এবার নিজ কর্মীদের জিম্মি করছে ইভ্যালি
অগ্রিম টাকা ও পণ্য নিয়ে কাস্টমার ও সেলারদের অনিশ্চয়তায় ফেলার পর এবার নিজ কর্মীদেরও জিম্মি করছে বিতর্কিত ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম ইভ্যালি।
প্রত্যেক কর্মীকে মাসে ৫০ লাখ টাকার নতুন সেলার আনার টার্গেট দিয়ে ২৩ আগস্ট এক সভায় ইভ্যালির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ রাসেল বলেছেন, যারা প্রতি মাসে ৫০ লাখ টাকার সেলার আনতে পারবেন না, তারা যেনো চাকরি ছেড়ে চলে যান।
জুলাই থেকে বকেয়া থাকা বেতন-ভাতা আগামী অক্টোবর-নভেম্বরের আগে হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই বলেও জানিয়ে দিয়েছেন তিনি।
ইভ্যালির বিভিন্ন স্তরের একাধিক কর্মকর্তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
তবে ইভ্যালির এমডি মোহাম্মদ রাসেল এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, মাসে ৫০ লাখ টাকার সেলার আনার টার্গেট দেওয়া কিংবা নভেম্বরের আগে স্যালারি না দেওয়া কথা 'সম্পূর্ণ বানোয়াট ও মিথ্যা'। এমন কোন কথা তিনি বলেননি।
"যেহেতু কিছু কর্মী চাকরি ছেড়েছে, তাই তারা উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে এমন কথা বলতে পারে"- যোগ করেন তিনি।
ইভ্যালির একাধিক কর্মী জানান, গত ২৩ আগস্ট ওই সভায় কর্মীদের মোহাম্মদ রাসেল বলেছেন, "টি-১০ অফারে পাওয়া অর্ডার ছাড়া ইভ্যালির হাতে আর কোন ব্যাক-আপ নেই। তাই অক্টোবর-নভেম্বরের আগে কেউই স্যালারি আশা করবেন না। এতে যাদের ইচ্ছা চাকরি করেন, না হলে চলে যান।"
আর যারা থাকবেন, তাদের প্রত্যেককে মাসে ৫০ লাখ টাকার বাকিতে পণ্য দেওয়ার মতো সেলার বা মার্চেন্ট আনতে হবে। এক্ষেত্রে পুরনো সেলার বাদ দিয়ে নতুন সেলার আনার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি।
এর আগে ১৯ আগস্ট ইভ্যালির বিভিন্ন বিভাগের প্রধানদের নিয়ে এক সভায় তিনি বলেছিলেন, আগামী দু-তিন মাসের আগে বেতন দেওয়া স্বাভাবিক হওয়ার সম্ভাবনা কম।
কোম্পানিটির একজন কর্মকর্তা জানান, জুন মাসের বেতন জুনিয়র কর্মকর্তাদের জুলাই মাসে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সিনিয়র কর্মকর্তাদের দেওয়া হয়নি। আর জুলাইয়ের বেতন কেউই এখনও পাননি।
গত ১১ আগস্ট কোম্পানিটির মানবসম্পদ বিভাগ থেকে সব কর্মীকে একটি ফরম ইমেইল করে বলা হয়, পুরো বেতন দেওয়া সম্ভব নয়।
কর্মীদের ন্যূনতম কী পরিমাণ টাকা জরুরি প্রয়োজন তা জানিয়ে ফিরতি ইমেইল পাঠাতে বলা হয়। কর্মীরা ফিরতি ইমেইল পাঠালেও এখন পর্যন্ত কাউকে কোন টাকা দেওয়া হয়নি বলে জানিয়েছেন কয়েকজন কর্মকর্তা।
এ বিষয়ে রাসেল দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "মে মাসের স্যালারি সবাই জুনে পেয়েছে। জুনের স্যালারি কিছু এমপ্লয়ি ফুল ও কিছু আংশিক স্যালারি পেয়েছে, যা জুলাইতে দেওয়া হয়েছে। জুনে আমরা সিনিয়ররা কেউই বেতন নেইনি।
অক্টোবর- নভেম্বরের আগে বেতন হবে না- এমন কথাও বলেননি বলে দাবি করেছেন মোহাম্মদ রাসেল।
তিনি বলেন, "যারা চাকরি ছাড়ছেন, তাদের সার্ভিস বেনিফিট দেওয়ার মতো অবস্থা এখন আমাদের নেই। আমরা পরে দেব বলে তাদেরকে জানিয়েছি।"
ইভ্যালির একটি বিভাগের প্রধানের পদ থেকে চাকরি ছেড়েছেন, এমন এক কর্মকর্তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "ব্যক্তিগতভাবে যোগাযোগ করে কোন কর্মকর্তা সেলার আনার পর ওই সেলার থেকে পণ্য নিয়ে তার পাওনা পরিশোধ করা হয় না। তখন ওই সেলার যে কর্মকর্তার মাধ্যমে ইভ্যালির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে, পাওনা আদায়ের জন্য ওই কর্মকর্তার ওপর চাপ দেন। অনেকের বাসায়ও হুমকি যাচ্ছে।"
এ অবস্থায় কোন কর্মকর্তার পক্ষে নতুন করে সেলার আনা সম্ভব নয়। এ কারণেও অনেকেই চাকরি ছেড়ে দিচ্ছেন। তার বিভাগের অনেক কর্মকর্তাই চাকরি ছেড়েছেন বলে জানান তিনি।
বকেয়া বেতন কবে পাওয়া যেতে পারে, কর্মীদের এমন প্রশ্নে ইভ্যালির মানবসম্পদ বিভাগ (এইচআর) বিভাগ থেকে বলা হচ্ছে, আগামী অক্টোবর-নভেম্বরের আগে বকেয়া বেতন পাওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই।
কোন কর্মকর্তা চাকরি ছাড়ার নোটিশ দিলে, নোটিশকালীন সময় পর্যন্ত অপেক্ষা না করে তাকে তাৎক্ষণিকভাবে অব্যাহতি দেওয়া হচ্ছে। তবে তাদের কোন সার্ভিস বেনিফিট দেওয়া হচ্ছে না।
ইভ্যালির একজন কর্মকর্তা জানান, "আমি দুই মাস ধরে বেতন পাচ্ছি না। এই বেতন পাওয়ার জন্য আমি আরও তিন-চার মাস ফ্রিতে কাজ করতে রাজী নই। তাই আমি চাকরি ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।"
কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ রাসেল নিজে গত ৫ জুন সাড়ে ৪ লাখ টাকা বেতন পেয়েছেন। গত এপ্রিল মাসে ঈদ-উল ফিতরের সময় তিনি নিজের সাড়ে ৪ লাখ টাকা বেতনের পাশাপাশি সমপরিমাণ বোনাস নিয়েছেন। এছাড়া, ঈদের সময় ওভারটাইম ডিউটি হিসেবে অতিরিক্ত ৫০ হাজার টাকা নিজের স্যালারি একাউন্টে ট্রান্সফার করেছেন।
রাসেল বলেন, "আমি সর্বশেষ মে মাসের বেতন জুনে নিয়েছি। ওই সময় সবাই তাদের বেতন পেয়েছে।"
তিনি বলেন, "পরিচালন ব্যয় কমাতে আমরা কিছু এমপ্লয়ি কমাচ্ছি।"
ছাঁটাই না করে কীভাবে কর্মী কমাচ্ছেন, এমন প্রশ্নে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে তিনি বলেন, "আমরা কাউকে ছাঁটাই করছি না। কর্মীরা টাইমলি স্যালারি চায়। আমরা দিতে পারছি না। তাই তারা চলে যাচ্ছে। আমরা তাদের ধরে রাখতে পারছি না।"
ইভ্যালির কর্মকর্তাদের হোয়াটসঅ্যাপে অল এমপ্লয়ি গ্রুপ, ট্রিম গ্রুপ, অফার গ্রুপসহ অনেকগুলো গ্রুপ ছিল। কোম্পানিটির প্রতিটি বিভাগের কর্মীদের আলাদা আলাদা হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপও রয়েছে। হোম অফিসের সময়কালে এসব গ্রুপে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ ছাড়াও কোম্পানির লেনদেনের বিভিন্ন তথ্যসহ এক্সেল ফাইল লেনদেন করতেন কর্মকর্তারা। সেসব গ্রুপ ডিলিট করতে বাধ্য করা হয়েছে কর্মকর্তাদের।
ইভ্যালির একজন কর্মকর্তা জানান, গত ১৯ আগস্ট কোম্পানির চেয়ারম্যান শামীমা নাসরিন হঠাৎ করেই ইন্টারনাল হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপগুলো ডিলিট করে প্রমাণ হিসেবে তার স্ক্রিনশট পাঠাতে বলেন। তার নির্দেশনা মতো গ্রুপগুলো ডিলিট করে স্ক্রিনশট পাঠানো হয়েছে।
পরে আবার নতুন করে গ্রুপ খুলতে নির্দেশনা দেন শামীমা। সে মোতাবেক নতুন গ্রুপ খুলে তাতে এমডি-চেয়ারম্যানকে যুক্ত করা হয়েছে।
"কর্মীদের হাতে কোম্পানির আর্থিক লেনদেনের কোন তথ্য যাতে না থাকে, সেটি নিশ্চিত করতেই তাৎক্ষণিকভাবে সকল গ্রুপ ডিলিট করতে বাধ্য করা হয়েছে," বলে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান ওই কর্মকর্তা।
হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ ডিলিট করার নির্দেশনা দেওয়ার কথা স্বীকার করে মোহাম্মদ রাসেল বলেছেন, "পুরনো অনেক এমপ্লয়ি এসব গ্রুপে যুক্ত থাকায় গ্রুপগুলো ডিলিট করে নতুন গ্রুপ খোলা হয়েছে।"