উপসাগরীয় অর্থনীতির উজ্জ্বল সম্ভাবনায় দুর্দিন কাটছে প্রবাসী কর্মসংস্থানে
প্রবাসী আয় প্রবাহ যখন ধারাবাহিক পতনের মুখ দেখছে, সাম্প্রতিক মাসগুলোতে ঠিক তখনই বেড়েছে বাংলাদেশের শ্রমশক্তি রপ্তানি। যা আগামীতে রেমিট্যান্সে সুদিন ফেরার ইঙ্গিত দিচ্ছে। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের চড়ামূল্যের সুবাদে উপসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলো দ্রুত পুনরুদ্ধারের পথে থাকার কারণেই বেড়েছে বাংলাদেশের শ্রমশক্তি রপ্তানি।
জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্যানুসারে, অক্টোবরে বিদেশে চাকরিপ্রাপ্তদের সংখ্যা ৬৫ হাজার ছাড়িয়েছে, যা আগের মাসের চেয়ে ৫৫ শতাংশ বেশি। গেল বছরের আগস্টে কোভিডজনিত ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা উঠে গিয়ে প্রবাসী কর্মসংস্থান বাজার ফের সচল হওয়ার পর, যা এক মাসে সবচেয়ে বেশি শ্রমিক অভিবাসনের ঘটনা।
এ বছরের অক্টোবরে বছরওয়ারি হিসাবেও শ্রমিক অভিবাসন ৭৬ শতাংশ বেড়েছে।
মহামারিপূর্ব সময়ে, প্রতিমাসে গড়ে ৬০ হাজার বাংলাদেশি বিভিন্ন দেশে চাকরি পেতেন, যার অধিকাংশ নিয়োগ হতো মধ্যপ্রাচ্যে। কিন্তু কোভিড-১৯ পরিস্থিতি গত বছর সংখ্যাটি ব্যাপকভাবে কমিয়ে আনে এবং ওই বছরের এপ্রিল-জুন মাসে কোনও অভিবাসন হয়নি।
মধ্যপ্রাচ্য দেশের বৃহত্তম শ্রম রপ্তানি বাজার। জীবাশ্ম জ্বালানি তেলের ক্রমশ চড়াদরের কারণে গালফ কো-অপারেশন কাউন্সিল (জিসিসি) ভুক্ত ছয়টি তেল রপ্তানিকারক দেশের অর্থনীতিতে জোরালো বিকাশের আশাও করা হচ্ছে।
একারণেই এখন প্রবাসী কর্মসংস্থান বৃদ্ধির প্রবণতা দেখছে বাংলাদেশ। অধিকাংশ কর্মসংস্থান হচ্ছে, জিসিসিভুক্ত সৌদি আরব, ওমান, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েতসহ মধ্যপ্রাচ্যের জর্ডান এবং দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দেশ সিঙ্গাপুরে।
উদাহরণস্বরূপ- উপসাগরীয় অঞ্চলে বাংলাদেশি প্রবাসীদের শীর্ষ গন্তব্য হলো সৌদি আরব। চলতি বছরের জানুয়ারি- অক্টোবর পর্যন্ত দেশটিতে চাকরি পেয়েছেন প্রায় তিন লাখ বাংলাদেশি, যা এসময়ে হওয়া মোট বৈদেশিক কর্মসংস্থানের ৭৮ শতাংশ।
জ্বালানি তেলসমৃদ্ধ দেশটিতে অক্টোবরে চাকরি পেয়েছেন ৫১ হাজার ৪৭২ জন বাংলাদেশি, যা জুন মাসে হওয়া ৪৪ হাজার ৯৮৫ জনের চাকরির চেয়ে অনেকটা বেড়েছে। তবে জুলাইয়ে সংখ্যাটি ছিল বেশ কম, এসময় মাত্র ১১,২৮২ বাংলাদেশি সৌদিতে নিয়োগ পান। আগস্টে তা কিছুটা বেড়ে ১৪ হাজার ৯১৯ জনের নিয়োগ হয় এবং সেপ্টেম্বরে নিয়োগ পান ৩১ হাজার ২৩৮ জন।
চলতি নভেম্বরে পরিচ্ছন্নতা কর্মী ও নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে আরও ৪০-৫০ হাজার বাংলাদেশি সৌদি আরব যাবেন বলে আশা করা হচ্ছে।
বিদ্যমান তথ্যসূত্রে আরও জানা যাচ্ছে, কুয়েত, লেবানন, মরিশাস, ইতালি এবং যুক্তরাজ্যেও অল্প সংখ্যক বাংলাদেশির নিয়োগ ঘটছে।
এব্যাপারে ফোর-সাইট ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সির সত্ত্বাধিকারী শাহাদাত হোসেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "সৌদি আরব থেকে আমরা এখন মাসে ২৫০ জন পরিচ্ছন্নতা কর্মীর চাহিদা পাচ্ছি। নিয়োগদাতারা ২০-২৭ হাজার টাকা মাসিক বেতন অফার করছেন।"
সৌদি যেতে মাথাপিছু এক লাখ ৮০ হাজার থেকে ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা লাগলেও এ দেশের বিদেশ গমনেচ্ছুকদের থেকে তারা (সৌদি নিয়োগদাতারা) ভালো সাড়া পাচ্ছেন না, বলেও জানান তিনি।
অদক্ষ শ্রমিকেরা মধ্যপ্রাচ্যের চেয়ে তুলনামূলক ভালো পরিবেশ ও বেতনের সুযোগ থাকায় বরং মালয়েশিয়া যেতেই বেশি আগ্রহী। তবে ২০১৮ সাল থেকেই বন্ধ রয়েছে মালয়েশিয়ার শ্রম বাজার, যা আগামী বছর সচল হওয়ার আশা করা হচ্ছে।
শাহাদাত বলেন, বাংলাদেশি অভিবাসীদের দ্বিতীয় বৃহত্তম গন্তব্য সংযুক্ত আরব আমিরাত ফের তাদের শ্রমবাজার খুলে দিয়েছে, কিন্তু সেটা খুবই সীমিত পরিসরে।
বর্তমানে, সংযুক্ত আরব আমিরাতে প্রায় ২০০ নির্মাণ শ্রমিক এবং নিরাপত্তারক্ষীর চাহিদা রয়েছে।
নিয়োগকারীরা বলেছে, অভিবাসী কর্মীরা ভিজিট ভিসায় সংযুক্ত আরব আমিরাত যাওয়ার পরেও চাকরি পেতে পারেন।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অভ ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সির (বায়রা) সাবেক মহাসচিব শামীম আহমেদ চৌধুরী নোমান বলেন, "কিছু দেশের কর্মীদের জন্য ভিজিট ভিসায় তিন মাসের জন্য সংযুক্ত আরব আমিরাতে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে। তারপরে তারা সেগুলোকে ওয়ার্ক ভিসায় রূপান্তরিত করতে পারেন এবং চাকরির চুক্তি অনুসারে একটি নির্দিষ্ট সময় সেখানে থাকতে পারেন।"
এছাড়াও রোমানিয়া, পোল্যান্ড ও সাইপ্রাসের মতো কিছু ইউরোপীয় দেশেও কিছু চাকরির চাহিদা রয়েছে।
করোনা মহামারির মধ্যে বাংলাদেশে নজিরবিহীন রেমিট্যান্স প্রবাহ আসে। গত বছরের জুলাইয়ে ২৬০ কোটি ডলার প্রবাসী আয় আসে দেশে। যা একক মাসের জন্য রেকর্ড। কিন্তু সেই রেমিট্যান্স প্রবাহ এখন হ্রাস পাচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ১ নভেম্বর প্রকাশিত তথ্য অনুসারে, চলতি অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবর সময়কালে বাংলাদেশি প্রবাসীরা মোট ৭ দশমিক শূন্য ৫ বিলিয়ন ডলার দেশে পাঠিয়েছেন, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ২০ শতাংশ কম ।
রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিট (রামরু) গত ডিসেম্বরে প্রাক্কলন করেছিল যে, ২০২০ সালে করোনা মহামারির কারণে বছরে অভিবাসনের হার আগের বছরের তুলনায় প্রায় ৭১ শতাংশ কমেছে।
২০১৯ সালে সাত লাখের বেশি নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত বাংলাদেশি বিদেশে যায়। কিন্তু বিএমইটি থেকে পাওয়া তথ্য অনুসারে, গত বছর বিদেশে পাড়ি জমান মাত্র ২ লাখ ১৭ হাজার কর্মী। মহামারির মধ্যে প্রায় ৫ লাখ অভিবাসী দেশে ফিরে এসেছেন এবং বৈদেশিক কর্মসংস্থানের হার গত বছর উল্লেখযোগ্যভাবে কম ছিল।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, "আমরা এখন যে রেমিট্যান্স পাচ্ছি, তা আসছে 'স্টক মাইগ্রেন্টস' থেকে। যে শ্রমিকরা এখন অভিবাসন করছেন, তারা আগামী বছরগুলোতে ধীরে ধীরে রেমিট্যান্স প্রবাহে অবদান রাখবেন।"
গত কয়েক মাসের মতো নিকট-ভবিষ্যতেও বাংলাদেশ রেমিট্যান্সে ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি দেখতে পারে। তবে ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি একটা অঙ্কে এসে থেমে যেতে পারে বলে মন্তব্য করেন ড. মোস্তাফিজুর রহমান।
তিনি বলেন, "আমার মনে হয় গত অর্থবছরের মতো চলতি অর্থবছরে ২৪ বিলিয়ন ডলারের বেশি রেমিট্যান্স পাওয়া সম্ভব হবে না। তবে আমরা ২০-২১ বিলিয়ন ডলার পেতে পারি, যা মহামারিপূর্ব প্রবাহের চেয়ে কিছুটা বেশি হবে।"