ভারতে ইডি দায়ী হলে বাংলাদেশে কে?
পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদ কোথায়? দুই সপ্তাহ আগেও এ নিয়ে সাধারণ মানুষের তেমন একটা গা ছিল না। বেনজীরের অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) আদালত থেকে তার সম্পত্তি ক্রোক করার অনুমতি পাওয়ার পর। সেই আদেশ অবশ্য এরকম না যে এক সকালে ঘুম ভেঙে দুদকের হঠাৎ মনে হয়েছিল, সাবেক আইজিপি মহা দুর্নীতি করেছেন; তাই তার সম্পত্তি ক্রোক করতে হবে, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করতে হবে। ওই আদেশের আগে কিছু ঘটনাপ্রবাহ আছে। দৈনিক কালের কণ্ঠ পত্রিকায় তাকে নিয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ছাপা হয়েছিল। হাইকোর্টে এক আইনজীবী রিট করেছিলেন। ব্যবস্থা চেয়ে দুদকে আবেদন করেছিলেন ব্যারিস্টার সায়েদুল হক সুমন, এমপি।
এমন অবস্থায় এপ্রিল মাসের তৃতীয় সপ্তাহে অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। প্রাথমিক অনুসন্ধানে তার বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদের সন্ধান পাওয়ার পর ২৩ ও ২৬ মে দুদফায় দুদকের আবেদনে বেনজীরের সম্পদ ক্রোক করার আদেশ দেন আদালত। দুদকের অনুসন্ধানে পাওয়া সম্পত্তি ছাড়াও বিপুল সম্পদের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে। ঢাকায় আলিশান চারটি ফ্ল্যাট এবং গ্রামের বাড়ি গোপালগঞ্জ-মাদারীপুর ছাড়াও কক্সবাজার ও বান্দরবানে তার সম্পত্তির খোঁজ পাওয়া গেছে। গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, ব্যাংকে থাকা বিপুল পরিমাণ টাকা আদালতের নির্দেশ পৌঁছানোর আগেই তিনি তুলে নিয়েছেন।
সবচেয়ে বড় বিষয়, স্ত্রী-কন্যাসহ বেনজীর আহমেদ নিরুদ্দেশ হয়ে গেছেন। যখন মনে হচ্ছিল বড় এক দুর্নীতিবাজের বিরুদ্ধে সরকার নজির তৈরি করে ব্যবস্থা নিচ্ছে, তখন এরকম ব্যবস্থায় মানুষ আশাবাদী হচ্ছিল। কিন্তু এখন তাদের হদিস না পাওয়া যাওয়ায় ওই ব্যবস্থা কতটা শাস্তি নিশ্চিত করতে পারবে, তা নিয়ে মানুষের মধ্যে আবার সন্দেহও দেখা দিচ্ছে। সকলের মধ্যে তাই প্রশ্ন: কোথায় বেনজীর?
তার অবস্থান সম্পর্কে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন: 'তাকে আমরা এখনও নিষেধাজ্ঞা দিইনি। সে যদি নিষেধাজ্ঞার আগে চলে গিয়ে থাকে...। আমি এখনো কিন্তু সঠিক জানি না, সে আছে নাকি চলে গেছে। আমাকে জেনে কথা বলতে হবে। তিনি আছেন কি না, না আছেন, সেটা আমি এখনও সুনিশ্চিত নই। আমার পুলিশ বাহিনী অনেক ভালো কাজ করছে, অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে। কোনো ব্যক্তি যদি কিছু করে থাকে, তার দায় প্রতিষ্ঠান নেয় না।' (দৈনিক প্রথম আলো)।
পুলিশ বাহিনী অবশ্যই বেনজীরের দায় নেবে না। মেনে নিলাম যে বেনজীরের দায় বেনজীরেরই। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে যখন একজনের বিরুদ্ধে দুদক অনুসন্ধান করছে, অনুসন্ধানে তার অবৈধ অনেক সম্পদের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে, সেই সম্পদ ক্রোক করতে আদালত নির্দেশ দিচ্ছে; তখন ওই ব্যক্তি লাপাত্তা হয়ে যায় কীভাবে!
প্রশ্নটি আরও বেশি করে এজন্য উঠছে, তিনি এক ধরনের নিরাপত্তা বলয়ের মধ্যে ছিলেন। প্রথম আলোর আরেকটি প্রতিবেদন অনুযায়ী '…স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সেই সময়ের বিজ্ঞপ্তি বলছে, তাঁকে গাড়িসহ সাদাপোশাকের ছয়জন পুলিশ সদস্যের একটি দল নিরাপত্তা দেবে। তিনি দুজন সশস্ত্র দেহরক্ষী পাবেন। তার বাসায় তিনজন পাহারাদার থাকবে।'
এখন একসময়ের র্যাবপ্রধান হিসেবে মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় থাকা বেনজীর আহমেদ যদি সত্যিই বিদেশে পালিয়ে গিয়ে থাকেন তাহলে তাকে বিচারের মুখোমুখি কীভাবে করা যাবে? আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের কথায় আপনি আশ্বস্ত হতে পারেন। তিনি বলেছেন, 'বেনজীর আহমেদ দোষী সাব্যস্ত হলে তাকে দেশে ফিরতেই হবে। সরকার কোনো ছাড় দেবে না।'
কিন্তু অতীত অভিজ্ঞতায় মানুষ যে খুব আশাবাদী হতে পারবে, সেটা বলা যাচ্ছে না। ব্যাংক ঋণের হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করে দেশের বাইরে পলাতক থাকা দুইশজনের তালিকা করলেও তাদের কাউকে দেশে ফিরিয়ে আনতে পারেনি দুদক। বিচার করা তো অনেক দূরের কথা। শত কোটি টাকা পাচার মামলায় অভিযুক্ত হলেও এখনো গায়েবই আছেন বেসিক ব্যাংককে ডোবানো আব্দুল হাই বাচ্চু।
আর সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা লোপাট করে গায়েব হওয়া পিকে হালদার এখন ভারতের কারাগারে বন্দি থাকলেও তাকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের মুখোমুখি করার ক্ষেত্রে কোনো অগ্রগতি নেই। সর্বশেষ খবর অনুযায়ী, কলকাতায় পিকে হালদারের মায়ের মৃত্যু হলেও পিকে এবং তার আরেক ভাই জামিন না পাওয়ায় এক সপ্তাহ পরও অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া হতে পারেনি। মঙ্গলবার আবার জামিন আবেদনের শুনানি হওয়ার কথা থাকলেও এর বিরোধিতা করছে ভারতের এনফোর্সমেন্ট ডাইরেক্টরেট বা ইডি।
এই ইডির বিরুদ্ধে চলতি সপ্তাহে একচোট নিয়েছে মুম্বাইয়ের একটি আদালত। অর্থ কেলেঙ্কারির একটি মামলায় ব্যোমেশ শাহ নামে এক ব্যবসায়ী আদালতে এসেছিলেন তার ওপর বিদেশে যেতে নিষেধাজ্ঞা শিথিল করার আবেদন নিয়ে। ইডি এর বিরোধিতার সঙ্গে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলে, ব্যোমেশকে বিদেশ ভ্রমণের অনুমতি দিলে তিনি দেশ ছেড়ে পালাতে পারেন। ফলে পলাতক ব্যবসায়ীদের তালিকায় তার নামও যোগ হতে পারে। সে সময় পলাতক ব্যবসায়ী নীরব মোদী, বিজয় মালিয়া এবং মেহুল চোক্সির উদাহরণ দেয় ভারতের কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা ইডি।
সংবাদমাধ্যম 'বার অ্যান্ড বেঞ্চ'কে উদ্ধৃত করে আনন্দবাজার পত্রিকা এক প্রতিবেদনে বলেছে, এতে বিচারক এমজি দেশপাণ্ডে মন্তব্য করেন: তদন্তকারী সংস্থাগুলি সময়মতো পদক্ষেপ না করার জন্যই ওই ব্যবসায়ীরা পালিয়ে যেতে পেরেছেন। তিনি বলেন, 'আমি দু'পক্ষের যুক্তি এবং সওয়াল-জবাব খতিয়ে দেখেছি। এটা উল্লেখ করা দরকার যে, এই সমস্ত ব্যবসায়ীরা পালাতে পেরেছেন, কারণ সংশ্লিষ্ট তদন্তকারী সংস্থা তাদের গ্রেফতার করতে ব্যর্থ হয়েছে।'
ভারতীয় আদালতের ওই বিচারকের বক্তব্য একদম পরিষ্কার। ইডির মতো সংস্থাগুলোর সময়মতো পদক্ষেপ না থাকার কারণেই ব্যবসায়ী নীরব মোদী, বিজয় মালিয়া এবং মেহুল চোক্সির মতো লোকজন পালিয়ে যেতে পেরেছেন। বাংলাদেশ থেকে যে বেনজীর আহমেদ, পিকে হালদার এবং আব্দুল হাই বাচ্চুর মতো লোকজন পালিয়ে যেতে পেরেছেন তার জন্য আমরা কাকে দায়ী করব?
- বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফলন। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়।