আর পচবে না ফসল: ফুড ইরেডিয়েশন কেন্দ্র স্থাপন করছে বিনা
ফসল সংগ্রহ-পরবর্তী ক্ষয়ক্ষতি ব্যাপকভাবে কমিয়ে আনার জন্য ফরিদপুরে একটি ফুড ইরেডিয়েশন কেন্দ্র স্থাপনের প্রকল্প হাতে নিয়েছে বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা)।
এই কেন্দ্রে ফসলকে আয়নাইজিং বিকিরণের সংস্পর্শে আনা হবে। ফলে ফসলের শেলফ লাইফ বাড়বে। একটি পণ্য যতদিন পর্যন্ত ব্যবহারযোগ্য থাকে, তা-ই ওই পণ্যের শেলফ লাইফ।
বিনা বলছে, ফরিদপুরে গামা ইরেডিয়েশন স্থাপনে ১৬০ কোটি টাকা খরচ হবে, এবং প্রযুক্তিটি পর্যায়ক্রমে সারা দেশে চালু করা হবে। কারণ প্রতি বছর দেশে মোট উৎপাদিত ফল ফসকের ২৫–৩০ শতাংশ সংগ্রহ-পরবর্তী সময়ে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এর ফলে প্রতি বছর প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা লোকসান দিচ্ছে বাংলাদেশ।
ইনস্টিটিউটের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ফরিদপুরে ইরেডিয়েশন পাইলট প্রকল্পে কৃষকরা তাদের পেঁয়াজ বিনামূল্যে গামা-রশ্মি দিয়ে বিকিরিত করতে পারবেন। প্রযুক্তিটি পূর্ণরূপে সচল হলে প্রযুক্তি ব্যবহারের জন্য কৃষকদের কাছ থেকে চার্জ নেওয়া হতে পারে।
ইরেডিয়েশন প্রযুক্তিতে প্রক্রিয়ায় বাল্ক বা প্যাকেটজাত কৃষিপণ্য ও খাদ্যদ্রব্যে নিয়ন্ত্রিত মাত্রায় গামা রে, এক্স-রে কিংবা ইলেক্ট্রন বিম প্রয়োগ করা হয়।
প্রযুক্তিটি কৃষিপণ্য ও খাদ্যদ্রব্যে প্রয়োগ করলে ক্ষতিকর পোকা ও কীটপতঙ্গ, পরজীবী, রোগজীবাণু এবং অণুজীব ধ্বংস হয় এবং পণ্যের পচন রোধ করে।
বিনার বিজ্ঞানীরা বলছেন, পেঁয়াজ ও আলুতে ইরেডিয়েশন প্রযুক্তি ব্যবহার করলে শেলফ লাইফ প্রায় ৩ মাস পর্যন্ত বাড়ে। প্রযুক্তিটির মাধ্যমে আমের ক্ষেত্রে ২০–২৫ দিন, লিচু ও কলায় ৭ দিন ও সবজিতে ২৫ দিন পর্যন্ত শেলফ লাইফ বাড়ানো সম্ভব।
বিনার মহাপরিচালক ড. মির্জা মোফাজ্জল ইসলাম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'দ্রুত পচনশীল কৃষিপণ্যের শেলফ লাইফ বাড়ানো গেলে তা বাজারজাতে বড় একটি পরিবর্তন আসবে। একইসঙ্গে যেসব কৃষি পণ্য রপ্তানি করা হয় সেগুলোর জন্য খুবই কম সময় পাওয়া যায়। শেলফ লাইফ বাড়ানো গেলে পণ্য দ্রুত পচে যাওয়া বা মান নষ্ট হয়ে যাওয়ার সমস্যাটার সমাধান করা সম্ভব।'
তিনি আরও বলেন, এ প্রযুক্তি কৃষিপণ্যের রপ্তানি বাড়াতে সাহায্য করবে।
খাদ্য বিকিরণ প্রযুক্তি খাদ্যের সুরক্ষা বাড়ায়। সেইসঙ্গে অণুজীব ও পোকামাকড় হ্রাস বা নির্মূল করে খাদ্যের শেলফ লাইফও বাড়ায়।
ইউএস ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফডিএ) ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে ইরেডিয়েশন করা খাবার নিয়ে গবেষণা করে দেখেছে। এফডিএর গবেষণায় এই প্রক্রিয়াটিকে নিরাপদ প্রমাণিত হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও), সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) ও ইউএস ডিপার্টমেন্ট অভ এগ্রিকালচারও (ইউএসডিএ) বিকিরিত খাবারকে নিরাপদ বলে অভিমত দিয়েছে।
সংগ্রহ-পরবর্তী ফসল নষ্টে প্রতি বছর ২০ হাজার কোটি টাকা লোকসান:
প্রতি বছর মোট উৎপাদিত ফসল ও ফলের ২৫–৩০ শতাংশ সংগ্রহ-পরবর্তী সময়ে নষ্ট হয়ে যায়। এতে বছরে বাংলাদেশের ক্ষতি প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা।
বিনার গবেষণা অনুসারে, সংগ্রহ-পরবর্তী সময়ে সবচেয়ে বেশি নষ্ট হয় পেঁয়াজ ও আম।
বিনা বলছে, উৎপাদিত পেঁয়াজের ২০–২৫ শতাংশই সংগ্রহের পর নষ্ট হয়ে যায়। তা-ও আবার সংরক্ষণের সময় পচে গিয়ে নষ্ট হয় অনেক পেঁয়াজ। এই লোকসানের আর্থিক মূল্য প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা।
অথচ ২৪–২৫ লাখ টন চাহিদার বিপরীতে ৩৩ লাখ টন পেঁয়াজ উৎপাদন করেও চাহিদা পূরণের জন্য আমদানির ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে বাংলাদেশকে।
আমের ক্ষেত্রে সংগ্রহ-পরবর্তী ক্ষতির পরিমাণ ৩০–৩৫ শতাংশ। আলুর ক্ষেত্রে এই ক্ষতি ৫–৮ শতাংশ, ধানে ৯ শতাংশ, ডালজাতীয় ফসলে এই ক্ষতির পরিমাণ ৬ শতাংশ।
বিনার মহাপরিচালক মির্জা মোফাজ্জল ইসলাম বলেন, ইরেডিয়েশন প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে সংগ্রহ-পরবর্তী ক্ষতি ৯০–৯৫ শতাংশ পর্যন্ত কমিয়ে আনা সম্ভব।
প্রতিবেশী দেশগুলো ইতিমধ্যে এই প্রযুক্তি ব্যবহার করছে:
অনেক উন্নত দেশেই খাদ্য নিরাপত্তা, নিরাপদ খাদ্য, কোয়ারেন্টিন ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বৃদ্ধির জন্য ইরেডিয়েশন প্রক্রিয়া ব্যবহার করা বাধ্যতামূলক।
এশিয়ার বিভিন্ন দেশেও দিন দিন প্রযুক্তিটির ব্যবহার বাড়ছে। এমনকি এ প্রযুক্তি ব্যবহারে পিছিয়ে নেই প্রতিবেশী দেশ ভারতও।
ভারত ২০০৭ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্র ও নিউজিল্যান্ডে আম রপ্তানির জন্য প্রযুক্তিটি ব্যবহার করছে। এই প্রযুক্তির সবচেয়ে বড় ব্যবহারকারী চীন হলেও মালয়শিয়া, ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান, থাইল্যান্ড, বিশেষ করে ভিয়েতনামে প্রযুক্তিটির ব্যবহার উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে।
গত প্রায় চার দশক ধরে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের অধীনস্থ সাভারের পরমাণু শক্তি গবেষণা প্রতিষ্ঠানে দুটি গামা বিকিরণ প্লান্ট ব্যবহার করা হচ্ছে। প্লান্ট দুটি রপ্তানিমুখী ওষুধ শিল্প ও মসলাজাতীয় পণ্যের উৎপাদন ও বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠানসমূহকে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে সেবা দিচ্ছে। তবে এই সেবা চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল।
অন্যদিকে দেশে কৃষিপণ্য ও খাদ্যদ্রব্যে ইরেডিয়েশন প্রযুক্তিটির ব্যবহার নেই বললেই চলে।
বিনা-সূত্রে জানা গেছে, ফরিদপুরের ইরেডিয়েশন কেন্দ্রটি স্থাপন করা হলে বছরে ৮৫ হাজার মেট্রিক টন কৃষিপণ্যে গামা রেডিয়েশন প্রয়োগ করা যাবে। এতে প্রায় ১২৫ কোটি টাকা মূল্যের কৃষিপণ্যের পচন রোধসহ পোকা ও কীটপতঙ্গ থেকে রক্ষা করা সম্ভব হবে।