কারখানা খোলার অনিশ্চয়তা নিয়েই বাড়ি যাচ্ছে শ্রমিকেরা
ঈদের ছুটির পর সরকার ঘোষিত কঠোর লকডাউনের মধ্যে পোশাক কারখানা চালু হবে কিনা, সে অনিশ্চয়তা সোমবার ঈদের আগে শেষ কর্মদিবসেও কাটেনি। তবে সোমবার রাতে সরকারি প্রজ্ঞাপনে খাদ্যদ্রব্য উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাত কারখানা, কোরবানির পশুর চামড়া পরিবহন ও প্রক্রিয়াজাতকরণ, ওষুধ, অক্সিজেন ও কোভিড-১৯ প্রতিরোধে ব্যবহৃত প্রয়োজনীয় দ্রব্য উৎপাদনকারী শিল্পকে লকডাউনের আওতার বাইরে রাখার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। এতে গার্মেন্টসসহ অন্যান্য কারখানার বিষয়ে কোন সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়নি।
তবে করোনা পরিস্থিতি উন্নতি হলে সরকারের ইতিবাচক সিদ্ধান্তের আশায় আগামী ১ আগস্ট থেকে পোশাক কারখানা খোলার প্রস্তুতি নিয়ে রাখার আশার কথা জানিয়ে সদস্যদের বার্তা পাঠিয়েছেন বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান। বেশিরভাগ কারখানা মালিকও শ্রমিকদের ২৬ থেকে ৩০ জুলাই পর্যন্ত ছুটি দেওয়ার ঘোষণা সম্বলিত নোটিশ দিয়েছেন। কেউ কেউ মৌখিকভাবে ৩০ তারিখের মধ্যে কর্মস্থল এলাকায় ফেরার নির্দেশনা দিয়েছেন।
এর ফলে অনিশ্চয়তা নিয়েই বাড়ি যাচ্ছে পোশাক খাতের শ্রমিকরা। কারখানা মালিক ও বায়ারদেরও অনিশ্চয়তা কাটেনি। সময়মত পণ্য জাহাজীকরণ করা আর সময়মত হাতে পাওয়া নিয়ে শঙ্কা রয়েছে তাদের মধ্যে। যদিও গত বৃহস্পতিবার মন্ত্রিপরিষদ সচিবের সঙ্গে স্বাক্ষাত ও প্রধানমন্ত্রীর কাছে চিঠি দেওয়ার পর শনিবার থেকেই তারা অপেক্ষায় রয়েছেন এ বিষয়ে ইতিবাচক বার্তা শোনার জন্য।
শিল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ১ আগস্ট থেকে কারখানা খোলা হলেও লকডাউন চলমান থাকলে ঈদে বাড়ি যাওয়া শ্রমিকদের ঢাকায় ফেরার উপায় কী হবে, তা নিশ্চিত নয়। আবার পোশাক কারখানা খোলা হলে অন্য কারখানার বিষয়ে সিদ্ধান্ত কী হবে, সেই সব খাতের শ্রমিকরা কী করবে- তা নিয়েও অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে।
এ পরিস্থিতিতে বিষয়টি সরকারের দ্রুত পরিষ্কার করা এবং শ্রমিকদের নিরাপদে কর্মস্থলে ফেরা নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছে শ্রমিক প্রতিনিধিরাও। বাংলাদেশ পোশাক শিল্প শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি মোঃ তৌহিদুর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "পুরো বিষয়টি নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে। পোশাক কারখানাগুলোর কেউ ২৬ তারিখ, ২৭ তারিখ বা ৩০ তারিখ পর্যন্ত ছুটি দিচ্ছে। এ অনিশ্চয়তা দূর করতে বিষয়টি সরকারের দ্রুত পরিষ্কার করা দরকার"।
তিনি বলেন, "প্রায় ২০ লাখ শ্রমিক ঈদে ঢাকা ছাড়বে। তাদের পক্ষে কি একদিনে ঢাকায় ফেরা সম্ভব? অন্তত বাড়তি দুই তিনদিন সময় লেগে যাবে। পাঁচ তারিখের পর ঢাকা ফেরা শুরু করলেও সবার আসতে আট আগস্ট পর্যন্ত সময় লেগে যেতে পারে। শ্রমিকরা যদি সময়মত এসে কাজে যোগ দিতে না পারে, তারা চাকরিচ্যুত হলে, এ দায়িত্ব নেবে কে?"
বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, "সব ধরণের প্রস্তুতি নেয়া থাকবে। যদি সরকার শিল্পের পরিস্থিতি বিবেচনায় আমাদের অনুরোধ রাখেন, তাহলে যেন কারখানা ১ আগস্ট থেকেই চালু করা যায়, সে প্রস্তুতিও রয়েছে। এছাড়া এখনো আমরা সরকারের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছি"।
গত বছরের সাধারণ ছুটির সময় শ্রমিকদের কারখানার আশেপাশে স্ব স্ব অবস্থানে থাকার বাধ্যবাধকতার পরও তারা গ্রামে গিয়েছিল উল্লেখ করে তিনি বলেন, "ঈদের ছুটি দিলেও শ্রমিকরা গ্রামে যাবে, না দিলেও যাবে। তাদের আটকানো যাবে না"।
চট্টগ্রামের কর্ণফুলি ইপিজেডে অবস্থিত ডেনিম এক্সপোর্ট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোস্তাফিজ উদ্দিন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে বেতন-বোনাসসহ শ্রমিকদের ছুটি দিয়েছি। বলেছি, সরকারের নির্দেশনা পেলে কারখানা খুলবে। তবে কবে খুলবে বা এ লকডাউন কতদিন চলবে তা জানিনা। তারা কবে আসবে, তাও বলতে পারিনি। একই অনিশ্চয়তার কারণে ক্লায়েন্টদেরও কিছু বলতে পারছি না, যা আমাদের জন্য ঝুঁকি তৈরি করেছে। ঈদের পর পাঁচ তারিখের মধ্যে আমাদের ১ মিলিয়ন ডলারের পণ্য জাহাজীকরণের শিডিউল রয়েছে"।
নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা অ্যাপারেলস এক নোটিশে শ্রমিকদের ২৬ জুলাই পর্যন্ত ঈদের ছুটি ঘোষণা করেছে। এরপর অতিমারির কারণে কারখানা বন্ধ থাকলে শ্রম আইনের সংশ্লিষ্ট ধারা অনুযায়ী ছুটি বর্ধিত করা হবে। ইতিমধ্যে বায়ারদের পণ্য পাঠানোর চাপ রয়েছে জানিয়ে প্রতিষ্ঠানটির সিইও ফজলে শামীম এহসান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "কিছু পণ্য দেরিতে পাঠানোর জন্য বায়ারদের অনুরোধ জানিয়েছি। কিন্তু তারা এখনো ইতিবাচক বার্তা পাঠায়নি"।
সরকারের নীতি নির্ধারকদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে, পোশাক খাতের এমন একজন শীর্ষ পর্যায়ের নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, "সরকারের পক্ষ থেকে শুরুতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও এখন বিষয়টি তারা পুনর্বিবেচনা করছেন। এর মধ্যে যদি করোনা পরিস্থিতির আর অবনতি না হয়, তাহলে ১ আগস্ট থেকে কারখানা চালু করার সিদ্ধান্ত আসতে পারে"।
গত ১৪ জুলাই সরকারের কঠোর লকডাউন শেষ হওয়ার পর ২২ জুলাই পর্যন্ত তা শিথিল করা হয়। আলোচ্য লকডাউনের সময় অবশ্য উৎপাদনমুখী শিল্প কারখানা খোলা ছিল। এরপর ২৩ জুলাই থেকে ফের লকডাউনের ঘোষণা আসে, যাতে পোশাক কারখানাসহ সব ধরণের কারখানা বন্ধ রাখার কথা বলা হয়েছে।
বেতন-বোনাস পরিস্থিতি
বিজিএমইএ'র পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, গতকাল শেষ দিনে সংঠনটির সদস্যভুক্ত কারখানাগুলোর ৯৯.৭৪ শতাংশ জুনের বেতন ও ঈদ বোনাস পরিশোধ করেছে। গতকাল পর্যন্ত পাঁচটি কারখানায় বেতন ভাতা পরিশোধ হয়নি, যা প্রক্রিয়াধীন। বিজিএমইএ'র সহসভাপতি শহীদুল্লাহ আজিম বলেন, সংগঠনটির সদস্যভুক্ত ১৯১২টি কারখানা বর্তমান চালু রয়েছে। এর মধ্যে বেতন ও বোনাস পরিশোধ হয়েছে ১ হাজার ৯০৭টি কারখানার। তবে পোশাক খাতের অপর সংগঠন বিকেএমইএ'র সিনিয়র সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, সব কারখানার বেতন-বোনাস পরিশোধ করা হয়েছে এবং শ্রমিকদের কোন অভিযোগ নেই।