এফএএস ফাইন্যান্স: ১৩০০ কোটি টাকা জালিয়াতিতেও পিকে হালদারের সেই একই কৌশল
বাংলাদেশের আর্থিক খাতে বড় জালিয়াতির উদাহরণ কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেডের (আইএলএফএসএল) সাবেক ব্যাবস্থাপনা পরিচালক প্রশান্ত কুমার (পিকে) হালদার ও তার সহযোগিদের অন্তত ১০ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া। পিপলস লিজিং, ইন্টারন্যাশনাল লিজিংসহ বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জালিয়াতিতে তারা প্রায় একই ধরণের কৌশল নিয়েছিল।
নামসর্বস্ব কাগুজে প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ অনুমোদন করিয়ে নিজস্ব স্বার্থ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে ওইসব অর্থ সরিয়ে নেয় পিকে হালদার ও তার সহযোগিরা। এসব ক্ষেত্রে পিকে হালদার কাজে লাগিয়েছেন তাঁর বন্ধু বান্ধব, আত্মীয়-স্বজনসহ পরিচিতজনদের।
এফএএস ফাইন্যান্সে পিকে হালদার ও তার সহযোগীদের ১৩০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার ঘটনায় দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদকের এক তদন্ত প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। একই রকম তথ্য এসেছিল ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ে জালিয়াতির ঘটনায় পাওয়া তথ্যে।
দুদক সূত্র জানিয়েছে, এফএএস ফাইন্যান্স ও ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ে জালিয়াতির ঘটনায় আরও ২০টি মামলা করতে যাচ্ছে সংস্থাটি। এসব মামলায় অন্তত ৭৫ জন আসামি হতে যাচ্ছেন।
যাদের বিরুদ্ধে মামলা হচ্ছে তারা হলেনেএফএএস ফাইন্যান্সের চেয়ারম্যান সিদ্দিকুর রহমান, ভাইস চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আলম, সাবেক পরিচালক উজ্জল কুমার নন্দী, পরিচালক বীরেন্দ্র কুমার সোম, এমএ হাফিজ, সোমা ঘোষ, আতাহারুল ইসলাম, পিকে হালদারসহ ৭৫ জন।
সূত্র আরও জানায়, পিকে হালদারকে সহায়তার অভিযোগ অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর এসকে সুর চৌধুরী ও নির্বাহী পরিচালক শাহ আলমকে শিগগিরই দুদকে তলব করা হবে।
দুদকের প্রতিবেদেনের তথ্যমতে, এফএএস ফাইন্যান্স থেকে কনিকা এন্টারপ্রাইজের এর নামে ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল ঋণ নেওয়া হলেও ঋণের অর্থের সরাসরি অন্য ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নামে স্থানান্তর করা হয়।
২০১৬ সালের ০৮ মার্চ তিনটি চেকের মাধ্যমে টোটাল ট্রান্সপোর্টেশন লিঃ এর নামে স্ট্যান্ডার্ড চাটার্ড ব্যাংকের ১১.৫০ কোটি টাকা জমা হয়। একই মাসে তিনটি চেকের মাধ্যমে ৬.৭০ কোটি টাকা স্বপন কুমার মিস্ত্রির মালিকানাধীন সন্দীপ কর্পোরেশনের নামে ব্যাংক এশিয়া লিঃ এর ধানমন্ডি শাখায় পরিচালিত হিসাবে স্থানান্তর করা হয়।
মার্কেন্টাইল ব্যাংক লিঃ এর গ্রাহক প্রতিষ্ঠান প্রসেসিং প্ল্যান্ট লিমিটেডের ব্যাংক হিসাবে (চেয়ারম্যান: রতন কুমার বিশ্বাস) ৩.৩০ কোটি টাকা সরিয়ে নেওয়া হয় ওই মাসেই। হাল ইন্টারন্যাশনাল লিঃ এবং মুন এন্টারপ্রাইজের নামে ব্যাংক এশিয়া লিঃ এর ধানমন্ডি শাখায় ০১ কোটি টাকা করে মোট দুই কোটি টাকা স্থানান্তর করা হয় ২১ সেপ্টেম্বর।
একইভাবে দুদকের প্রতিবেদনে দেখা গেছে এমওএইচ ফ্যাশন লিঃ এর নামে ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল হিসেবে ঋণ নেয়া হলেও ঋণের সমুদয় অর্থ ফ্যাশন প্লাস লিঃ এর নামে মার্কেন্টাইল ব্যাংক লিঃ এর প্রগতি স্মরণি শাখায় সরিয়ে নেয়া হয়।
এমটিবি মেরিন লিমিটেডের নামে ঋণ নেওয়া হলেও সে অর্থ এমটিবির ব্যাংক হিসাবে না গিয়ে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবে সরিয়ে নেয়া হয়।
দুদকের অনুসন্ধান বলছে, এভাবে ২০টি কাগুজে প্রতিষ্ঠানকে প্রায় ১৩০০ কোটি টাকা ঋণ দেয়া হয় যার কোন টাকা এই প্রতিষ্ঠানগুলোর হিসাবে যায়নি। এই টাকা পি কে সিন্ডিকেটের বিভিন্ন হিসাবে বিতরণ করা হয়েছে।
২০ টি কাগুজে প্রতিষ্ঠান হলো: এস,এ এন্টারপ্রাইজ, মুন ইন্টার ন্যাশনাল লি:, সুখাদা প্রোপার্টিজ লি:, ন্যাচার এন্টার প্রাইজ, আরবি এন্টার প্রাইজ, দিয়া শিপিং লি:, নিউটেক এন্টারপ্রাইজ, নিউট্রিক্যাল লি:, মের্সাস বর্ন, কণিকা এন্টারপ্রাইজ, দ্রিনান এ্যাপারেলস, এন্ড বি এন্টারপ্রাইজ, এমার এন্টারপ্রাইজ, জিএন্ডজি এন্টারপ্রাইজ, তামিম এন্ড তালহা, হাল ইন্টারন্যাশনাল, মেরিন ট্রাস্ট লি:,আর্থস্কোপ,এমটিবি মেরিন।
এফএএস ফাইন্যান্স এন্ড ইনভেস্টমেন্ট লি: এ ২০১৪ সালের শেষের দিকে পিকে হালদার সিন্ডিকেট শেয়ার কিনে প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ হাতে নেয়। এরপর কৌশলে পুরাতন কর্মচারীদের ছাটাই করে তাদের পছন্দ মতো কর্মচারী নিয়োগ প্রদান করেন। রাসেল শাহরিয়ারকে এমডি হিসেবে নিয়োগ প্রদান করা হয়। রাসেল শাহরিয়ার হলো পি,কে হালদারের পূর্ব পরিচিত এবং ২০০৭ সালে তারা একই প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেছিল। মূলত উজ্জ্বল কুমার নন্দী তার পছন্দ মতো পরিচালনা পর্ষদে পরিচালক নিয়োগ দেন। সিদ্দিকুর রহমান এবং জাহাঙ্গীর আলম হলেন পি,কে হালদারের বন্ধু এবং ব্যবসায়িক পার্টনার। সে সুবাদে ফাস ফাইন্যান্স এর দায়িত্ব পড়ে সিদ্দিক ও জাহাঙ্গীরের হাতে। অস্তিত্বহীন কোন কোন প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দিতে হবে এ সিদ্ধান্ত আগেই পি,কে হালদার দিয়ে দিতেন। লোক দেখানো বোর্ড মিটিং হতো এবং বোর্ডে এমডিকে ডেকে বলে দেয়া হতো এ সকল বোর্ডের ফাইল এবং দ্রুত ঋণের ব্যবস্থা করো। রাসেল শাহরিয়ার প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব যাচাই ছাড়াই এবং কোন মর্টগেজ না নিয়ে তার একক স্বাক্ষরে ক্রেডিট মেমো প্রস্তুত করে বোর্ডে উপস্থাপন করে ঋণ অনুমোদন করে নিতো এবং পি,কে হালদারের অনুরোধে ঋণের অর্থ পি,কে সিন্ডিকেটের হিসাবে পাঠিয়ে দিতো। টেকওভার করা ঋণের অর্থও টেকওভারকৃত প্রতিষ্ঠানের হিসাবে না দিয়ে পি,কে সিন্ডিকেটের ব্যক্তিগত এবং বিভিন্ন অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানে পাঠিয়ে দিতো।
দুদকের ওই সূত্রটি আরও জানিয়েছে, মূলত ফাস ফাইন্যান্স এন্ড ইনভেস্টমেন্ট লি: এর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা অসৎ উদ্দেশ্যে ক্ষমতার অপব্যবহার করে প্রতারণার মাধ্যমে অপরাধমূলক বিশ্বাসভঙ্গ করে কোন রুপ ঋণ আবেদন গ্রহণ না করেই যাচাই বাছাই ছাড়াই কোন মর্টগেজ গ্রহণ ব্যতিরেকে প্রায় ২০ টি কাগুজে ঋণগ্রহীতা প্রতিষ্ঠানকে ভূয়া ঋণ পাইয়ে দিতে সহযোগিতা করেন এবং বেনিফিসিয়ারীদের দ্বারা ফাস ফাইন্যান্স থেকে প্রায় ১৩০০ কোটি টাকা আত্মসাতের রহস্য উৎঘাটনে তিন দিনে উক্ত প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান, পরিচালনা পর্ষদ, ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ আরো যারা আত্মসাতে জড়িত ২২ কর্মকর্তাকে দুদকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।
জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যানসহ পরিচালকরা ঋণ অনুমোদনে তাদের অনিয়মের কথা স্বীকার করেছেন। এ প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছেন যে, পি,কে হালদার প্রায় সময়ই এমডি রাসেল শাহরিয়ারের রুমে আসত এবং বোর্ড মিটিং প্রায়ই উপস্থিত থাকতো। যদিও পিকে হালদার এ প্রতিষ্ঠানের কেউ ছিলেন না।
সূত্রটি বলেছে, দুদকের অনুসন্ধানে প্রাথমিকভাবে এফএএস ফাইন্যান্স থেকে জালিয়াতির মাধ্যমে ঋণ নেয়া পি,কে হালদারের ২২ টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ২০ টিই কাগুজে ও অস্তিত্বহীন হিসেবে প্রতীয়মান হয়েছে। সরেজমিনে পরিদর্শন করে ২০ টি প্রতিষ্ঠানকে বর্ণিত ঠিকানায় পাওয়া যায় নি। ২ টি প্রতিষ্ঠানকে পাওয়া গেলেও তাও বন্ধ রয়েছে।
পরবর্তীতে, ফাস ফাইন্যান্সের সহকারী ম্যানেজার মো: নুরুল আমিনের নেতৃত্বে চার সদস্যেও একটি টিম দুই সপ্তাহ সরেজমিনে পরিদর্শন করেও ২০টি প্রতিষ্ঠানকে বর্ণিত ঠিকানায় খুজে পায় নি। ঋণ নেয়া ঐসব প্রতিষ্ঠানের মালিকরাও তাদের বাসায় থাকেন না বা বিদেশে পলাতক করেছেন। জালিয়াতির মাধ্যমে ঋণ নেয়া এসব প্রতিষ্ঠানের ঋণের বিপরীতে মর্টগেজ নেই বললেই চলে। ফলে ঋণের টাকা আদায়ের আর কোন সম্ভাবনা নাই।
পিকে হালদারের জালিয়াতির ঘটনায় এ পর্যন্ত ১০টি মামলা করেছে দুদক। দুদকের তথ্যমতে, ১০টি মামলায় মোট আসামি করা হয়েছে মোট ৬৭ জনকে। এঁদের বেশিরভাগই প্রায় সব মামলাতেই আসামি।
প্রায় ২৭৫ কোটি টাকা অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে গত বছরের ৮ জানুয়ারি পিকে হালদারের বিরুদ্ধে দুদক আরেকটি মামলা করে।
বিদেশে থাকা পিকে হালদার গত বছরের ২৮ জুন আইএলএফএসএলের বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কাছে তার দেশে ফেরার জন্য ব্যবস্থা নিতে আবেদন করেন।
আদালত তাতে অনুমতি দিলেও পিকে হালদার না ফেরায় ইন্টারপোলের মাধ্যমে তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়। ঢাকার বিশেষ জজ আদালত আগেই পি কে হালদারের সব স্থাবর সম্পত্তি ক্রোক করারও আদেশ দিয়েছে।