করোনার সময়ে তামাক কারখানা চালু নিয়ে বিতর্ক
করোনাভাইরাসের সংক্রমণের সময়ে বাংলাদেশে বহুজাতিক তামাক কোম্পানিকে (সংযুক্ত) সিগারেট উৎপাদন, বিপণন ও তামাক পাতা ক্রয় অব্যাহত রাখতে সহায়তার জন্য, জেলা ও বিভাগীয় কমিশনারকে দেয়া শিল্প মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছে।
কৃষিভিত্তিক ও প্রয়োজনীয় পণ্য হওয়ায় নিরাত্তা ব্যবস্থা ঠিক রেখে কারখানা চালু রাখা হয়েছে, বলে জানিয়েছে তামাক কোম্পানিগুলো।
অন্যদিকে তামাককে ক্ষতিকর ও করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি বৃদ্ধির আশঙ্কা করে সরকারি ওই নির্দেশনা বাতিল ও তামাক কোম্পানির কারখানা বন্ধের দাবি জানিয়েছে- তামাক বিরোধী জোট। তৈরি পোশাকসহ দেশের প্রায় সব কারখানা বন্ধ রেখে তামাক উৎপাদন অব্যাহত রাখায় সমালোচনা হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও।
সরকারের প্রয়োজনীয় রাজস্ব উৎস বিবেচনায় অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে, বড় খাত হিসাবে তামাকের উৎপাদন অব্যাহত রাখা যায়, বলে মন্তব্য করছেন অর্থনীতিবিদরা।
জেলা ও বিভাগীয় কশিনারদের বরাবরে পাঠানো ওই নির্দেশণায় শিল্প মন্ত্রণালয় বলছে, 'কোভিড-১৯ এর সময়ে তামাক কোম্পানির উৎপাদন, বিপণন ও তামাক পাতা ক্রয় অব্যাহত রাখতে সহায়তা করার অনুরোধ করা হচ্ছে।'
শিল্প মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, দেশে তিন কোটির বেশি মানুষ তামাক সেবন করেন। ক্ষতিকর হলেও এটি নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য তাদের কাছে। এ বিবেচনায় তামাক কোম্পানির উৎপাদন অব্যাহত রাখার অনুমোদন দেয়া হয়েছে। তাছাড়া তামাক কোম্পানিগুলোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা ভালো।
এনিয়ে গত মঙ্গলবার তামাকবিরোধী ১৪টি সংগঠন যৌথ বিবৃতিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বরাত দিয়ে বলেছে, ধূমপানের কারণে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়া এবং গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। এই সতর্কতা আমলে নিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকা ইতোমধ্যেই করোনাভাইরাস সংকট মোকাবিলায় সিগারেট বিক্রয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। কিন্তু বাংলাদেশে শিল্প মন্ত্রণালয় দুটি বহুজাতিক কোম্পানিকে সহায়তার জন্য চিঠি দিয়েছে।
সংগঠনগুলো বলেছে, বাংলাদেশে ৩ কোটি ৭৮ লাখ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ তামাক ব্যবহার করে এবং প্রায় ৪ কোটি ১০ লাখ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ নিজ বাড়িতেই পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হয়। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে তামাকের ক্ষতির শিকার এই বিপুল প্রাপ্তবয়স্ক জনগোষ্ঠী বর্তমানে মারাত্মকভাবে করোনাভাইরাসের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।
জোটের সদস্য ও তামাক বিশেষজ্ঞ মাহবুবুর রহমান তাহিন বলেন, সাধারণ মানুষের চেয়ে তামাকসেবীদের মধ্যে করোনার ঝুঁকি ১৪ গুণ বেশি। বিশ্বব্যাপী করোনা ছড়িয়ে পড়ার পর সৌদি আরবসহ কয়েকটি দেশ তামাক উৎপাদন বন্ধ করেছে। তামাক আবশ্যক পণ্য না হওয়ায়, বাংলাদেশেও এই সময়ের জন্য এটি বন্ধ রাখা উচিত।
জাতীয় অর্থনীতি শক্তিশালীকরণের উদ্দেশ্যে কৃষক, উৎপাদক, কৃষি ব্যবসায়ী ও ভোক্তা সহায়ক কৃষি বিপণন ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং সম্প্রসারণের লক্ষ্যে 'কৃষি বিপণন আইন, ২০১৮' প্রণয়ন করা হয়েছে। এ আইনটির তফসিল ১-এ ১৩ ধরনের পণ্যকে কৃষিপণ্য হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এ তফসিলের (খ) ক্যাটাগরিতে অর্থকরী ফসল হিসেবে তামাকের উল্লেখ রয়েছে।
ফলে তামাককে 'অ্যাসেনসিয়াল প্রডাক্ট' বা আবশ্যক পণ্য হিসেবে উল্লেখ করছে কোম্পানিগুলো। সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী কৃষি ও আবশ্যক পণ্যের উৎপাদন অব্যাহত রাখার নির্দেশনা, শুরু থেকেই ছিল বলে জানিয়েছেন খাত সংশ্লিষ্টরা।
দেশে তামাক উৎপাদনকারী সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকোর (বিএটি) কোম্পানি সচিব আজিজুর রহমান দ্য বিজনেস স্টান্ডার্ডকে বলেন, তামাক সেবনের কারণে করোনা ঝুঁকি বৃদ্ধির প্রমাণ এখনো পাওয়া যায়নি। দেশে লকডাউন শুরু হওয়ার সময় থেকেই আমাদের কারখানা চালু রাখার অনুমোদন ছিল। নিরাপত্তা ব্যবস্থা ঠিক রেখে পণ্য উৎপাদন চালু রাখার কথা জানিয়েছে সরকার।
তিনি আরো বলেন, আমাদের কারখানা এমনিতেই কমপ্লায়েন্স। দেশে করোনার প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার পর সিকিউরিটিকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে কারখানা চালানো হচ্ছে। শ্রমিকসহ কারখানার সব স্টাফদের নিজস্ব পরিবহনের মাধ্যমে যাতায়াতের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সবাই পিপিই ব্যবহার ও সামাজিক দুরত্ব বজায় রেখে কাজ করছে।
ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো নিজেরাই হ্যান্ড স্যানিটাইজার উৎপাদন করছে বলে জানান এ কর্মকর্তা।
সরকার সর্বশেষ অর্থবছরে ২২, ৬৮৮ কোটি টাকার ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক পেয়েছে তামাক খাত থেকে। এছাড়া বাণিজ্যিক কর ও আয়কর বাবদ পেয়েছে কয়েক হাজার কোটি টাকা।
সরকারি রাজস্বের এ গতি অব্যাহত রাখতে, বহুজাতিক সিগারেট কোম্পানিগুলোর মতো প্রতিষ্ঠানের শিল্প কারখানা চালু রাখা দরকার বলে মনে করেন পিআরআইয়ের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর।
দ্য বিজনেস স্টান্ডার্ডকে তিনি বলেন, এসব কোম্পানির কারখানা অটোমেডেটেড (স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রচালিত) হওয়ায় শ্রমিকের সংখ্যা কম। তারা স্যোসাল ডিসটেন্স (সামাজিক দূরত্ব) বজায় রেখে কাজ করাতে পারছে। অর্থনীতির সব চাকা বন্ধ না করে এমন প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম অব্যাহত রাখা যেতে পারে। সরকার পরিচালনার জন্যই এর প্রয়োজন আছে।