ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে বিনিয়োগের অংক ১৬৪ শতাংশ বাড়ালো বিএসআরএম
দেশের ইস্পাত শিল্পে নেতৃত্বদানকারী বিএসআরএম স্টিলস লিমিটেড। তাদের উৎপাদিত পণ্যের চাহিদাও দিন দিন বেড়েই চলেছে। চাহিদা পূরণে এর আগেই প্রতিষ্ঠানটি উৎপাদন সক্ষমতা বাড়াতে বড় বিনিয়োগের পরিকল্পনা করেছিল, যা এখন আরও বড় করার লক্ষ্যে সংশোধিত হয়েছে।
এক বছর আগে সক্ষমতা বৃদ্ধিতে বিনিয়োগের ঘোষণাটি আসে। এসময় পুঁজিবাজারে নিবন্ধিত কোম্পানিটি অবকাঠামো নির্মাণে ব্যবহৃত রডসহ কিছু এমএস পণ্যের রিরোলিং সক্ষমতা ৫ লাখ টন বাড়িয়ে, বার্ষিক ২১ লাখ টনে উন্নীত করতে ৭০০ কোটি টাকা বিনিয়োগের কথা জানায়।
কিন্তু চাহিদা বাড়তে থাকায়, আগের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের আগেই নিজেদের উৎপাদন সক্ষমতায় আরও চাহিদার চাপ আসার বিষয়টি উপলদ্ধি করেন কোম্পানি কর্তৃপক্ষ। সেজন্য ওই পরিকল্পনা সংশোধন করে রড রিরোলিং ক্যাপাসিটি এখন ৬ লাখ টন বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
বর্ধিত সক্ষমতাকে সমর্থন দিতে ইস্পাতের বিলেট উৎপাদনও আড়াই লাখ টন বাড়ানো হবে। সেমি-ফিনিশড এই কাঁচামালে পুরোপুরি স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনেই এ উদ্যোগ নেওয়ার কথা জানান কোম্পানিটির কর্মকর্তারা।
কোম্পানিটি আমদানি করা স্ক্র্যাপ ধাতু গলিয়ে বিলেট বানায়। তারপর রিরোলিং প্লান্টে এই বিলেট থেকেই অবকাঠামো নির্মাণে ব্যবহৃত রড ও অন্যান্য এমএস পণ্য উৎপাদন করে।
সংশোধিত পরিকল্পনায় ধাতু গলন ও রিরোলিং সক্ষমতা বার্ষিক ২২ লাখ টনে উন্নীত করার যে লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে, তা আগের চেয়ে ২.৬৪ গুণ বেশি বা এক হাজার ৮৫০ কোটি টাকা।
২০২৩ সালের শেষ নাগাদ এটির বাস্তবায়ন শেষ হবে। পূর্ব পরিকল্পনায় ২০২৩ সালের মাঝামাঝি সময়ে বাস্তবায়ন শেষ করে উৎপাদনে যাওয়ার লক্ষ্য ছিল।
বিএসআরএম- এর হেড অব একাউন্টস অ্যান্ড ফিন্যান্স শেখর রঞ্জন কর বলেন, "উৎপাদন সক্ষমতা থাকলে ২০২০-২১ অর্থবছরে আমরা অতিরিক্ত ৫ লাখ টন বিক্রি করতে পারতাম।"
গত অর্থবছরে মহামারির প্রথম তরঙ্গ আঘাত হানার পর দেশজুড়ে নির্মাণকাজের জোয়ার দেখা যায়, এসময়ে ইস্পাত পণ্যের চাহিদা ১৫ শতাংশ বাড়ে। গত জুনে সমাপ্ত অর্থবছরে (২০২০-২১) বিএসআরএম- এর রড বিক্রিও এক-তৃতীয়াংশ বেড়েছে, বলে জানান তিনি।
সক্ষমতা বৃদ্ধির প্রয়োজন ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, অন্যান্য প্রতিযোগীর চেয়ে পণ্যের মান ও দাম নির্ধারণে এগিয়ে থাকা এখানে ভূমিকা রাখছে। ফলে আগামীদিনেও বাজারে বিএসআরএম-এর নেতৃত্ব থাকবে।
নিজস্ব তহবিলের পাশাপাশি ধরা করা তহবিল থেকেও সম্প্রসারণ প্রকল্পটিতে অর্থায়ন করবে বিএসআরএম।
এর আগে গত অর্থবছর (২০২০২১) স্থানীয় পুঁজিবাজারে নিবন্ধিত বিএসআরএম গ্রুপের দুটি কোম্পানি রেকর্ড বিক্রি, মুনাফা ও লভ্যাংশের ঘোষণা দেয়। এসময় তাদের বিপণন, অর্থায়ন ও করের খরচও কমেছিল।
মাথাপিছু ইস্পাত ব্যবহারে উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান এখনো নিচের সাড়িতেই। তবে দেশে দীর্ঘদিন ধরে অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্প চলমান থাকায় ইস্পাতের চাহিদাও বাড়ছে। সরকারি মেগা প্রকল্প ও বেসরকারি খাতের নির্মাণকাজ বৃদ্ধি দুদিক থেকেই সমর্থন পাচ্ছে চাহিদা।
এ প্রসঙ্গে বিএসআরএম- এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আমের আলীহোসাইন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড'কে বলেন, দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন অব্যাহত থাকায় কয়েক দশক ধরে ইস্পাতের চাহিদাও বাড়তে থাকবে।
সংশ্লিষ্ট শিল্পের প্রতিবেদন অনুসারে, ২০১৮ সালে বাংলাদেশে মাথাপিছু ইস্পাত ব্যবহার ছিল ৪৫ কেজি, যা আগের পাঁচ-আট বছরে দ্বিগুণ হয়।
আমের আলীহোসাইন ধারণা করছেন, মাথাপিছু ইস্পাত ব্যবহার এখন ৫৫ কেজিতে পৌঁছে গেছে।
আইডিএলসি ফিন্যান্সের ইস্পাত শিল্পের ওপর প্রস্তুতকৃত এক প্রতিবেদন অনুসারে, সরকারের মেগা-প্রকল্পগুলোই এখন চাহিদা বৃদ্ধির প্রধান চালিকাশক্তি, দেশে উৎপাদিত ইস্পাতের এক-তৃতীয়াংশই এসব অবকাঠামোয় ব্যবহৃত হচ্ছে। অথচ, মাত্র এক দশক আগেও এ ব্যবহার ছিল মাত্র ১৫ শতাংশ।
নাটকীয় এই চাহিদা বৃদ্ধি অনুমান করেই, সংশ্লিষ্ট শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের বার্ষিক উৎপাদন সক্ষমতা ৯০ লাখ টনে উন্নীত করেছে। একইসময়, অনুমিত বার্ষিক চাহিদা ৭৫ লাখ টন ছাড়িয়েছে বলে জানান বিএসআরএম এমডি।
গত বছর নতুন একটি কারখানা চালু করেছে জিপিএস ইস্পাত। এটির বার্ষিক ৮ লাখ ৪০ হাজার টন বিলেট এবং ৬ লাখ ৪০ হাজার টন এমএস রড, সাপোর্ট বিম, ফ্ল্যাট বার উৎপাদনে সক্ষম।
আরও সক্ষমতা যুক্ত করার উদ্যোগ পরিকল্পনাধীন রয়েছে।
এরমধ্যেই চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র ও ইস্পাত কারখানা স্থাপনে ২৪০ কোটি ডলার বিনিয়োগের ঘোষণা দিয়েছে চীনা ইস্পাত শিল্পের জায়ান্ট কুনমিং আয়রন অ্যান্ড স্টিল হোল্ডিংস কোম্পানি।
স্টার ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কনসোর্টিয়াম লিমিটেড নামে বেসরকারিখাতের ১৭টি প্রতিষ্ঠানের একটি যৌথ কনসোর্টিয়াম কুনমিং- এর স্থানীয় অংশীদার হিসেবে কাজ করবে। তারা বার্ষিক ২০ লাখ টন লৌহ ও ইস্পাত পণ্য উৎপাদনে করতে চায়। ২০২২ সাল থেকে কনসোর্টিয়ামটি কার্যক্রম শুরু করবে বলে আশা করা হচ্ছে।
দেশে বর্তমানে প্রায় ৪০০টি স্টিল মিল রয়েছে, কিন্তু বার্ষিক চাহিদার ৬৫ শতাংশের বেশি পূরণ করছে ব্রান্ডেড রড উৎপাদক আধা-ডজন আধুনিক প্রযুক্তির মিল।
সংশ্লিষ্ট শিল্পের ওপর ইবিএল সিকিউরিটিজের ২০১৯ সালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশে ইস্পাত চাহিদার অর্ধেকের বেশি শীর্ষ তিনটি কোম্পানি- বিএসআরএম, একেএস এবং কেএসআরএম পূরণ করছে।