কয়লার উত্তাপে ঝিমিয়ে পড়ছে ব্যবসা
গত এক বছরে আন্তর্জাতিক বাজারে কয়লার দাম ১০৮ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ায়, ইট এবং সিমেন্টের মতো অতি প্রয়োজনীয় নির্মাণ সামগ্রীর দাম বাড়তে থাকে।
কয়লার বাজার অস্থিতিশীল থাকলে নির্মাণ সামগ্রীর দাম আরও বাড়বে। ফলে সরকারি ও বেসরকারি অবকাঠামো নির্মাণে স্থবিরতা আসতে পারে বলে মনে করছেন খাতসংশ্লিষ্টরা।
উৎপাদন খরচ বাড়ার শঙ্কায় ইটভাটা মালিক সমিতি ১৫ নভেম্বর পর্যন্ত ইট পোড়ানো বন্ধ রাখার ঘোষণা দিয়েছে। স্থানীয় পর্যায়ে কয়লার দাম কমাতে সরকারকে কয়লা আমদানিতে শুল্ক কমানোর আহ্বান জানিয়েছেন তারা।
বিদ্যুৎ উৎপাদন ছাড়াও ইটভাটা, সিমেন্ট ও বেশ কিছু চা কারখানার প্রধান জ্বালানি হিসেবে কয়লা ব্যবহৃত হয়। দেশে কয়লার বাজারের বার্ষিক চাহিদা প্রায় ৫০ লাখ টন।
দেশে উত্তোলিত কয়লা বড় পুকুরিয়া কয়লা খনির জন্য নির্ধারিত থাকায় ইন্দোনেশিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, ভারত ও অস্ট্রেলিয়া থেকে কয়লা আমদানির মাধ্যমে চাহিদা পূরণ হয়।
ট্রেন্ড ইকোনমিকসের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের ১ ডিসেম্বর প্রতি টন কয়লার দাম ৭২ ডলার হলেও বর্তমানে দাম ১৫০ ডলারে গিয়ে পৌঁছেছে।
বাংলাদেশ কয়লা আমদানিকারক সমিতির সভাপতি সৈয়দ মো. আতিকুল হাসান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, চীনসহ কয়েকটি দেশে চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় কয়লার দাম বৃদ্ধি পেয়েছে।
"আমরা প্রতি টন কয়লা ৫৫ থেকে ৬৬ ডলারে আমদানি করতাম। বর্তমানে তা ১৫০ ডলারে গিয়ে পোঁছেছে। ক্রেতারা এই দামে কিনতে পারলে আমরা সরবরাহ করতে প্রস্তুত," বলেন তিনি।
কিন্তু অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির ফলে উৎপাদন খরচ নিয়ন্ত্রণ কঠিন হয়ে গেছে। দামি কয়লা দিয়ে উৎপাদন চালু করা নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত কারখানা মালিকরা।
অন্যদিকে কয়েকজন কারখানা মালিক উৎপাদন খরচ তুলতে পণ্যের দামে পরিবর্তন আঞ্ছেন।
পুড়ছে না ইট
ফরিদপুর শহরের ধুলদি এলাকার ইটভাটা মালিক চঞ্চল ঘোষ সাধারণত প্রতি বছর নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ইট পোড়ানো শুরু করলেও কয়লার দাম বাড়ায় চলতি বছর এখনও তিনি উৎপাদন শুরু করেননি।
একই কারণে ফরিদপুরসহ বিভিন্ন জেলার প্রায় সাত হাজার ইটভাটায় একই অবস্থা বিরাজমান। অগ্রীম অর্থ নিয়েও প্রায় ২০ হাজার শ্রমিক কাজ ছাড়াই দিন অতিবাহিত করছেন।
খাতসংশ্লিষ্টরা জানান, গত মৌসুমে ইটভাটা মালিকরা প্রতি টন কয়লা ৮,০০০ থেকে ৯,০০০ টাকায় কিনেছেন। করোনা মহামারির কারণে চলতি মৌসুমে কয়লা আমদানিতে সংকটের সৃষ্টি হয়। ফলে স্থানীয় বাজারে প্রতি টন কয়লার দাম ১৯,০০০ থেকে ২২,০০০-এ গিয়ে পৌঁছে।
দাম বাড়ায় ইটভাটা মালিকরা যথাসময়ে উৎপাদন শুরু করতে পারছেন না। গত মৌসুমে উৎপাদিত ইটের মজুদও এখন শেষ হতে চলেছে।
এ অবস্থায় ইটভাটা চালাতে মালিকরা বেশি দামে কয়লা কিনলে ইটের দাম বাড়বে।
সাতক্ষীরা শহরের বিনেরপোতার এবি ব্রিকস ভাটার মালিক শুকুর আলী সরদার দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "গত মৌসুমে প্রতিটি ইট উৎপাদনে খরচ পড়েছিল ৫ টাকা থেকে ৬.৫ টাকা। তবে, চলতি মৌসুমে প্রতিটি ইট উৎপাদন খরচ বেড়ে ১০ টাকা থেকে ১১ টাকা হতে পারে। এত বেশি দামে মানুষ ইট কিনবে কি না, তা নিয়েও আমি চিন্তিত।"
ফরিদপুর জেলা ইটভাটা মালিক সমিতির সভাপতি খলিফা কামাল উদ্দীন বলেন, এর আগে যে কয়লা আট হাজার টাকায় কেনা গেছে এবার তা ২২ হাজার টাকায় কিনতে হবে। ভাটা মালিকরা বিষয়টি ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে দেখায় অধিকাংশ ইটভাটাই এ বছর উৎপাদনে যেতে পারবে না।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে চলতি মৌসুমে ইটের দাম সাধারণ মানুষের হাতের নাগালের বাইরে চলে যাবে।
ইটভাটা মালিক সমিতির সেন্ট্রাল সেক্রেটারি আজাদ কাউসার বলেন, "আন্তর্জাতিক বাজারে দাম ঊর্ধ্বমুখী হওয়ার পাশাপাশি উচ্চ শুল্কের কারণে স্থানীয় বাজারে ইটের দাম বাড়ছে।"
বর্তমানে বাংলাদেশে কয়লা বাণিজ্যে ১৫ শতাংশ মূল্য সংযোজন করসহ ২৫ শতাংশ পর্যন্ত কর ও শুল্ক পরিশোধ করতে হয়।
"শুল্ক ছাড় দেওয়া হলে আমরা অপেক্ষাকৃত কম খরচে কয়লা ব্যবহার করতে পারব। এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে আমরা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ জানিয়েছি," বলেন তিনি।
বেড়েছে সিমেন্টের দাম
সিমেন্ট উৎপাদনেও ব্যবহৃত হয় কয়লা। গত চার মাসে আন্তর্জাতিক বাজারে কয়লার দাম ৬৬ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। ফলে সিমেন্ট উৎপাদন খরচও বেড়ে গেছে।
বাংলাদেশ সিমেন্ট ম্যানুফেকচারারস অ্যাসোসিয়েশনের (বিসিএমএ) প্রথম সহ-সভাপতি মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ জানান, দেশে প্রতি মাসে সিমেন্টের চাহিদা চার কোটি টন।
গত চার মাসে শিপিং খরচসহ প্রতিটন ক্লিঙ্কার এবং অন্যান্য কাঁচামালের দাম ২০ ডলার বেড়েছে। প্রতি ব্যাগ সিমেন্ট উৎপাদনে প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে এখন ৪০ টাকা পর্যন্ত লোকসান গুনতে হচ্ছে।
বাড়ছে চা উৎপাদন খরচ
চা বাগান মালিকদের মতে, সিলেটে চা উৎপাদনে গ্যাস ব্যবহৃত হলেও চট্টগ্রাম এবং পঞ্চগড়ে চা উৎপাদনে কয়লা ব্যবহৃত হয়।
চট্টগ্রামের বারমাসিয়া চা বাগানের ব্যবস্থাপক এবাদুল হক বলেন, পাঁচ মাসে এক কেজি চায়ের উৎপাদন খরচ ১৮০ টাকা হলেও এখন তা ২০০ টাকায় গিয়ে পৌঁছানোয় চা বাগানে টেকসই উৎপাদন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
অন্যদিকে নিলামে প্রতিকেজি চা ১৭০টাকা কেজিতে বিক্রি হওয়ায় অধিকাংশ চা অবিক্রিত থেকে যাচ্ছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
তিনি জানান, চার মাস আগে স্থানীয় বাজারে কয়লা ১৮টাকা কেজি দরে বিক্রি হলেও এখন তার দাম ২৬ টাকা। কয়লার দাম বাড়ায় চা বাগানের দৈনিক ব্যয় এক লাখ ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত বেড়েছে।
চট্টগ্রামের বেশ কয়েকটি চা বাগানের মালিক জানান, জ্বালানি মূল্য বাড়ায় কয়লা পরিবহন খরচও বেড়ে গেছে।
"পণ্য পরিবহনেও সংকটের সৃষ্টি হয়েছে। পরিবহন ব্যয় বাড়ায় স্থানীয় বাজারে কয়লার দাম আবারও বাড়বে। ফলে সংকট তীব্রতর হবে।"
প্রতিবেদনটি তৈরি করতে আমাদের চট্টগ্রাম, ফরিদপুর, হবিগঞ্জ, গাজীপুর, সাতক্ষীরা, দিনাজপুর, খুলনা এবং বরিশাল প্রতিনিধি সহায়তা করেছেন।