ইভ্যালির ২ লাখ গ্রাহকের পাওনা ৩১১ কোটি টাকা
বিতর্কিত ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম ইভ্যালির কাছে ২ লাখেরও বেশি গ্রাহকের ৩১১ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে জানিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে কোম্পানিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ রাসেল দাবি করেছেন, 'ভোক্তাদের সাথে একটি আস্থার জায়গাও বজায় আছে।'
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দেওয়া কারণ দর্শানোর নোটিশের জবাবে বুধবার ডাব্লিউটিও সেলের মহাপরিচালক-১ এর কাছে লিখিত প্রতিবেদনে রাসেল বলেছেন, গত ১৫ জুলাই পর্যন্ত ইভ্যালির কাছে গ্রাহকদের মোট পাওনা ৩১০,৯৯,১৭,৮০২ টাকা। মোট ২,০৭,৭৪১ জন গ্রাহকের কাছে কোম্পানিটির এই পরিমাণ দায় সৃষ্টি হয়েছে।
বিপুল ডিসকাউন্টের লোভ দেখিয়ে ৭ থেকে ৪৫ দিনের মধ্যে পণ্য ডেলিভারির প্রতিশ্রুতি দিয়ে এসব গ্রাহকদের কাছ থেকে ইভ্যালি অগ্রিম ৩১১ কোটি টাকা নিলেও তাদের পণ্য সরবরাহ করেনি। গত বছরের ডিসেম্বর মাসে অগ্রিম মূল্য পরিশোধ করা অনেক গ্রাহক এখনও পণ্য পাননি। ইভ্যালি যেসব গ্রাহকদের রিফান্ড চেক দিয়েছে, ব্যাংক একাউন্টে টাকা না থাকায় সেগুলোও বাউন্স হচ্ছে।
গত জুন মাসে বাংলাদেশ ব্যাংকের দাখিল করা পরিদর্শন প্রতিবেদনে গ্রাহকদের পাওনার পরিমাণ ছিল ২১৪ কোটি টাকা। ইভ্যালির নিজস্ব তথ্যে জানা গেল, গ্রাহকদের কাছে কোম্পানিটির দেনার পরিমাণ আরও ৯৭ কোটি টাকা বেশি।
'একজন গ্রাহক এক বা একাধিক অর্ডার দিয়ে থাকেন। এ সকল গ্রাহকের বেশিরভাগই গত দুই বছর ৬ মাস (ইভ্যালির মোট কার্যকাল) সময়ের মধ্যে বিভিন্ন অর্ডার করেছেন এবং সফলভাবে ডেলিভারিও পেয়েছেন'- প্রতিবেদনে দাবি করেছেন মোহাম্মদ রাসেল।
কোম্পানিটি লিখেছে, ডেলিভারি কার্যক্রমে ইভ্যালি নিজস্ব গুদাম থেকে পণ্য তৃতীয় পক্ষ বা ডেলিভারি কোম্পানির মাধ্যমে ডেলিভারি করে থাকে। তবে, মোট অর্ডারের ১২-১৫ শতাংশ এভাবে ডেলিভারি করা হয়। অর্ডারের বাকি পণ্য মূলত বিক্রেতা বা সরবরাহকারী তাদের নিজ দায়িত্বে ডেলিভারি করে থাকেন। এসব বিক্রেতা ও সরবরাহকারীও ডেলিভারি কোম্পানির উপর নির্ভরশীল।
ইভ্যালি লিখেছে, বিভিন্ন কোম্পানি ডেলিভারি দেওয়ার পর তার প্রমাণ উপস্থাপন করলে তখন আমাদের সিস্টেমে পণ্যটি ডেলিভারি দেখানো হয়। ডেলিভারির এই নিশ্চয়তার ক্ষেত্রে বিভিন্ন তৃতীয়পক্ষ- সরবরাহকারী ও ডেলিভারি কোম্পানিগুলোর উপর নির্ভরতা থাকে।
'এসব ক্ষেত্রে যদি কোন কারণে গ্রাহক পণ্য না পায়, তখনই গ্রাহক আমাদের সঙ্গে সরাসরি নির্দিষ্ট বা সহনশীল সময়ের মধ্যে যোগাযোগ না করলে ডেলিভারি সম্পন্ন হয়েছে বলে আমাদের ধরে নিতে হয়'- যোগ করেছেন মোহাম্মদ রাসেল।
২০১৮ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে ইভ্যালি এখন পর্যন্ত ৭০ লাখেরও বেশি অর্ডার ডেলিভারি সম্পন্ন করেছে দাবি করে তিনি বলেছেন, কিছু সংখ্যক গ্রাহক, যারা তাদের পণ্য পায়নি, তা সম্পূর্ণ অনাকাঙ্ক্ষিত।
'তবে পর্যাপ্ত সময় প্রদান এবং ব্যবসায়ের অনুকূল পরিবেশ সাপেক্ষে আগামী ৬ মাসে আমরা সম্পূর্ণ অর্ডার সরবরাহ করতে সক্ষম হবো। ইকমার্সের সার্বিক উন্নয়নের জন্য এবং গ্রাহক ও সরবরাহকারীদের আস্থার জন্য ব্যবসার অনুকূল পরিবেশ অত্যন্ত জরুরি এবং এর কোন বিকল্প নেই। এই পরিবেশ তৈরিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অগ্রণী ভূমিকার জন্য আমরা আশাবাদী'- যোগ করেছেন তিনি।
গত ১৫ জুলাই পর্যন্ত ক্রেতাদের থেকে নেওয়া অগ্রিম, পণ্য সরবরাহকারীদের পাওনা এবং অন্যান্য ব্যবসায়ীক বকেয়াসহ ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মটির মোট দায় ৫৪৩ কোটি টাকা ধার্য করা হয়েছিল। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া বিবৃতিতে শেয়ারহোল্ডার ইক্যুইটির জন্য অতিরিক্ত এক কোটি টাকা দেনার কথাও উল্লেখ করা হয়েছে।
যার মানে, বর্তমানে ইভ্যালির মোট ঋণ প্রায় ৫৪৪ কোটি টাকা, যা জুনে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদনে উল্লেখিত পরিমাণের চেয়ে ১৪০ কোটি টাকা বেশি।
তবে ইভ্যালির দেনা সম্পর্কিত বিবৃতিতে ক্রেতা ও মার্চেন্টদের কাছে কী পরিমাণ দেনা রয়েছে, তা পৃথক পৃথকভাবে উল্লেখ করা হয়নি।
কোম্পানিটি আরো জানায়, তাদের স্থায়ী ও অস্থায়ী সম্পদের মোট মূল্য ১২১ কোটি টাকা। অর্থাৎ, সব সম্পদ বিক্রি করলেও গ্রাহক ও সরবরাহকারীদের কাছে তাদের বর্তমান দেনার মাত্র ২২.৩০ শতাংশ পরিশোধ করা যাবে।
ইভ্যালির ব্যাল্যান্স শিট অনুসারে, কোম্পানির মোট অস্থায়ী সম্পদের পরিমাণ ১৫ কোটি ৮২ লাখ টাকা। এছাড়া স্থায়ী সম্পত্তি হিসাবে প্রতিষ্ঠানের নামে সম্পত্তি একটি কারখানা ও সেখানকার যন্ত্রপাতির মূল্য ১৪ কোটি ৮৭ লাখ টাকা। এর বাইরে, কোম্পানির চলতি সম্পদ রয়েছে ৯০ কোটি ৬৬ লাখ টাকা।
ইভ্যালির মোট দেনা থেকে তাদের স্থাবর-অস্থাবর সকল সম্পদ বাদ দেওয়ার পরও ৪২২ কোটি টাকা ঘাটতি রয়ে যায়। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া ব্যাল্যান্স শিটে, ঘাটতির সমপরিমাণ বা ৪২২ কোটি ৬২ লাখ টাকা ব্র্যান্ড ভ্যালু হিসাবে উল্লেখ করেছে কোম্পানিটি।
কিন্তু, বিশেষজ্ঞরা এ দাবির সাথে সহমত নন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাবের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মিজানুর রহমান দ্য বিজন্যাস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "ব্যবসায়ের টেকসই মডেল অনুসারে পরিচালিত না হওয়ায় ইভ্যালির প্রকৃত ব্র্যান্ড ভ্যালু এখন নেতিবাচক অবস্থানে। তার ওপর গত দুই বছর কোম্পানিটি যে পরিমাণ দেনা সৃষ্টি করেছে, তার ফলে আগামীতে কোনো সম্পদই সৃষ্টি করতে পারবে না।"
"এখন যদি ইভ্যালি ১০০ টাকার পণ্য ৫০ টাকাতেও বিক্রি শুরু করে, ক্রেতারা আর আগ্রহী হবেন না। যে কোম্পানি ক্রেতাদের মূল্য পরিশোধ বা পণ্য সরবরাহ করতে পারে না, তার কোনদিন ইতিবাচক ব্র্যান্ড ভ্যালু সৃষ্টি হয় না। তাই প্রকৃত ব্র্যান্ড ভ্যালু ইভ্যালির দাবীকৃত ব্র্যান্ড ভ্যালুর সমপরিমাণ নেতিবাচক (মাইনাস) অঙ্ক হওয়া উচিত।"
এর আগে গত ১২ আগস্ট ইভ্যালির সম্পদ ও দায়, কোম্পানিটির কাছে গ্রাহক ও মার্চেন্টদের পাওনার পরিমাণ এবং তা পরিশোধের পরিকল্পনা জানাতে ইভ্যালিকে সর্বোচ্চ ২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময় দিয়ে চিঠি দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
ওই চিঠিতে ২৬ আগস্টের মধ্যে কোম্পানিটির কাছে গ্রাহকদের দায়-দেনার পরিমাণ জানাতে নির্দেশ দেয় মন্ত্রণালয়।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ও কেন্দ্রীয় ডিজিটাল কমার্স সেলের প্রধান মো. হাফিজুর রহমান বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, বিকেল ৫টা পর্যন্ত ইভ্যালির জবাব না পাওয়ার প্রেক্ষিতে কোম্পানিটির সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তখন তারা জানায় যে, লিখিত জবাব মন্ত্রণালয়ের ডেসপাচে জমা করেছে।