ইইউ'র কার্বন শুল্ক বসানোর সিদ্ধান্তে বিপাকে বাংলাদেশ
বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি বাজার ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) আমদানি পণ্যের ওপর কার্বন ট্যাক্স আরোপের উদ্যোগ নিয়েছে। এ সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের তৈরি পোশাক ও টেক্সটাইল পণ্য, চামড়াজাত পণ্য, প্লাস্টিক ও কৃষিপণ্য রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে এমনটাই আশঙ্কা করছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
২০১৯ সালের ডিসেম্বরে ইউরোপীয় ইউনিয়ন 'গ্রিন ডিল' কর্মসূচীর ঘোষণা দিয়েছে। এ কর্মসূচী বাস্তবায়নের মাধ্যমে ২০৫০ সাল নাগাদ জিরো কার্বন নিঃসরণ জোটে রূপান্তরের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। এর আওতায় ইইউ'র বাইরের দেশগুলো থেকে পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে কার্বন ট্যাক্স আরোপ করার ঘোষণা দেওয়ায় রপ্তানিকারক দেশগুলো চিন্তিত হয়ে পড়েছে। ইতোমধ্যে চীন, প্যারাগুয়ে, উরুগুয়ে ও যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন নিয়ে ইইউর এই উদ্যোগের বিরুদ্ধে রাশিয়া বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় (ডব্লিউটিও) অভিযোগ করেছে।
গ্রিন ডিলের আওতায় ইইউ ৪৪টি খাতে কার্বন ট্যাক্স আরোপের পরিকল্পনা করছে। রাসায়নিক পণ্য, ধাতব পণ্য, কাগজ ও মিনারেল পণ্য এবং টেক্সটাইল, তৈরি পোশাক, ফার্মাসিউটিক্যাল, চামড়াজাত পণ্য তৈরিতে ও প্লাস্টিক খাতে উচ্চ মাত্রায় কার্বন নিঃসরণ হওয়ায় এসব ক্ষেত্রে সরাসরি এ করের প্রভাব পড়বে। এসব পণ্য উৎপাদনে প্রতিটন কার্বন নিঃসরণের ওপর ভিত্তি করে কর আরোপ করবে ২৬টি দেশের একক বাজার ইইউ। কর হার কতো হবে এবং কীভাবে তার হিসাব করা হবে, তা চলতি বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে ঘোষণা করবে ইউরোপীয় কমিশন।
বাংলাদেশের মোট রপ্তানির অর্ধেকেরও বেশি রপ্তানি হয় ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে। গত অর্থবছরে ইউরোপে বাংলাদেশের রপ্তানির পরিমাণ ছিল ১৮ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার। অস্ত্রবাদে সকল পণ্যে বাংলাদেশ শুল্কমুক্ত রপ্তানি সুবিধা পেয়ে থাকে। 'কার্বন বর্ডার এডজাস্টমেন্ট মেকানিজমে'র অংশ হিসেবে ইইউ আমদানি পণ্যে কার্বন ট্যাক্স আরোপ করলে তা বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের এ উদ্যোগ বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাক, টেক্সটাইল, চামড়াজাত পণ্য, প্লাস্টিক ও কৃষিপণ্য রপ্তানিতে করারোপ হওয়ার আশঙ্কা করছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এ প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় ইইউ-রাশিয়ার মধ্যে পক্ষ নির্বাচনের ব্যাপারে গত ৫ জানুয়ারি আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ও ডব্লিউটিও সেলের মহাপরিচালক মো. হাফিজুর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ওই সভায় ইইউর উদ্যোগ কার্যকর হলে বাংলাদেশের রপ্তানি ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কার তথ্য উঠে আসে। তা সত্ত্বেও ২০২৩ সালের জন্য ইইউ'র জিএসপি সুবিধার পর্যালোচনায় ইউরোপে বাংলাদেশের জিএসপি সুবিধা অব্যাহত রাখার স্বার্থে এ বিষয়ে ইইউ'র বিপক্ষে প্রকাশ্যে অবস্থান না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ।
হাফিজুর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, আমদানি পণ্যের ওপর কার্বন ট্যাক্স আরোপ হলে দেশের রপ্তানি পণ্যের সবচেয়ে বড় গন্তব্যস্থল ইউরোপে বাংলাদেশের রপ্তানি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বিশেষ করে অধিক কার্বন নিঃসরণকারী খাতগুলোতে বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাক ও টেক্সটাইল প্রথম সারিতে রয়েছে।
তুলা থেকে তৈরি পোশাক উৎপাদন পর্যন্ত বিভিন্ন স্তরে ব্যবহৃত কেমিকেল, জ্বালানি ও পানি ব্যবহারে যে পরিমাণ কার্বন নিঃসরণ হয়, তার ভিত্তিতে এই কর আরোপ হবে।
হাফিজুর রহমান বলেন, বাংলাদেশ ইউরোপে বিপুল পরিমাণ প্লাস্টিক, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য এবং কৃষিপণ্য রপ্তানি করে। কৃষিকাজে ব্যবহৃত সার উৎপাদন ও সেচেও কার্বন নিঃসরণ হয়। প্লাস্টিক, চামড়া ও ফার্মাসিউটিক্যাল খাতে বিপুল পরিমাণ রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার হয়, যা উৎপাদনে কার্বন নিঃসরণ হয়।
'ইউরোপীয় ইউনিয়নের এই উদ্যোগের বিরোধীতা করে রাশিয়া ডব্লিউটিওতে অভিযোগ করেছে। যদিও ডব্লিউটিওতে এভাবে আমদানি পণ্যের ওপর কার্বন ট্যাক্স আরোপের বিধান নেই। তবুও বাংলাদেশ কোন পক্ষেই অবস্থান স্পষ্ট করবে না।' যোগ করেন তিনি।
তৈরি পোশাক শিল্পের সাথে সংশ্লিষ্টরা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-কে জানান, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার নীতিমালায় কার্বন ট্যাক্স আরোপের ব্যাপারে স্পষ্টভাবে কিছু বলা নেই। তবে নীতিমালা অনুযায়ী কোনো দেশ চাইলে পরিবেশ ও মানব স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর এধরনের আমদানিকৃত পণ্যের ক্ষেত্রে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিল অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন জানান, গ্রিন ডিলের ৪৪টি খাতে টেক্সটাইল খাত সংযোজন ও কার্বন ট্যাক্স আরপের ব্যাপারে তার পরিষ্কার ধারণা নেই।
তিনি বলেন, তৈরি পোশাক খাতে বাংলাদেশ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানিকারক হওয়ায়, টেক্সটাইল ও তৈরি পোশাক শিল্পে কার্বন ট্যাক্স আরোপ হলে এর বড় প্রভাব পড়বে বাংলাদেশের ওপর। তবে বিস্তারিত তথ্য জানার আগে এনিয়ে মন্তব্য করা সমীচিন হবে না বলে জানান তিনি।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার মানুফ্যাকচারারস অ্যান্ড এক্সপোর্টারস অ্যাসোসিয়েশনের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ হাতেম জানান, ইইউ'র ক্রেতারা অতিরিক্ত দামে পণ্য কিনবেন না, ফলে কার্বন ট্যাক্স আরোপের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বাংলাদেশের রপ্তানি খাতে।
তিনি বলেন, ইইউ ভুক্ত দেশগুলোতে তৈরি পোশাকের ক্রমবর্ধমান চাহিদা ও রানা প্লাজা ধসের পর যুক্তরাষ্ট্রের চাহিদা মেটাতে বড় পরিসরে বিনিয়োগে ভূমিকা রাখেনি ব্র্যান্ডগুলো।
"কার্বন নিঃসরণ কমাতে প্রয়োজনীয় প্রযুক্তির ব্যবহারেও আমাদের বড় পরিসরে বিনিয়োগ প্রয়োজন। একারণে কার্বন ট্যাক্স আরোপের আগেই ইইউ'র কাপড়ের ন্যায্য মূল্য নির্ধারণ করা প্রয়োজন।" যোগ করেন তিনি।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন নিজস্ব উৎপাদনকারীদের ওপর ২০০৫ সাল থেকে ইমিশন ট্রেডিং সিস্টেম (ইটিএস) নামে কার্বন শুল্ক আরোপ করেছে। এতে প্রতি টন কার্বন নিঃসরণের বিপরীতে ৩০ ইউরো করে কর দিতে হয়।
ডব্লিউটিও মোস্ট ফেভার্ড নেশন পলিসির সঙ্গে যাতে সাংঘর্ষিক না হয়, সেজন্য আমদানি পণ্যের ওপরও কমবেশি একই হারে করারোপ করা হতে পারে বলে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক বাণিজ্য গবেষণা সংস্থাগুলো অনুমান করছে। আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থাগুলো বলছে, ইইউ'র বিশ্ব বাণিজ্যে বড় ধরণের প্রভাব পড়বে এই উদ্যোগের ফলে। সৌদি আরব ও মধ্যপ্রাচ্যের জ্বালানি তেলের তুলনায় রাশিয়ার জ্বালানি তেলে কার্বন নিঃসরণের মাত্রা বেশি হওয়ায় আন্তর্জাতিক বাজারে রাশিয়ার তেল বিক্রি কমে যাবে। চীন, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশের স্টিল ও ইস্পাত রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
বিশ্ব অর্থনীতি ও কর্মসংস্থানের অন্যতম বড় খাত টেক্সটাইল, গার্মেন্ট, লেদার ও ফুটওয়্যার (টিজিএলএফ) পরিবেশ দূষণেও মারাত্বক ভূমিকা রাখছে বলে ইইউ'র তথ্যে উঠে এসেছে। টেক্সটাইলখাতে বিশেষ করে ডাইং ও ফিনিশিং পর্যায়ে প্রায় ১ হাজার ৯০০ ধরনের রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহৃত হয়। এর মধ্যে ১৬৫টি রাসায়নিক পদার্থকে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে ইইউ।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন জানিয়েছে, অর্থনীতিকে পরিবেশবান্ধব ভবিষ্যতের জন্য উপযোগী করার মাধ্যমে পরিবেশ রক্ষা ও গ্রাহকদের অধিকার নিশ্চিত করে প্রতিযোগীতার বাজারে ইউরোপের অবস্থান শক্ত করাই কার্বন ট্যাক্স বসানোর মূল প্রতিপাদ্য।
চক্রাকার অর্থনীতি গড়ে তোলার জন্য উৎপাদন পরিকল্পনা করা হচ্ছে নতুন এ পরিকল্পনায়। ইইউ'র বাজারে পণ্যের দীর্ঘস্থায়িতা, সহজেই পণ্যের মেরামত, পুনর্ব্যবহারযোগ্যকরণ ও প্রাথমিক কাঁচামালের পরিবর্তে যথাসম্ভব পুনর্ব্যবহারযোগ্য উপাদান ব্যবহারের ওপর জোর দেয়া হয়েছে।
টেক্সটাইল খাতে উদ্ভাবন বাড়াতে এবং ইইউ'র বাজার চাঙ্গা করতে নতুন কৌশল নির্ধারণের প্রস্তাবনা দিয়েছে ইউরোপিয়ান কমিশন। প্রাথমিক কাঁচামাল ও পানি ব্যবহারের দিক দিয়ে চতুর্থ, কার্বন নিঃসরণে দিক দিয়ে পঞ্চম অবস্থানে আছে টেক্সটাইল খাত। নতুন চাহিদার ধরন ও ব্যবসায়িক কাঠামোর ওপর ভিত্তি করেই নতুন কৌশল প্রণয়ন করা হবে।
টেক্সটাইল খাতের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্যও আলাদা নির্দেশনা দেয়া হবে, যা সদস্য দেশগুলোকে ২০২৫ সালের মধ্যে নিশ্চিত করতে হবে।
গত ডিসেম্বরে ইউরোপীয় কমিশনের প্রকাশিত এক নথিতে দেখা যায়, টেক্সটাইল খাতে প্যাকেজিং কমিয়ে ও গ্রিনওয়াশিং এর মাধ্যমে নিষ্কাশিত বর্জ্যের পরিমাণ কমাতে সহায়তা করবে ইকোনমি অ্যাকশন প্ল্যান।
গবেষণায় দেখা গেছে, আন্তর্জাতিক বিমান ফ্লাইট ও জাহাজ পরিবহনের চেয়েও তৈরি পোশাক ও জুতা উৎপাদনে বেশি কার্বন নিঃসরণ হয়।
বর্তমানে বছরপ্রতি ৯ কোটি ২০ লাখ টন কার্বন নিঃসরণের জন্য দায়ী টেক্সটাইল ও তৈরি পোশাক খাত।