কলড্রপের ভোগান্তিতে টেলিকম খাত, কমছে না তরঙ্গমূল্য
বাংলাদেশে বসবাসরত মোবাইল ব্যবহারকারী হয়ে থাকলে নিশ্চিতভাবেই আপনাকে ঘনঘন কলড্রপের সম্মুখীন হতে হয়? কিন্তু এর কারণটা কখনো ভেবে দেখেছেন? কিংবা ফোরজি নেটওয়ার্ক থাকা সত্ত্বেও কেন আপনি নির্বিঘ্নে মোবাইল ডেটা ব্যবহার করতে পারেন না?
বাংলাদেশের মোবাইল অপারেটররা যে স্পেকট্রাম বা তরঙ্গ ব্যবহার করে, তা গ্রাহকদের চাহিদা পূরণে যথার্থ নয়। আর এ কারণেই গ্রাহকের এত ভোগান্তি। অসংখ্য কলারকে একই তরঙ্গ ব্যবহার করতে হয়। ফলে মানের সঙ্গে সমঝোতা করেই চলছে সেবাদান কার্যক্রম।
কোন তরঙ্গ কী পরিমাণ ডেটা ধারণ করতে সক্ষম, তা ব্যান্ডউইথের ওপর নির্ভর করে। ব্যান্ডউইথ যত বেশি হবে, ডেটার পরিমাণ ও সেবার মানও তত বাড়বে। বিষয়টিকে অনেক সময় পানির কলের সঙ্গে তুলনা করা হয়। সরু পাইপে যেমন পানির প্রবাহ কম হয়ে থাকে, তেমনি পাইপের ব্যাসার্ধ বৃদ্ধি পেলে প্রবাহ সহজ হয়। ব্যান্ডউইথ ও ডেটা ট্রান্সমিশনের বিষয়টিও ঠিক একই রকম।
বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশন (বিটিআরসি) তরঙ্গ সরবরাহ করলেও মোবাইল অপরেটর প্রতিষ্ঠানগুলোর দাবী অনুযায়ী তরঙ্গমূল্য অত্যাধিক। দীর্ঘ সময় ধরে এই বিতর্ক চলে আসছে। সেইসঙ্গে দিন দিন কমেছে মোবাইল পরিষেবার মান।
বাংলাদেশের তরঙ্গের চিত্র কতটা, বাজে তা দেখে নেওয়া যাক।
প্রতি মেগাহার্জ তরঙ্গের জন্য বাংলাদেশে মোবাইল ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১২ লাখ। অন্যদিকে, আয়তনে প্রায় সমান বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশ নেপালে প্রতি মেগাহার্জ তরঙ্গ ব্যবহার করেন তিন লাখ গ্রাহক।
গতবছর এপ্রিলে প্রকাশিত টেলিকম অংশীদারদের তথ্যানুযায়ী, শ্রীলঙ্কা, মালেশিয়া, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামে এক থেকে চার লাখ গ্রাহক প্রতি মেগাহার্জ তরঙ্গ ব্যবহার করেন।
তবে বাংলাদেশের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ আয়তনের হলেও পাকিস্তানেও রয়েছে একই রকম সংকট। সেখানে প্রতি মেগাহার্জ তরঙ্গ বরাদ্দ ১২ লাখ গ্রাহকের জন্য।
নেপালে তিনটি মোবাইল অপারেটর প্রতিষ্ঠান ৪ কোটি ২৮ লাখ গ্রাহককে ১২৭.২৭ মেগাহার্জের তরঙ্গ সেবা দিচ্ছে। অন্যদিকে, বাংলাদেশের চারটি মোবাইল অপারেটর ১৭ কোটি গ্রাহকের জন্য ১২৯.২ মেগাহার্জ তরঙ্গ বরাদ্দ দিয়ে আসছে।
বিটিআরসির তথ্য মোতাবেক, দেশের বৃহত্তম মোবাইল অপারেটর গ্রামীণফোন তাদের গ্রাহকদের সবচেয়ে কম স্পেকট্রাম কভারেজ দিয়ে থাকে।
গ্রামীণফোনের ২০ লাখের বেশি গ্রাহক প্রতি মেগাহার্জ তরঙ্গ থেকে সেবা পেয়ে থাকে।
দ্বিতীয় বৃহত্তম অপারেটর রবি আজিয়াটা লিমিটেড ১৪ লাখ গ্রাহককে একই পরিমাণ তরঙ্গ সেবা দেয়। বাংলালিংকের প্রতি মেগাহার্জ তরঙ্গ ব্যবহার করেন ১১ লাখ গ্রাহক।
বর্তমানে গ্রামীণফোনের ৩৭ মেগাহার্জ তরঙ্গ রয়েছে। অন্যদিকে, রবি, বাংলালিংক ও টেলিটকের রয়েছে যথাক্রমে ৩৬.৪, ৩০.৬ ও ২৫.২ মেগাহার্জের তরঙ্গ। তবে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যান্ড মান ভিন্ন।
গ্রাহকের ভোগান্তি
যথাযথ তরঙ্গের অভাবে বাংলাদেশের মোবাইল পরিষেবার মান দিন দিন নিম্নতর হচ্ছে। এদিকে, কোভিড-১৯ সংক্রমণের পর দ্রুত ডিজিটালাইজেশন, মোবাইল ব্রডব্যান্ড ধারণ, স্মার্টফোন ও ডেটা ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়ায় বেড়েছে ডেটা ট্রাফিক।
বিটিআরসির তথ্যানুসারে, ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে আগস্টের মাঝামাঝি পর্যন্ত প্রায় ১১২ কোটি ৯৫ লাখ বার কলড্রপ হয়।
এর মধ্যে, রবির গ্রাহকদের কলড্রপ ছিল সর্বোচ্চ ৪৮ কোটি ১৭ লাখ বার। অন্যদিকে, গ্রামীণফোন ও বাংলালিংক ব্যবহারকারীদের কলড্রপের অভিজ্ঞতা ছিল যথাক্রমে ৪৬ কোটি ১ লাখ এবং ১৪ কোটি ৬৫ লাখ।
এছাড়াও, ধীরগতির ইন্টারনেট, নিম্নমানের ভয়েজ কোয়ালিটি এবং কল যেতে দীর্ঘ সময় ধরে অপেক্ষা করা এখন এক নিয়মিত বিষয়ে পরিণত হয়েছে।
অন্যদিকে, নেটওয়ার্কের মানোন্নয়ন এবং তরঙ্গ কেনায় বিনিয়োগ কম করায় মোবাইল অপারেটররা অধিক লাভ অর্জন করছে।
২০২০ সালে গ্রামীণফোন ৩ হাজার ৭২০ কোটি টাকা লাভ করে। ২০১৯ সালের তুলনায় তা ৭ দশমিক ৮২ শতাংশ বেশি।
অন্যদিকে, ২০১৯ সালে ১৭ কোটি টাকা হলেও, ২০২০ সালের প্রথম তিন মাসে রবির লাভের পরিমাণ ছিল ১১৫ কোটি টাকা।
তরঙ্গমূল্য বিতর্কে নেই অগ্রগতি
নতুন করে তরঙ্গ কেনার চেয়ে অপারেটররা কম দামে কেনার দিকেই বেশি নজর দিচ্ছে। তাদের দাবি অনুযায়ী, অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে তরঙ্গমূল্য ২৫ থেকে ৩৫ শতাংশ বেশি।
জিএসএমএ ইন্টেলিজেন্সের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ সরকার গ্রাহকপ্রতি বরাদ্দকৃত তরঙ্গ থেকে সবচেয়ে বেশি রাজস্ব আদায় করে।
তরঙ্গপ্রতি গ্রাহকদের কাছ থেকে বাংলাদেশ সরকারের আয়ের পরিমাণ দশমিক ৫৮ ডলার, যেখানে ভারত ও থাইল্যান্ডে এই পরিমাণ যথাক্রমে দশমিক ৪৭ ও দশমিক ২৫ ডলার।
তবু বিটিআরসি তরঙ্গের দাম কমানো নিয়ে আগাচ্ছে না। তার বদলে ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে তোলা নিলামের দামেই পুনরায় তরঙ্গ বরাদ্দের কথা ভাবছে।
ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তফা কামাল নতুন এই সিদ্ধান্তের বিষয় নিশ্চিত করে বলেন, 'তরঙ্গ একটি জাতীয় সম্পদ। তাই আমরা অপারেটরদের দাবি অনুযায়ী দাম কমাতে পারি না।'
'তবে সেবার মান বিবেচনায়, আমরা সময়ক্ষেপণ না করে আগের নিলামের দামেই নতুন তরঙ্গ বরাদ্দের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমরা অপারেটরদের দাম সম্পর্কে অবহিত করেছি। আমাদের তরঙ্গও তৈরি আছে। তারা মূল্য পরিশোধ করলেই তরঙ্গ পেয়ে যাবে,' বলেন মন্ত্রী।
তরঙ্গ বরাদ্দের সর্বশেষ নিলামটি ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। বিটিআরসি সেখানে ২১০০ ব্যান্ডের প্রতি মেগাহার্জ তরঙ্গের সর্বনিম্ন মূল্য ২৭ মিলিয়ন ডলার নির্ধারণ করে। অন্যদিকে, ১৮০০ ও ৯০০ ব্যান্ডের জন্য প্রতি মেগাহার্জ তরঙ্গের মূল্য নির্ধারণ করা হয় ৩০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
তবে মোবাইল অপারেটররা দরদামের জন্য আরও সময় চায়। দেশের সর্বোচ্চ গ্রাহকধারী অপারেটর গ্রামীণফোণের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হয়নি।
অন্যদিকে, রবি কর্মকর্তারা বিটিআরসির তরঙ্গ বরাদ্দের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানান। তবে মূল্য নির্ধারণে দরদাম করতে তারা আরও সময় চান।
রবি আজিয়াটা লিমিটেডের প্রধান করপোরেট ও নিয়ন্ত্রক কর্মকর্তা শাহেদ আলম বলেন, 'আমরা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বর্তমানে এই বিষয়ে আলোচনা করছি। যথাযথ একটি সামাধান আসার পরই আমাদের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করব।'
গত নিলামের সর্বোচ্চ ক্রেতা বাংলালিংকও সরকারকে আগের মূল্যেই নতুন করে তরঙ্গ বরাদ্দের সিদ্ধান্ত নেওয়ায় ধন্যবাদ জানায়।
বাংলালিংকের প্রধান করপোরেট ও নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক কর্মকর্তা তৈমুর রহমান বলেন, 'আমরা মাত্র কয়েক বছর আগেই তরঙ্গ কিনেছি। তরঙ্গের মূল্য নিয়ে প্রতিযোগিতামূলক ক্ষেত্র নিশ্চিত করায় বিটিআরসিকে স্বাগত জানাই।'
'তবে, তরঙ্গের মূল্য এখনো অনেক বেশি। বিষয়টির দিকে নজর দিয়ে সরকারের যথাযথ পর্যালোচনা করা প্রয়োজন,' বলেন তিনি।