো চাকরিটি ছেড়েছেন; তিন সন্তানসহ তার স্ত্রীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে।
'আমি বুঝতে পেরেছিলাম, মোহাম্মদ নাম আমাকে কোনো ভালো চাকরি জোগাড় করে দেবে না,' আমঘর তার আইনজীবীর প্যারিস অফিসে এই আক্ষেপের কথা বলছিলেন।
আমঘর অবশ্য স্বীকার করেছেন, এর আগে তিনি ইন্টারগ্রাফের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ করেননি। ইন্টারগ্রাফে তিনি ১৯৯৭ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন।
আমঘর তার উকিলকে বলেন, মামলা করার আগে নিজের সঙ্গে যথেষ্ট যুদ্ধ করেছেন। তিনি ভেবেছেন, 'আমি শুরুতে কিছু বলিনি! এতদিন পরে কী বলব?'
আমেরিকার আলাবামা ভিত্তিক ইন্টাগ্রাফ প্রতিষ্ঠানটি ২০১০ সালে কিনে নেয় সুইডিশ কোম্পানি হেক্সাগন এবি। তারা আমঘরের উত্থাপিত অভিযোগের ব্যাপারে বলেছেন, আমঘর প্রতিষ্ঠানটিতে ভিন্ন একটি নামে পরিচিত ছিলেন। কিন্তু তারা এমন কোনো প্রমাণ পাননি যাতে প্রমাণিত হয়- তাকে নাম পরিবর্তনের জন্য অনুরোধ করা হয়েছে।
ইন্টারগ্রাফ এক ই-মেইল বার্তায় জানিয়েছে, আমঘরের এই অভিযোগের ভিত্তিতে ২০১৮ সালে, তারা একটি আভ্যন্তরীণ তদন্তের ব্যবস্থা করেছিল; কিন্তু সব পুরনো নথিপত্র পর্যালোচনা করে এবং বর্তমান ও সাবেক কর্মীদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করে মোহাম্মদ আমঘরকে নাম পরিবর্তন করতে বাধ্য করা হয়েছে, তারা কোনো আলামত পায়নি।
এদিকে নিউইয়র্ক টাইমসের পক্ষ থেকে মোহাম্মদ আমঘরের সাবেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান: 'এ ধরনের কোনো ঘটনার কথা তার মনে পড়ছে না, তবে নামবদলের ঘটনা ঘটতে পারে!'
ফ্রান্সের এই প্রতিষ্ঠানটির আইনজীবী কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান। তবে ২০১৮ সালে আমঘর মামলা করার হুমকি দিয়ে চিঠি লিখলে প্রতিষ্ঠানটি প্রথমে বিস্ময় প্রকাশ করে। তারা জানায়, 'মিস্টার আমঘর ইন্টারগ্রাফে ২০ বছর চাকরি করেছেন। এতদিন পর তার বৈষম্যের অভিযোগ করা বিস্ময়কর।'
মোহাম্মদ আমঘর যথেষ্ট গোছানো ব্যক্তি, তার সংরক্ষণে থাকা প্রতিটি বিজনেস কার্ড, বিল পরিশোধের রশিদ, ইমেইল কন্টাক্ট, নিরাপত্তা সংক্রান্ত নথিপত্র, পুরস্কার, সর্বত্র তার নাম উল্লেখ করা আঁতোয়ান।
তবে মোহাম্মদ আমঘরের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সহকর্মীদের একজন বলেন, তিনি খুব দ্রুতই এই সত্যটি জেনে গিয়েছিলেন। তবে আমঘরের অন্য সহকর্মীরা এই নাম পরিবর্তনের কাহিনি জেনেছেন আরও পরে। তারা বিস্মিত হয়েছিলেন যে মোহাম্মদ আমঘরের আসল নাম আঁতোয়ান নয়।
ইন্টারগ্রাফ নরওয়েতে কর্মরত ছিলেন রাউল টারডি; বর্তমানে অবসরে আছেন। ইন্টারগ্রাফে তিনি কর্মরত ছিলেন ১৯৯১ থেকে ২০২১৫ সাল পর্যন্ত। এ সময়ে আমঘরের সঙ্গে তার পরিচয়, আলাপের কথা স্মরণ করতে গিয়ে জানান, তিনি তাকে শুরু থেকেই আঁতোয়ান নামেই জানেন। বেশ কয়েক বছর তার সঙ্গে যোগাযোগে আমঘর সব সময় নিজেকে ফোনে, এবং সাক্ষাতে আঁতোয়ান নামেই পরিচয় দিয়েছেন। এবং ফোন ডাইরেক্টরিতে তার নাম আঁতোয়ান, বিজনেস কার্ডে তার নাম আঁতোয়ান- সর্বত্র তার নাম আঁতোয়ান।
- সূত্র: নিউইয়র্ক টাইমস