ঢাকনা বন্ধ করে টয়লেট ফ্লাশ করা কি জীবাণু বিস্তার রোধ করতে পারে?
টয়লেট পেপার রোলটি সামনে নাকি পেছনের দিকে ফিরিয়ে রাখা উচিত এই নিয়ে বিতর্কের মতোই, ঢাকনা বন্ধ রেখে নাকি খোলা রেখে টয়লেট ফ্লাশ করা স্বাস্থ্যকর তা নিয়েও জোর বিতর্ক রয়েছে।
সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা বলেছেন, বিপজ্জনক জীবাণুর বিস্তার রোধে ঢাকনা বন্ধ রেখে ফ্লাশ করা কোনো কার্যকর সমাধান না।
যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিজোনা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজিস্ট চার্লস গারবা এবং তার গবেষক দল জানিয়েছে, আপনি ঢাকনা উপরে বা নিচে রেখে ফ্লাশ করছেন জীবাণু বিস্তার রোধে এটি গুরুত্বপূর্ণ কোনো প্রশ্ন না। কারণ টয়লেটের ঢাকনা বন্ধ করে ফ্লাশ করাটা জীবাণু কণার বিস্তার রোধে তেমন কাজে লাগে না।
বৃহস্পতিবার আমেরিকান জার্নাল অব ইনফেকশন কন্ট্রোলে প্রকাশিত একটি গবেষণায় গবেষকরা জানিয়েছেন, টয়লেট ফ্লাশ করলে ক্ষুদ্র বর্জ্য কণাগুলো মেঝে এবং আশেপাশের দেয়ালগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে, তা ঢাকনাটি উপরে বা নিচে যেখানেই থাকুক না কেন।
গবেষণায় দেখা গেছে, নরোভাইরাসের মতো ভাইরাল প্যাথোজেনের বিস্তার হ্রাস করার একমাত্র কার্যকর উপায় হলো টয়লেট, টয়লেটের পানি এবং আশেপাশের দেওয়ালগুলা সাবান দিয়ে জীবাণুমুক্ত করা।
প্রায় অর্ধ শতাব্দী ধরে টয়লেটের জীবাণু নিয়ে গবেষণা করা গারবা বলেন, 'অনেকেই বলেছেন শুধু ঢাকনা বন্ধ করে ফ্লাশ করলেই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। কারণ ঢাকনা খোলা রেখে ফ্লাশ করলে যখন তীব্র গতিতে পানি নিচে নামে, তখন বর্জ্যের ছোট ছোট টুকরো স্প্রে আকারে বাতাসে মিশে গিয়ে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকে।'
আগের গবেষণাগুলোতে জানা গেছে, ঢাকনা বন্ধ রেখে ফ্লাশ করলে আশেপাশের দেওয়ালগুলোতে ব্যাকটেরিয়া দূষণের আশঙ্কা কমে।
তাই পাবলিক বাথরুমগুলোর ঢাকনাবিহীন টয়লেট থেকে জীবাণু কণা ছড়িয়ে পড়া সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানোর চেষ্টা করেছিলেন গবেষকরা।
গারবার দল বাড়ির বাথরুমের দেওয়াল ও মেঝেতে জীবাণু কণার উপস্থিতি সংক্রান্ত একটি গবেষণা করেছেন।
তারা দেখেছেন, ঢাকনা বন্ধ রেখে বাড়ির বাথরুমে ফ্লাশ করাতে খুব কম পার্থক্য দেখা গেছে।
অতীতের গবেষণাগুলো থেকে জানা যায়, টয়লেট ফ্লাশ থেকে ছড়ানো অ্যারোসোলাইজড কণা ক্রুজ জাহাজ, বিমানের ফ্লাইট ও স্কুলে নরোভাইরাস প্রাদুর্ভাবের সঙ্গে সম্পর্কিত।
গারবা বলেন, ঢাকনা বন্ধ করে ফ্লাশ করার পরেও একটি প্রমোদতরীতে খুব বাজে প্রাদুর্ভাব ছড়িয়ে পড়ে। পরে পরীক্ষায় দেখা গেছে ওই টয়লেটের অর্ধেক অংশে নরোভাইরাস কণা রয়েছে।
তিনি বলেন, 'তাই এ থেকে বাঁচতে আপনাকে সবসময় টয়লেটের সিট এবং রেস্টরুমের অন্যান্য অংশ নিয়মিত পরিষ্কার করতে হবে।'
গবেষণাটি কীভাবে করা হয়েছিল?
গারবার দল একটি অফিস ভবনের পাবলিক বাথরুম এবং একটি বাড়ির টয়লেট নিয়ে গবেষণা করে।
পাবলিক টয়লেটটিতে কোনো ট্যাংক ছিল না, এটি একটি স্টলের মধ্যে ছিল এবং একটি পানির নল দিয়ে ফ্লাশ করা হতো। অন্যদিকে,বাড়ির টয়লেটে একটি ছোট ট্যাংক ছিল।
এই দলে লাইসলসহ ভোগ্যপণ্য বিক্রিকারী ইংল্যান্ডভিত্তিক প্রতিষ্ঠান রেকিট বেনকিজারের গবেষকরাও ছিলেন।
গবেষকেরা টয়লেটগুলোতে ভাইরাল কণা ফেলে ফ্লাশ করেন এবং এক মিনিট পরে টয়লেট, আশেপাশের দেওয়ালগুলো ও মেঝেতে থাকা জীবাণুর পরিমাণ পরীক্ষা করেন।
গবেষকরা শুধু বাড়ির টয়লেট থেকে ঢাকনা বন্ধ করার তথ্য পরিমাপ করেছেন কারণ পাবলিক টয়লেটগুলোতে সাধারণত ঢাকনা থাকে না।
গবেষণায় বাড়ির টয়লেটের ঢাকনা ফ্লাশ করার আগে খোলা বা বন্ধ থাকায় সামগ্রিক ভাইরাল দূষণের কোনো পার্থক্য পাওয়া যায়নি।
তবে তারা জানিয়েছে, ঢাকনা বন্ধ রেখে ফ্লাশ করলে 'অ্যারোসোল প্লাম দূষণের গতিপথ' পরিবর্তন হতে পারে।
ঢাকনা বন্ধ করে ফ্লাশ করার পরে গবেষকরা টয়লেটের বাম দিকে এবং সামনে কিছুটা বেশি জীবাণুর উপস্থিতি লক্ষ্য করেছেন, তবে টয়লেটের ডানদিকে কিছুটা কম দূষণ পরিমাপ করেছিলেন।
এছাড়া, শুধু ব্রাশ দিয়ে পরিষ্কার করা টয়লেটের চেয়ে ব্রাশ ও জীবাণুনাশক হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড দিয়ে পরিষ্কার করা টয়লেটে কম দূষণ ছিল।
গবেষণায় বলা হয়েছে, জীবাণুনাশক দিয়ে টয়লেট পরিষ্কার করার ফলে আশেপাশের দেওয়াল, মেঝে ও টয়লেট ব্রাশে জীবাণু কম ছড়ায়।
সমীক্ষা অনুসারে, তাই জীবাণুর বিস্তার কমাতে ফ্লাশ করার পরে ব্রাশ ও জীবাণুনাশক দিয়ে বাথরুমের সব দেওয়াল ও মেঝে জীবাণুমুক্ত করা প্রয়োজন।
অন্য কথায়, আপনাকে প্রতিবার জীবাণুনাশক রাসায়নিক ও ব্রাশ দিয়ে টয়লেট পরিষ্কার করতে হবে। তারপর হাত ধুয়ে ফেলতে হবে।
হাসপাতালের রোগীরা বাথরুমের জীবাণু সংক্রমণের ঝুঁকিতে
অন্যান্য গবেষকরা দেখেছেন, ফ্লাশের পরে টয়লেট থেকে জীবাণু করা আশেপাশে ছড়িয়ে পড়ে এতে কোনো সন্দেহ নেই।
ইউনিভার্সিটি অব নেব্রাস্কা মেডিক্যাল সেন্টার কলেজ অব পাবলিক হেলথের অধ্যাপক ম্যাথিউ নোনেনম্যান জানান, তিনি টয়লেটের ঢাকনা বন্ধ রাখাটাকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন।
নোনেনম্যানের দল হাসপাতালের টয়লেট ফ্লাশ করা থেকে ছড়ানো কণা ও বায়োঅ্যারোসল নিয়ে গবেষণা করেছেন।
তার গবেষণায় দেখা গেছে, এ ধরনের দূষিত পদার্থ ফ্ল্যাশ করার পর ৩০ মিনিট পর পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে।
শক্তিশালী রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন স্বাস্থ্যকর মানুষ এই জাতীয় রোগজীবাণুগুলো মোকাবিলা করতে পারে। তবে হাসপাতালে থাকা দুর্বল রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন রোগীরা ক্লোস্ট্রিডিওডস ডিফিসিলের মতো ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণের জন্য সংবেদনশীল হতে পারে, এটি সি ডিফ নামেও পরিচিত।
ঢাকনা বন্ধ রাখা, জীবাণুনাশকের নিয়মিত ব্যবহার এবং হাত ধোয়া এই সমস্যা থেকে বাঁচতে সহায়তা করতে পারে।
নোনেনম্যান বলেন, 'আপনি যদি ঢাকনা বন্ধ রাখেন, তাহলে টয়লেট থেকে উড়ে আসা কিছু বড় জীবাণু কণা অন্তত কমে যাবে।'
বাথরুমের জীবাণু কমাতে আমি কি পদক্ষেপ নিতে পারি?
যদিও ইউএ-রেকিট বেনকিজারের গবেষণায় টয়লেটগুলো কতবার পরিষ্কার করা উচিত তা সুপারিশ করা হয়নি; তবে গারবা বলেন, নিয়মিত বাড়ি টয়লেট এবং আশেপাশের দেওয়াল ও মেঝে পরিষ্কার করা উচিত।
ব্যবহারের পর টয়লেটের হাতল পরিষ্কার করার জন্য জীবাণুনাশক রাখার পাশাপাশি জীবাণুনাশক ওয়াইপ রাখার পরামর্শ দেন তিনি।
গারবা বলেন, সবসময় হাত ভালোভাবে ধোয়া উচিত এবং হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করা উচিত, বিশেষত যদি বাড়ির কেউ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়।
যদি পরিবারের কোনো সদস্যের ডায়রিয়া হয়, তবে ওই বাড়ির বাথরুমে নরোভাইরাস বা সালমোনেলা থাকার মারাত্মক আশঙ্কা রয়েছে।
গারবা দিনে দুবার টয়লেট সিট, ফ্লাশার, মেঝে ও দেওয়াল জীবাণুমুক্ত করার পরামর্শ দেন।
অবশ্য পাবলিক টয়লেট দিনে কতবার পরিষ্কার করা হবে এ ব্যাপারে সাধারণ মানুষের কিছু করার নেই।
তবে মানুষ নিয়মিত হাত ধোয়া ও হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করে নিজেকে অনেকটাই রক্ষা করতে পারে।
নোনেনম্যান জীবাণুনাশক দিয়ে প্রতিদিন বাথরুম পরিষ্কার করার পাশাপাশি নিয়মিত হাত ধোয়া এবং টুথব্রাশ ও মুখে লাগানো প্রসাধনীগুলো টয়লেটের বাইরে রাখার পরামর্শ দেন।
আর মোবাইল ফোন নিয়ে কোনোভাবেই টয়লেটে প্রবেশ করা উচিত না। কারণ তাতে জীবাণু লেগে পরে তা মানুষের দেহে প্রবেশ করে।
ভাবানুবাদ: তাবাসসুম সুইটি