ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য আসছে পৃথক প্যাকেজ
ক্ষুদ্রঋণ বিতরণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর (এমএফআই) মাধ্যমে কোভিডে ক্ষতিগ্রস্ত কটেজ ও মাইক্রো উদ্যোক্তাদের কাছে সহজেই ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল পৌঁছে দিতে নতুন একটি প্যাকেজ ঘোষণা করতে যাচ্ছে সরকার। প্রস্তাবিত এই প্যাকেজের আকার হতে পারে ৫-১০ হাজার কোটি টাকার।
এমএফআইগুলো সরাসরি এই অর্থ কটেজ ও মাইক্রো উদ্যোক্তাদের মাঝে ঋণ হিসেবে বিতরণ করবে। এক্ষেত্রে সুদের হার হতে পারে ১২-১৩ শতাংশ। তবে সুদের হারে সরকারের কোন ভর্তুকি থাকবে না।
গত সপ্তাহে অর্থমন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, বাংলাদেশ ব্যাংক, ব্র্যাক, আশা, ব্যুরো বাংলাদেশ ও তাদের নিয়ন্ত্রক সংস্থার সঙ্গে এ নিয়ে বৈঠক করে। বৈঠকে সিএমএসএমই খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোতে ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল সরবরাহের জন্য বিদ্যমান ২০ হাজার কোটি টাকার প্যাকেজের বাইরে আলাদা একটি তহবিল গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
রবিবার তহবিল গঠন ও তা পরিচালনার নীতিমালা কি হবে তা নিয়ে আবারো বৈঠক করেছে অর্থমন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ।
আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ ও মাইক্রো ক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটির (এমআরএ) কর্মকর্তারা বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, পাঁচ থেকে ১০ হাজার কোটি টাকার সম্ভাব্য এই তহবিল থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক বিনাসুদে শুধু ব্যাংক গ্যারান্টির মাধ্যমে এমআরএ'র সনদপ্রাপ্ত এমএফআইগুলোকে অর্থায়ন করবে।
এমআরএ'র পরিচালক মোহাম্মদ ইয়াকুব হোসেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, ব্যাংকের মাধ্যমে পরিচালিত বর্তমান সিএমএসএমই প্যাকেজের সুদে সরকার ৫ শতাংশ সুদ ভর্তুকি দিচ্ছে। আমরা প্রস্তাব করেছি, ওই ভর্তুকি না দিয়ে বিনাসুদে এমএফআইগুলোকে তহবিল যোগান দিতে। সেই তহবিল থেকে বড় এমএফআইগুলো ১২ শতাংশ সুদে এবং ছোট ও মাঝারি এমএফআইগুলো ১৩ শতাংশ সুদে কটেজ ও মাইক্রো উদ্যোক্তাদের ঋণ দেবে।'
ব্র্যাকের চিফ ফাইন্যান্সিয়াল অফিসার তুষার ভৌমিক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'আমাদের অপারেশনাল কস্ট ৯-১০ শতাংশের মতো। এছাড়া বিভিন্ন কারণে কিছু ঋণ আদায় করা সম্ভব হয় না। এজন্য লোন লস রিজার্ভ সংরক্ষণ করতে হয়, যার হার প্রায় ২-৩ শতাংশ। সব মিলিয়ে আমাদের খরচ প্রায় ১৩-১৪ শতাংশের মতো।'
তিনি বলেন, 'কেন্দ্রীয় ব্যাংক বা সরকার বিনাসুদে আমাদের তহবিল দিলে আমরা ১৩ শতাংশ সুদে তা বিতরণ করতে পারব। তবে এক্ষেত্রে তহবিলের আকার বড় হওয়া প্রয়োজন।'
ব্যাংকের মাধ্যমে এই তহবিল এমএফআইগুলোকে দেয়া হলে সুদের হার অনেক বেড়ে যাবে এবং তাতে সরকারের উদ্দেশ্য ব্যাহত হবে বলে মনে করেন তুষার ভৌমিক।
তিনি বলেন, সিএমএসএমইখাতে ঋণ বিতরণের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের ৩০০০ কোটি টাকার একটি তহবিল আছে, যা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন সম্ভব হচ্ছে না। কারণ, বাংলাদেশ ব্যাংক ওই তহবিল ১ শতাংশ সুদে ব্যাংকগুলোকে দিয়েছে। ব্যাংকগুলো ৪ শতাংশ সুদে এমএফআইগুলোকে দিয়ে ৯ শতাংশ সুদে ঋণ বিতরণ করতে বলেছে, যা সম্ভব হচ্ছে না।
কোস্ট ট্রাস্টের পরিচালক তারিক সায়েদ হারুন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'বাংলাদেশ ব্যাংক বিনাসুদে তহবিল যোগান দিলে এমএফআইগুলোর পক্ষে ১২-১৩ শতাংশ সুদে ঋণ দেয়া সম্ভব। তবে এতে এমএফআইগুলোর প্রফিট মার্জিন কম হবে। গ্রাহকদের নতুন ঋণ দিয়ে ব্যবসা চালু করাতে না পারলে পুরনো ঋণ ফেরত পাবো না। তাই কম প্রফিটেও ঋণ দিতে প্রস্তুত আমরা।'
কোভিডে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত কটেজ, মাইক্রো এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল যোগান দিতে গত মে মাসে ২০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করে সরকার। এই অর্থ ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে বিতরণ করছে সরকার।
দু'দফা মেয়াদ বাড়ানোর পরও এখন পর্যন্ত তহবিলের অর্ধেক ঋণও বিতরণ করতে পারেনি ব্যাংকগুলো। যেটুকু বিতরণ হয়েছে, তার বড় অংশই মাঝারি উদ্যোক্তারা পেয়েছেন। কোভিডে ক্ষতিগ্রস্ত মাইক্রো, কটেজ ও ক্ষুদ্র উদ্যোগগুলো এই প্যাকেজ থেকে খুব একটা সুবিধা পায়নি।
এক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোর ব্যর্থতা নিয়ে সমালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে সিএমএসএমই খাতে ঋণ বিতরণে এনজিওগুলোকে অন্তর্ভূক্ত করার উদ্যোগ নেয়অর্থ মন্ত্রণালয়।
বিদ্যমান প্যাকেজ ব্যাংকগুলোর নিজস্ব তহবিলে বাস্তবায়ন হওয়ায় এমএফআইগুলো ওই তহবিলে নিজেদের অন্তর্ভূক্ত না করে স্বতন্ত্র তহবিল গঠনের প্রস্তাব করে। রাষ্ট্রায়ত্ব পিকেএসএফ শুধু এমএফআইগুলোর জন্য স্বতন্ত্র ২০ হাজার কোটি টাকার তহবিল গঠন করার প্রস্তাব দেয়।
গত সপ্তাহে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের অতিরিক্ত সচিব জাকিয়া সুলতানার সভাপতিত্বে এনজিও প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকে এমএফআইগুলোর জন্য পৃথক তহবিল গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। ওই তহবিলের আকার, সুদহার নিয়ে এমআরএ'র কাছে লিখিত প্রস্তাব চায় মন্ত্রণালয়।
এমআরএ'র কর্মকর্তারা জানান, এমএফআইগুলোর গ্রাহকদের ৯০ শতাংশেরও বেশি কটেজ ও মাইক্রো নারী উদ্যোক্তা। এমআরএ সনদপ্রাপ্ত এমএফআইগুলো সিএমএসএমই'র তিন-চতুর্থাংশ উদ্যোগ কাভার করে।
এদিকে, এমএফআইগুলোর সঙ্গে কাজ করে সরকারের এমন পাঁচটি সংস্থা- পিকেএসএফ, এসএমই ফাউন্ডেশন, এমআরএ, বাংলাদেশ এনজিও ফাউন্ডেশন ও সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে রবিবার পৃথক বৈঠক করেছে অর্থবিভাগ।
বৈঠকে সিএমএসএমই খাত নিয়ে এসব সংস্থার চলতি অর্থবছরের কার্যক্রম ও আগামী অর্থবছরের পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা হয়। এগুলো পর্যালোচনা করে সিএমএসএমই খাতের জন্য নতুন প্যাকেজের আকার চূড়ান্ত করবে অর্থ মন্ত্রণালয়।
সভার সভাপতি ও অর্থবিভাগের সামষ্টিক অর্থনৈতিক উইংয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. আজিজুল আলম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'আমরা এমএফআইগুলোর চলতি ও আগামী বছরের বিভিন্ন কর্মসূচির তথ্য নিয়েছি। এগুলো পর্যালোচনা করে এসব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সিএমএসএমইগুলোকে আরো কিভাবে সহায়তা করা যায়, তা নির্ধারণ করা হবে। সরকার ব্যাংকের মাধ্যমে যে প্যাকেজ বাস্তবায়ন করছে, তার বাইরে আলাদা তহবিল থেকে এসব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সিএমএসএমইগুলোকে সহায়তা দেয়া হবে।'