খাদ্য নিরাপত্তায় ২.৯ বিলিয়ন ডলারের পরিকল্পনা, আংশিক ঋণ আসতে পারে বিশ্বব্যাংক থেকে
গবেষণার মাধ্যমে কৃষির যান্ত্রিকীকরণ ও সম্প্রসারণের মাধ্যমে খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা টেকসই করার পাশাপাশি কৃষকদের আয় বৃদ্ধির লক্ষ্যে আগামী পাঁচ বছরে ২.৯ বিলিয়ন ডলার বা ২৪ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকা বিনিয়োগ কর্মসূচী বাস্তবায়ন করতে চায় সরকার।
সরকারের এ বিশাল পরিকল্পনায় ৫০০ মিলিয়ন ডলার ঋণ দিতে প্রাথমিকভাবে সম্মতি দিয়েছে বহুজাতিক দাতা সংস্থা বিশ্বব্যাংক। বাংলাদেশি মুদ্রায় এর পরিমাণ প্রায় ৪ হাজার ২৩৯ কোটি টাকা।
সরকারের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) অনুরোধের প্রেক্ষিতে সম্মত হয়ে সংস্থাটি সম্প্রতি একটি ধারণাপত্র তৈরি করেছে।
এতে বলা হয়েছে, ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার কারণে ১০ বছরে বাংলাদেশে খাদ্য আমদানি তিনগুণ বেড়েছে। ২০৩১ সালের মধ্যে দেশের জনসংখ্যা আরও প্রায় তিন কোটি বাড়বে। একদিকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ আর অন্য দিকে বাড়তি জনংখ্যার কারণে টেকসই ও নিরাপদ খাদ্যের যোগান চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ড. মো. আবদুর রৌফ (পরিকল্পনা) দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, প্রস্তাবিত প্রকল্পে ঋণ দিতে বিশ্বব্যাংক আগ্রহ দেখিয়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি) তৈরির কাজও শুরু করেছে।
সরকারের বিবেচনায় লাভজনক বিবেচিত হলে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) অনুমোদন সাপেক্ষে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে বলেও জানান তিনি।
কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ২০১৮ সালে প্রণয়ন করা জাতীয় কৃষি নীতিমালার আওতায় ২০২১-২০২৫ সময়ের জন্য পৃথক 'ইমপ্লিমেন্টেশন প্ল্যান অব অ্যাকশন' বা পিওএ তৈরি করা হয় ২০২০ সালে। সরকারের অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার আলোকে এ পরিকল্পনায় ব্যয় ধরা হয় ২.৯ বিলিয়ন ডলার।
এই অ্যাকশন প্ল্যান বাস্তবায়নের অংশ হিসেবেই প্রকল্পটি তৈরি করা হচ্ছে। আগামী বছরের মার্চে প্রকল্পটির ঋণপ্রস্তাব বোর্ড সভায় উপস্থাপনের লক্ষ্যে কাজ করছে বিশ্বব্যাংক।
ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা, দ্রুত নগরায়নের ফলে চাষযোগ্য জমি কমে আসা ও জলবায়ুর পরিবর্তনে কৃষি উৎপাদনে ঝুঁকি বেড়ে যাওয়ায় আগামীতে টেকসই খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তার বিষয়টিকে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছে বিশ্বব্যাংক। এ কারণে প্রস্তাবিত প্রকল্পে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির বিষয়টিকে সর্বোচ্চ প্রধান্য দেওয়া হচ্ছে।
বিশ্বব্যাংকের এ সংক্রান্ত নথিতে বলা হয়, "এর জন্য একদিকে জলবায়ু স্থিতিস্থাপক উত্পাদনশীলতা বৃদ্ধি এবং অন্যদিকে যোগানের দক্ষতা বাড়ানোর জন্য শক্তিশালী পদক্ষেপের প্রয়োজন হবে।"
এরই অংশ হিসেবে ক্লাইমেট স্মার্ট এগ্রিকালচার, চর ও পাহাড়ি অঞ্চলসহ সারাদেশের অনাবাদি জমিতে কৃষি উৎপাদন বাড়ানো, প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি ও যান্ত্রিকীকরণে গুরুত্ব দেওয়া হবে প্রকল্পটিতে। এ ছাড়া মানসম্মত বীজ, ঋণ, স্টোরেজের মতো কৃষি উপকরণ নিশ্চিতেও থাকছে গুরুত্ব।
খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি কৃষি খাতে সংশ্লিষ্ট কৃষক ও উদ্যোক্তাদের আয় বৃদ্ধির মাধ্যমে জীবনযাত্রার মান উন্নত করার পরামর্শ দিয়েছে বিশ্বব্যাংক।
এ লক্ষ্যে চাষের ব্যয় কমিয়ে আনা, চাষাবাদ পরবর্তী ক্ষতি কমিয়ে আনা ও কৃষি বাজারব্যবস্থার আধুনিকায়নেরও উদ্যোগ নেওয়া হবে প্রকল্পটির আওতায়।
কৃষির শক্তিশালী ভ্যালু চেইন তৈরি করতে হাই ভ্যালু ক্রপ ও রপ্তানি উপযোগী ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধিতে জোর দিয়েছে বিশ্বব্যাংক।
গুড এগ্রিকালচারাল প্র্যাকটিস (জিএপি) বাস্তবায়নের মাধ্যমে নিরাপদ ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি, উচ্চ ফলনশীল ধান ও তেল ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধির পরিকল্পনা করা হচ্ছে। এছাড়া পুষ্টিকর খাবারের সহজলভ্যতা তৈরির জন্য ফল ও শাকসবজির উৎপাদন বৃদ্ধিতেও এই অর্থ ব্যয় করা হবে।
বিশ্বব্যাংকের ওই নথিতে বলা হয়, "যেখানে অন্যান্য খাদ্য পণ্যের দাম ক্রমাগত বেড়েছে সেখানে শ্রমের মজুরি এবং সেচের খরচ উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় বাংলাদেশে ধান উৎপাদন কম লাভজনক হয়ে উঠেছে। কৃষকরা ধান চাষ থেকে প্রতি হেক্টরে ৫৬ ডলার উপার্জন করেন, যেখানে অন্য ফসল থেকে প্রতি হেক্টরে ৩০০ ডলার এবং ফল ও সবজি উৎপাদন থেকে ৬০০ ডলারের বেশি আয় হতে পারে।"
এছাড়া কৃষি পণ্যের প্রক্রিয়াজাতকরণে বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণ বাড়ানো এবং প্রশিক্ষিত যুবকদেরকে উদ্ভাবনীভিত্তিক কৃষিতে আকৃষ্ট করতে কর্মপরিকল্পনা দিয়েছে বিশ্বব্যাংক।
কৃষি উৎপাদন বাড়াতে মাটি, পানি ও জীববৈচিত্র্য ব্যবস্থাপনায় বাড়তি গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলেছে। এজন্য কৃষি গবেষণায় 'কোয়ালিটি ইনভেস্টমেন্ট' এর প্রয়োজনীয়তার কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের সহযোগী সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট অ্যাসোসিয়েশন (আইডিএ) থেকে কম খরচে এ ঋণ বিতরণ করা হবে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই), বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএডিসি), বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউট (বারি), বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইন্সটিটিউট (ব্রি) এবং বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল (বিএআরসি) যৌথভাবে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে।
- প্রতিবেদনটি ইংরেজিতে পড়ুন: $2.9bn food security plan afoot