চরম দুরবস্থায় অটোমোবাইল ওয়ার্কশপ
করোনার ধকলে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকার অটোমোবাইল মেরামত খাত বড় ধরণের ক্ষতিতে পড়েছে।
গত ১৫ মাসে এ ব্যবসার সাথে জড়িতদের বিক্রি কমে গেছে অন্তত ৪০ শতাংশ।
ওয়ার্কশপ ভাড়া, কর্মচারীদের বেতন ও ব্যাংক ঋণ পরিশোধে হিমশিম খাচ্ছেন এ সেক্টরের উদ্যোক্তারা।
ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা বলছেন, তাদের ব্যাংক ঋণগুলোর কিস্তি পরিশোধের মেয়াদ আরও পিছিয়ে দেওয়া হোক এবং পাশাপাশি মূসক ও করের চাপ লাঘব করা হোক।
পাশাপশি তাদের জন্য প্রতিশ্রুত অটোমোবাইল শিল্পাঞ্চল দ্রুত গড়ে তোলা হোক এবং তাদের জন্য স্বল্প সুদে বিশেষ ঋণ ব্যবস্থা চালু করা হোক।
নয়তো এ ব্যবসায় টিকে থাকাই তাদের জন্য কঠিন হয়ে যাবে।
ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের একজন জাহিদ আলী । তিনি ১৯৮৫ সাল থেকে বগুড়ায় অটোমোবাইল ওয়ার্কশপ সেক্টরের সাথে জড়িত। টিবিএসকে তিনি বলেন, "করোনায় আমি নিঃস্ব হয়ে গেছি। সব মিলিয়ে করোনায় আমার ক্ষতি হয়েছে ৭ লাখ টাকা। আমার ওয়ার্কশপে ইঞ্জিনিয়ার,মেকানিক ও লেবারসহ মোট ৩০ জন লোক কাজ করতো।করোনার প্রথম তিন মাস সবাইকে বসিয়েই বেতন দিয়েছি। কিন্ত পরবর্তীতে বেতন না দিতে পারায় সবাই চলে গিয়েছে"।
তিনি আরো বলেন, "আমি বহু চেষ্টা করেছি যাতে আমার ওয়ার্কশপটি বন্ধ না হয়, কিন্তু ওয়ার্কশপ ভাড়া-কর্মচারীদের বেতনসহ আনুষঙ্গিক খরচ পোষাতে না পেরে আমি এ মেরামতের সেক্টর ছেড়ে দিয়েছি"।
এছাড়াও তিনি বলেন, "করোনায় মানুষের হাতে টাকা না থাকায় এখন একেবারে নিরূপায় না হলে মানুষ গাড়ি মেরামত করাচ্ছে না, তাই আমাদের কাস্টমার নেই বললেই চলে। আয় আগের তুলনায় অনেক কমে যাওয়ায় ওয়ার্কশপ ভাড়া, কর্মচারীর বেতন এবং মানুষের ধার-দেনা পরিশোধের কোনো উপায় ছিল না, তাই এ ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছি।"
জাহিদ আলীর মতো ক্ষতিগ্রস্ত আরেক ব্যবসায়ী রিজভী আহমেদ। তিনি ২০ বছর ধরে চট্টগ্রামে এই অটোমোবাইল ওয়ার্কশপ সেক্টরের সাথে জড়িত। তিনি টিবিএসকে বলেন, "এ রকম মন্দায় আগে কখনো পড়ি নাই। আগে যেখানে মাসে ২-৩ লাখ টাকার গাড়ির মেরামত করতাম, এখন সেখানে মাসে ৫০-৭০ হাজার টাকার কাজ পাই না। আমার ওয়ার্কশপে আগে মেকানিক, ইঞ্জিনিয়ার, টেকনিশিয়ান ও লেবার মিলে ৪০ জন লোক কাজ করতো। বেতন দিতে না পারায় ১৪ জন বাদে বাকি সবাই চলে গেছে"।
এ অবস্থা শুধু জাহিদ আলী ও রিজভী আহমেদেরই নয়, প্রায় অধিকাংশ ব্যবসায়ীই এসব ক্ষতি পোষাতে পারছেন না।
রাজধানীর বাংলা মোটর, কাকরাইল, গাবতলী, ইস্কাটন, উত্তরা, বাড্ডা, বেড়িবাঁধ, মোহাম্মদপুর, মিরপুর, কল্যাণপুর ইত্যাদি এলাকায় সবচেয়ে বেশি ওয়ার্কশপ রয়েছে। এ ওয়ার্কশপগুলোতে একসময় ছিল অনেক ভিড়, কিন্তু মহামারির প্রভাবে এখন সেখানে তেমন একটা ভিড় দেখা যাচ্ছে না। তবে ব্যবসায়ীদের দাবি রাজধানীর চাইতে জেলা-থানা পর্যায়ের ওয়ার্কশপগুলো করোনায় বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
অটোমোবাইল ওয়ার্কশপ শিল্পের সংগ্রাম দীর্ঘদিনের। এখন পর্যন্ত নেই কোন একাডেমিক কারিগরি প্রশিক্ষণের সরকারি ব্যবস্থাপনা। অটোমোবাইল শিল্পাঞ্চল গড়ে তোলা এবং একটি স্থায়ী ঠিকানা ও প্রশাসনিক ভোগান্তি এড়ানোর জন্য সেই ১৯৮৯ সালের এরশাদ সরকারের আমল থেকেই দাবি জানিয়ে আসছেন অটোমোবাইল ওয়ার্কশপের সাথে জড়িত সংশ্লিষ্টরা।
দীর্ঘ ৩০ বছর পর ২০১০ সালে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশন (বিসিক) উদ্যোগ নেয় অটোমোবাইল ওয়ার্কশপ শিল্পাঞ্চল গড়ে তোলার। একটি শিল্পাঞ্চল হওয়ার কথা ঢাকার আশেপাশে, অপরটি চট্টগ্রামে। কিন্তু এসবের কিছুই বাস্তবে গড়ে তোলা হয়নি বিগত দশ বছরে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ অটোমোবাইল ওয়ার্কশপ মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম টিবিএসকে বলেন, "এই সমস্ত অটোমোবাইল ওয়ার্কশপগুলো দেশের পরিবহন ও যানবাহন ব্যবস্থার প্রধান মাধ্যম বাস, ট্রাক, মিনিবাস, কোস্টার, কার, মাইক্রোবাস, ট্যাক্সি, টেম্পুসহ সকল ধরণের গাড়ীর ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা যন্ত্রাংশ মেরামত, সংযোজন ও রক্ষণাবেক্ষণ করে। এই দরিদ্র দেশের পরিবহন ও যানবাহন ব্যবস্থাকে সচল রেখে আসছে এই সেক্টর"।
তিনি আরো বলেন, "মূলত ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় গড়ে উঠা এই ওয়ার্কশপগুলো দেশের অবহেলিত হাজার হাজার শ্রমিকের জীবন গড়ার প্রতিষ্ঠান হিসেবে দীর্ঘকাল যাবৎ কাজ করছে। এখান থেকে একজন শ্রমিক দক্ষ কারিগর হয়ে দেশের চাহিদা পূরণ করে বিদেশেও কাজ করে সুনাম অর্জন করছে। দেশে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আসছে। অথচ আমাদের কোন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র নেই, প্রশাসনিক স্থায়ী কোন জায়গা নেই। সরকারের পক্ষ থেকে করোনায় কোন আর্থিক সহযোগিতা করা হয়নি। এই করোনাকালীন সময়ে অনেক সেক্টরকে প্রণোদনা দিলেও আমাদের একটি টাকাও দেয়া হয়নি"।
ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প ফাউন্ডেশন (এসএমই) এ খাতকে কারোনাকালীন প্রণোদনার তালিকাভুক্ত না করায় এ ব্যবসার সঙ্গে জড়িতরা সরকার ঘোষিত আর্থিক কোনো ঋণ সুবিধা পাননি।
গত বছরের ৫ এপ্রিল করোনাভাইরাসের অর্থনৈতিক ক্ষতি পোষাতে ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার প্রণোদনা ঘোষণা করে সরকার। এরমধ্যে কুটির, ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি খাতের জন্য ২০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু সরাসরি উৎপাদনে জড়িত না থাকায় ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প ফাউন্ডেশনের (এসএমইএফ) এই প্রণোদনার অর্থ পাওয়ার তালিকায় রাখা হয়নি অটোমোবাইল ওয়ার্কশপ খাতকে।
এ ব্যাপারে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর টিবিএসকে বলেন, 'এটি একটি সম্ভাবনা খাত। এখানে কিছু লোক দক্ষ হয়ে বিদেশ গিয়ে ভালো অংকের রেমিট্যান্স যোগান দিচ্ছে। করোনায় এ ব্যবসা অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সামনের দিনগুলোতে আরও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ খাতের লোকজন সরাসরি উৎপাদনে জড়িত নয়, শুধু মেরামত করে- এ যুক্তিতে এই বৈশ্বিক দুর্যোগে তাদের প্রণোদনা না দেয়া সমীচীন নয়। সরকারের উচিত অন্যান্য খাতের মতো এ সেক্টরকেও আর্থিক প্রণোদনা দিয়ে টিকে থাকতে সহায়তা করা, অন্যথায় এ খাত আরো বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে"।
বাংলাদেশ অটোমোবাইল ওয়ার্কশপ মালিক সমিতির তথ্য অনুযায়ী, সারা দেশে প্রায় ৩০ হাজার ওয়ার্কশপ রয়েছে। এর মধ্যে সমিতির নিবন্ধনভুক্ত প্রায় ২২ হাজার অটোমোবাইল ওয়ার্কশপ, এছাড়া বাকি ৮ হাজার ওয়ার্কশপ ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে সারাদেশে। শুধু ঢাকা শহরেই রয়েছে সাড়ে ৩ হাজারের মতো। এ ব্যবসায় সারা দেশে বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা। চলমান লকডাউন ও অতিরিক্ত করারোপে বেশিরভাগ ব্যবসায়ী এখন বেশ বিপাকে।
সমিতির তথ্যমতে, এ খাতে অন্তত ৩ লাখ লোক জড়িত। করোনায় এদের ৩০ ভাগই কাজ হারিয়েছেন।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ অটোমোবাইল ওয়ার্কশপ মালিক সমিতির সভাপতি আরিফুল ইসলাম মিনা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "করোনায় এ ব্যবসা ব্যাপক ক্ষতির শিকার হয়েছে। প্রায় ৫০ শতাংশ ব্যবসায়ীরই রয়েছে ব্যাংক ঋণ। করোনায় অধিকাংশ দোকানের বিক্রি কমেছে প্রায় ৪০%। সব মিলিয়ে গত ১৫ মাসে প্রায় ১ হাজার কোটি টাকার মতো লোকসান হয়েছে। প্রায় ৪০০-৫০০ জন ব্যবসায়ী ক্ষতি পোষাতে না পেরে ওয়ার্কশপ বিক্রি করে দিয়েছেন।"
তিনি আরও বলেন, "বর্তমানে অটোমোবাইল মেরামত সেবায় সব মিলিয়ে ১৬.৫ শতাংশ কর ও মূল্য সংযোজন কর দিতে হয়, দিনদিন সরকার এই করের পরিমাণ বৃদ্ধিই করছে, কিন্তু বিনিময়ে প্রত্যাশিত কারিগরি প্রশিক্ষণ, প্রযুক্তি সহযোগিতা ও আর্থিক সহযোগিতা করছে না।"
জরুরী ভিত্তিতে ব্যাংক ঋণগুলোর কিস্তি পরিশোধের মেয়াদ আরও পিছিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি তাদের উপর আরোপিত কর কমানোর দাবি তার।
তাদের জন্য প্রতিশ্রুত অটোমোবাইল শিল্পাঞ্চল গড়ে তুলে দীর্ঘমেয়াদে এ খাতের উন্নয়নে বিভিন্ন জাতীয় পর্যায়ের প্রোগ্রাম বাস্তবায়ন করার ওপরও জোর দেন তিনি।