"কালো টাকা বিনিয়োগের নিঃশর্ত সুযোগ কেউ চায় না"
কয়েকটি খাতের ব্যবসায়ীদের দাবি ও করোনাকালে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের অংশ হিসাবে চলতি অর্থবছরে কালো টাকা বিনিয়োগের নিঃশর্ত সুযোগ কাজে লাগিয়েছে বহু মানুষ।
তবে ভবিষ্যতে এ সুযোগ আর না দেয়ার পক্ষে অর্থনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও সরকারি নীতি নির্ধারনী সংস্থাসহ সব পক্ষ। এটিকে বিনিয়োগ ও কর ব্যবস্থায় বড় বৈষম্য উল্লেখ করে কালো টাকা অন্য কোনো মাধ্যমে মূল ধারায় নিয়ে আসা বা অবৈধ আয় বন্ধ করার উদ্যোগ গ্রহনের পরামর্শ দিয়েছেন বিষেশজ্ঞরা।
মঙ্গলবার নাগরিক প্লাটফর্মের ভার্চুয়াল সংলাপ "কালো টাকা সাদা হচ্ছে: অর্থনীতির লাভ, না ক্ষতি?" শীর্ষক আলোচনায় এমন মন্তব্য করেছেন বিশেষজ্ঞরা। নাগরিক প্ল্যাটফর্মের আহ্বায়ক ও গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের উপস্থাপনায় সংলাপে ব্যবসায়ী, সরকারি কর্মকর্তা ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা বক্তব্য রাখেন।
আলোচনায় অংশ নিয়ে ব্যবসায়ীদের পক্ষে মাল্টিমোড গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান তাবিথ আওয়াল বলেন, 'মাত্র ১০ শতাংশ কর দিয়ে যে খাতে বিনিয়োগ হয় সেখানে বাবল হয়। সাধারণ বিনিয়োগকারীদের চেয়ে উচ্চমূল্যে বিনিয়োগ করেন তারা। ফলে বাজার সাধারণরা পিছিয়ে পড়েন। অবৈধ উপার্জনকারীরা বেশি বিনিয়োগ করেন বলে বাজার অনিয়ন্ত্রিত হয়ে যায়'।
২০১০ সালে শেয়ারবাজারের ধ্বস আগের দুই অর্থবছরে কালো টাকা বিনিয়োগের সুযোগ দেয়ার ফল বলে মন্তব্য করেন তিনি।
একই ধরনের মন্তব্য করে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি রেজোওয়ান রহমান বলেন, 'কালো টাকা মূলত রিয়েল এস্টেট খাতে বিনিয়োগ হয়। এ সুযোগ যখন দেয়া হয় তখন প্লট ও ফ্ল্যাট সাধারণের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যায়। এটি এক ধরনের অন্যায্যতা। ব্যবসায়ীরা এটি চায় না। অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের সুযোগের পরিবর্তে তা নিয়ন্ত্রণ করা দরকার'।
এটি সৎ করদাতাদের নিরুৎসাহিত করার ব্যবস্থা উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'বর্তমান কালো টাকা সাদা করার সুযোগের থেকে সৎভাবে কর দেয়া বেশি ব্যয়বহুল। এই সুযোগের কারণে মানুষ সৎভাবে কর দিতে নিরুৎসাহিত হতে পারে'।
চলতি অর্থবছরে আবাসন ও শেয়ারবাজারসহ কয়েকটি খাতে বিনা প্রশ্নে কালো টাকা বিনিয়োগের সুযোগ দেয় সরকার। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী প্রথম ছয়মাসে প্রায় ১০ হাজার ২২০ কোটি টাকা অপ্রদর্শিত আয় বৈধ করেছেন সাত হাজার ৪৪৫ জন করদাতা, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম। এর বড় অংশই হয়েছে রিয়েল এস্টেট খাতে।
করদাতারা তাদের আয়কর রিটার্নে অপ্রদর্শিত আয়ের নগদ অর্থ, ব্যাংক আমানত, সঞ্চয়পত্র, শেয়ার, বন্ড বা অন্য যেকোনো সম্পদের ওপর ১০ শতাংশ কর দেয়ার মাধ্যমে বৈধ করতে পারবেন বলে নতুন বিধানে বলা হয়েছে। ব্যক্তি পর্যায়ে প্রদর্শিত আয়ের ওপর সর্বোচ্চ প্রদেয় কর ২৫ শতাংশ। কিন্তু সেখানে অপ্রদর্শিত আয়ের ওপর এই হার মাত্র ১০ শতাংশ।
অপ্রদর্শিত আয় বৈধ হওয়ার ফলে দেশের অর্থনীতির কি প্রকৃতপক্ষে লাভ হচ্ছে, না লাভের চাইতে ক্ষতি বেশি হচ্ছে তা নিয়ে আলোচনার মূল প্রবন্ধে এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল মজিদ বলেন, কালো টাকাকে কর প্রদানের সময় 'অপ্রদর্শিত অর্থ' সংজ্ঞায়িত করে গুরুতর অপরাধটিকে হালকা করার অবস্থান নেয়া সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক।
রাস্ট্রের প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত 'দুর্নীতিজাত অনুপার্জিত আয়' এর উৎস, উপায় ও উপলক্ষ কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা। দুর্নীতিজাত কালো টাকা লালন করার সংস্কৃতি থেকে সরে না এলে আয় ও সম্পদ বণ্টনের ক্রমবর্ধমান বৈষম্য থেকে বাংলাদেশের মুক্তি মিলবে না, যোগ করেন আব্দুল মজিদ।
তিনি আরও বলেন, 'কোনো উদীয়মান অর্থনীতিতে উন্নয়ন অর্জনে সফল হওয়ার পর যদি আয় সম্পদ বৈষম্য না কমে বরং বাড়ে তাহলে বুঝতে হবে সেই অর্থনীতিতে ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঘটেছে'।
আলোচনায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক সদস্য মো. ফরিদ উদ্দিন বলেন, 'হুন্ডি ও ট্রেডের মাধ্যমে কালোটাকা বিদেশে পাচার হয়। কিন্তু ট্রেড বেজড মানি লন্ডারিং ঠেকাতে দুদক, রাজস্ব বোর্ড, বাংলাদেশ ব্যাংকের মধ্যে কোনো সমন্বয় নেই। কালো টাকা লালনের পরিবেশ সৃষ্টি করতে না চাইলে সমস্ত ট্রানজেকশনকে তদারকির আওতায় আনতে হবে'।
কালো টাকা ও অপ্রদর্শিত আয়ের পার্থক্য স্পষ্টভাবে আলাদা করে দেখতে বলেন বাংলাদেশ এমপ্লয়ার্স ফেডারেশনের (বিইএফ) প্রেসিডেন্ট কামরান টি রহমান।
কালো টাকা শর্তহীন বিনিয়োগের সুযোগ না দিয়ে এ টাকার উৎস খোজার জন্য একটি জরিপ হওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেন এমআরডিআইয়ের হেড অফ প্রোগ্রাম ও কমিউনিকেশনস মিরাজ আহমেদ চৌধুরী।
এ টাকা কিভাবে আয় হয়েছে তা খুঁজে বের করা দরকার বলে মন্তব্য করেন তিনি।
আলোচনায় অংশ নিয়ে বিশেষ কর সুবিধার সুফল নিয়ে প্রশ্ন করেন সিপিডি'র চেয়ারম্যান, অধ্যাপক রেহমান সোবহান।
তিনি বলেন, 'এ ধরণের সুবিধা সৎ করদাতাদের নিরুৎসাহিত করে। তিনি বিশেষ কর সুবিধা সত্যিই অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক কিনা, এই বিষয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে গবেষণা করার পরামর্শ দেন'।
আলোচনার সার সংক্ষেপ বর্ণনা করে ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, 'কালো টাকা সাদা করার এই সুযোগ অন্যায্যবোধকে প্রশ্রয় দেয়। সীমিত আকারে ও স্বল্প সময়ের জন্য এই সুযোগ অর্থনীতির জন্য সহায়ক হলেও, দীর্ঘমেয়াদে অর্থনীতিতে তা বড় ক্ষতি নিয়ে আসে'।
এনবিআরের পক্ষে প্রতিষ্ঠানটির করনীতির সদস্য আলমগীর হোসেন বলেন, 'অপ্রদর্শিত আয় মূল ধারায় নিয়ে আসার বিশেষ প্রয়োজন রয়েছে। বেশ কয়েকটি উন্নয়নশীল ও উন্নত দেশ বিশেষ কর সুবিধার মাধ্যমে কালো টাকা সাদা করার সুবিধা দিয়ে তা মূল অর্থনীতিতে এনেছে। বিশেষ বিবেচনায় চলতি বছরের জন্যই এ সুযোগটি দেয়া হয়েছে। আগামী অর্থবছর থেকে এটি আর থাকবে না'।
এনবিআর কর আহরণ নয়, ট্যাক্সনেট বৃদ্ধি ও অর্থপাচার রোধে এটি করেছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে মো. শফিউল ইসলাম, এমপি, সদস্য, শিল্প মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সাংসদীয় স্থায়ী কমিটি লিগ্যাল ইকোনোমিস্ট এম এস সিদ্দিকী, আইডিএলসি ইনভেস্টমেন্টসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মনিরুজ্জামান, নাগরিক প্লাটফর্মের কোর গ্রুপ সদস্যদের পক্ষ থেকে ড. ইফতেখারুজ্জামান, নির্বাহী পরিচালক, টি আই বি এবং সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান আলোচনায় অংশ নেন।