উপার্জন বাড়াতে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের নতুন উদ্যোগ
রাজধানীর গুলশানে বহুতল বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণ করতে সিটি বন্ড ছাড়ার উদ্যোগ নিয়েছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। বন্ড ছেড়ে প্রায় ১০০০ কোটি টাকা উত্তোলন করে নির্মিতব্য ভবন ভাড়া ও স্পেস বিক্রির আয়ে অর্থনৈতিকভাবে স্বনির্ভর হতে চায় করপোরেশনটি।
ভবিষ্যতে সিটি করপোরেশনের অন্যান্য মার্কেট ভবন নির্মাণেও একইভাবে বন্ড ইস্যুর পরিকল্পনা করছে নাগরিক সেবাদাতা সংস্থাটি। এসব ভবন থেকে আয়ের অর্থ নাগরিক সেবায় ব্যয় করবে ডিএনসিসি।
বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের কর্মকর্তারা জানান, ভবন নির্মাণে সিটি বন্ড ছেড়ে পুঁজিবাজার থেকে অর্থ উত্তোলনের ডিএনসিসির প্রস্তাব চূড়ান্ত অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। নগর উন্নয়ন কিংবা অবকাঠামো উন্নয়নে এটিই হবে বাংলাদেশের প্রথম বন্ড।
গত সেপ্টেম্বর মাসে বন্ড ছাড়ার অনুমোদন চেয়ে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে চিঠি লিখেছিলেন ডিএনসিসি মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম। গত মাসে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় আবেদনটি অর্থমন্ত্রণালয়ে পাঠানোর পর ইতোমধ্যে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল তাতে সম্মতি দিয়েছেন।
বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলাম দ্য বিজনেস স্টান্ডার্ডকে (টিবিএস) বলেন, ডিএনসিসির সিটি বন্ড ইস্যুর আবেদনটি নিয়ে কমিশনে আলোচনা হয়েছে। কমিশন এটির অনুমোদন দেবে। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের পাশাপাশি ব্যক্তি বিনিয়োগকারীরাও এই বন্ডে বিনিয়োগ করতে পারবেন।
'গুলশান সুপার মার্কেট-২ নির্মাণের জন্য ডিএনসিসি সিটি বন্ড ছাড়বে। আমাদের সঙ্গে আলাপ করে ডিএনসিসি চূড়ান্ত প্রস্তাব প্রস্তুত করছে। কত টাকা বাজার থেকে তুলবে, কুপন রেট কত হবে, সেগুলো সেখানে উল্লেখ থাকবে। তবে সাধারণত এ ধরনের বন্ডে ৬-৭ শতাংশ রেট নির্ধারণ করা হয়,' জানান বিএসইসি প্রধান।
তিনি বলেন, সরকার দীর্ঘমেয়াদী অর্থায়নের সুযোগ সৃষ্টি করতে বন্ড মার্কেটের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে। অবকাঠামো উন্নয়নে বন্ড ইস্যু এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এতে বন্ড মার্কেটের বিস্তৃতি বৃদ্ধির পাশাপাশি অবকাঠামো সংকট দূর করা সম্ভব হবে।
ডিএনসিসি মেয়র আতিকুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, 'ডিএনসিসি দেশে প্রথমবারের মতো সিটি বন্ড ইস্যু করতে যাচ্ছে। এর মাধ্যমে বাজার থেকে মূলধন নিয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াব আমরা। রাজধানীর গুলশান এলাকায় ভবনটি নির্মাণ করব।'
'বহুতল একটি মার্কেট বা বাণিজ্যিক ভবন করতে গেলে করপোরেশনকে সরকারের কাছ থেকে অর্থ নিতে হয়। এজন্য দীর্ঘসময় অপেক্ষা করতে হবে। এখন আমরা সাবলম্বী হওয়ার জন্য স্টক মার্কেট থেকে টাকা তুলব। সিটি বন্ডের এই নিশ্চয়তা আছে, যে, আমরা বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে পালিয়ে যাব না,' যোগ করেন তিনি।
আতিক আরও বলেন, 'এটা টেস্ট কেস হিসেবে নিচ্ছি। সফল হলে অন্যান্য মার্কেট নির্মাণেও সিটি বন্ডের মাধ্যমে বিনিয়োগের তহবিল সংগ্রহ করা হবে। ডিএনসিসি সরকারের ওপর নির্ভরশীল হয়ে থাকতে চায় না।'
ডিএনসিসির একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, সিটি করপোরেশনের মার্কেট ভবনগুলো বড় আকারের হয়ে থাকে। এ ধরনের একটি বহুতল ভবন করতে বিপুল অর্থের প্রয়োজন হয়। প্রাথমিকভাবে ডিএনসিসি বন্ড ইস্যুর মাধ্যমে কম-বেশি ১০০০ কোটি টাকা উত্তোলনের পরিকল্পনা করছে। রেটসহ বিএসইসির অনুমোদনের পরই মূলধন উত্তোলনের কাজ শুরু হবে।
সিটি বন্ড ইস্যুর আবেদনে ডিএনসিসি মেয়র লিখেছেন, উত্তর সিটি করপোরেশনে যুক্ত হওয়া ১৮টি ওয়ার্ডের রাস্তাঘাট নির্মাণসহ নাগরিকদের সেবা নিশ্চিত করা, পরিচ্ছন্ন কার্যক্রম পরিচালনা, মশক নিধনসহ নিয়মিত বিভিন্ন কাজে করপোরেশনের আয়ের অর্থ ব্যয় হয়ে যায়। তাই নিজস্ব আয় দিয়ে একটি বহুতল বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণ করা ডিএনসিসির পক্ষে সম্ভব নয়। তাই নিজস্ব আয়ে ভবন নির্মাণের জন্য মতো অর্থ ডিএনসিসির নেই। এ কারণেই সিটি বন্ড ইস্যু করে তহবিল সংগ্রহ করা প্রয়োজন।
প্রতিবেশি দেশ ভারত ও পাকিস্তানে মিউনিসিপাল বন্ড চালু রয়েছে। ওইসব দেশে এ বন্ডের জনপ্রিয়তা রয়েছে। বাংলাদেশেও এ ধরনের বন্ডে বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ থাকবে বলে মনে করছেন পুঁজিবাজার বিশ্লেষকরা।
সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ও বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, সিটি করপোরেশন বন্ড ছেড়ে অর্থ সংগ্রহের উদ্যোগ নিলে তা অবশ্যই ভালো উদ্যোগ। কিন্তু বন্ডে বিনিয়োগের অর্থ কোথায় ব্যয় করা হবে, সেখান থেকে কী পরিমাণ অর্থ রিটার্ন আসবে তা বিবেচনায় নিয়ে অনুমোদন দিতে হবে। এক্ষেত্রে মুনাফার হার কতো নির্ধারণ করা হবে, তাও গুরুত্বপূর্ণ।
'আমাদের সিটি করপোরেশন ও পৌরসভাগুলোর আয় খুবই কম। তাই বন্ড অনুমোদনের ক্ষেত্রে বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ সুরক্ষার বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে,' জানান তিনি।
স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ বলেন, বন্ড ইস্যু করে উন্নয়ন ব্যয় মেটানোর উদ্যোগ নিঃসন্দেহে প্রশংসাযোগ্য। তবে পুঁজিবাজার থেকে সংগ্রহ করা অর্থ ব্যয়ে সুশাসন ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে।
১৮৬৪ সালে প্রতিষ্ঠিত ঢাকা মিউনিসিপাল ১১২ বছর পর সিটি করপোরেশনে পরিবর্তিত হয়। ২০১১ সালে ঢাকা শহর বিভক্ত করে উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নামে স্বতন্ত্র দুটি করপোরেশন গঠিত হয়। করপোরেশন দুটির মধ্যে ডিএনসিসির আয় তুলনামুলকভাবে বেশি।
২০১৯-২০২০ অর্থবছরে ডিএনসিসির বাজেট ছিল ৩ হাজার ৫৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে আয় ১ হাজার ১১৫ কোটি টাকা, সরকারি অনুদান থেকে থোক বরাদ্দ ১০০ কোটি টাকা, সরকারি বিশেষ অনুদান ছিল ৫০ কোটি টাকা। এছাড়া, সরকারি ও বৈদেশিক সাহায্যপুষ্ট প্রকল্প থেকে আয় ১ হাজার ৫৬৫ কোটি টাকা।