ছোট ব্যবসা কেন্দ্রগুলোর টিকে থাকার লড়াই এখনও চলছে
'স্মল ইজ বিউটিফুল' বা 'ছোটতেই সৌন্দর্য' শিরোনাম বইটির, যা ফুটিয়ে তোলে বড় ব্যবসা চালিত ও 'বৃহৎ মানেই উত্তম' নীতিতে চালিত বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় ক্ষুদ্র উদ্যোগের শক্তির দিকগুলো। কিন্তু, কোভিড-১৯ মহামারির আঘাতে সেই 'সৌন্দর্য' হারিয়েছে ছোট ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। তা সে ভৈরবের জুতা প্রস্তুতকারক হোন, কেরানীগঞ্জের ক্ষুদ্র পোশাক উৎপাদনকারী বা সিরাজগঞ্জের তাঁতি- সকলের জন্যই কঠিন হয়ে পড়েছে ব্যবসায় ফিরে আসা।
এসব স্থানীয় শিল্পের উৎপাদন কেন্দ্রগুলোর উদ্যোক্তারা সারাদেশের খুচরা বিক্রিবাট্টার ওপর নির্ভর করতেন, যাদের পাঁচভাগের একভাগ এখন ব্যবসার বাইরে। বাকীরা ঋণ পরিশোধ ও ব্যবসায় ফেরার জন্য জন্য অর্থসংকটে ভুগছেন। দরকারি মূলধন যোগাড় নিয়ে মরিয়া দশা তাদের।
ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের জীবন-জীবিকা মহামারি কীভাবে অল্প সময়েই তছনছ করে দিয়েছে, তারই উজ্জ্বল উদাহরণ- আজমল হোসেন।
কিশোরগঞ্জের ব্যবসা কেন্দ্র ভৈরব শহরের জুতা শিল্পের একজন উদ্যোক্তা আজমল হোসেন। করোনার আঘাতে মূলধন হারিয়ে জুতা উৎপাদক ও ব্যবসায়ী থেকে এখন অন্যের অটোবাইক চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন। অথচ দুই বছর আগেও তার কারখানা ও দোকানে কাজ করতো ১০ জন শ্রমিক।
নিজের বাসায় চারটি মেশিনের ছোট কারখানা ও ভৈরব মার্কেটে একটি দোকান ভাড়া নিয়ে প্রায় ১০ বছর ধরে পুরোদমে পাদুকার ব্যবসা করেছেন আজমল হোসেন। গত দেড় বছরে বারবার কোভিডজনিত বিধিনিষেধের কারণে ঋণী হয়ে ব্যবসা হারিয়েছেন তিনি।
প্রায় ১০ বছর আগে এ ব্যবসায় নামেন তিনি। মহামারি সবকিছু উল্টেপাল্টে দেওয়ার আগে তার কারখানায় ১০ জন শ্রমিক কাজ করতো, চলতো পুরোদমে উৎপাদন। তবে গত দেড় বছর ধরে থেকে থেকে কোভিড-১৯ জনিত বিধিনিষেধ তার ব্যবসায় ধস নামায়। ব্যবসায় মন্দা দেখা দেওয়ায় তিনি শ্রমিকদের বেতন পরিশোধ, দোকান ভাড়া ও সংসার চালাতে ধারকর্যও করেন।
মহামারির প্রকোপ কমে আসায় স্থানীয় বাজারের উৎপাদকরা আবার তাদের কার্যক্রম শুরু করছেন। কিন্তু, আজমলের মতো বিপুল লোকসান ও ঋণভারে জর্জরিত অনেকের পক্ষেই মূলধন যোগাড় করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি।
আর্থিক দুর্দশার চাপে ভারাক্রান্ত আজমল জানেন না পুঁজির কীভাবে পাওয়া যাবে।
তিনি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড'কে বলেন, 'আমি ব্যবসায় ফিরতে চা, কিন্তু দরকারি টাকা যোগাড়ের কোন উপায় আমার নেই।'
আজমলের মতো ব্যবসা থেকে ছিটকে পড়েছেন ভৈরবের জুতা শিল্পের অন্তত ২০ শতাংশ উদ্যোক্তা । যারা ব্যবসা শুরু করেছেন, তাদের বিক্রিও মহামারির আগের সময়ের তুলনায় অন্তত ৩০ শতাংশ কমেছে।
ভৈরব বাজারের একজন জুতা উৎপাদক মো. রোমান মিয়ে বলেন, 'আগে যেখানে দৈনিক ১০-১২ লাখ টাকার জুতা বিক্রি হতো, এখন সেখানে বিক্রি ৬-৭ লাখ টাকা।'
ভৈরবের ৫০ হাজারের বেশি জুতার কারিগরের মধ্যে ১০-১৫ হাজার এখনো মূলধন সংকটে কাজে ফিরতে পারেননি। যারা ফিরেছেন তারাও আগের মতো কাজ পাচ্ছেন না, বলে উল্লেখ করে রোমান জানান, সীমিত ভোক্তা চাহিদার ফলে সারাদেশের খুচরা বিক্রেতার সংখ্যা কমে এমন বিরুপ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।
মলিন দশা শুধু ভৈরবের পাদুকা উৎপাদন কেন্দ্রেরই নয়। স্থানীয় বাজারের জন্য উৎপাদিত তৈরি পোশাকের কেন্দ্র কেরানীগঞ্জ, বুটিক ও জামদানি শিল্পের প্রাণকেন্দ্র নারায়ণগঞ্জ এবং নরসিংদী, তাত শিল্পের সিরাজগঞ্জ, পাবনা এবং টাঙ্গাইলের চিত্রও একই।
প্রান্তিক মানুষের কেনাকাটা কমে যাওয়ায় ব্যবসা হারিয়েছে স্থানীয় ভোক্তাদের ওপর নির্ভরশীল উৎপাদন কেন্দ্রগুলো। কারণ প্রান্তিক ভোক্তাদেরও মহামারির প্রভাবে আয় কমেছে, ফলে তারা নিত্যপণ্য ছাড়া অন্যান্য সামগ্রী কিনতে টাকা খরচ করতে চাইছেন না।
আবার স্কুল-কলেজ, সড়কের ব্যবসাসহ কিছু খাত দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায়, প্রান্তিক মানুষের আয় কমেছে। ফলে তার প্রভাব পড়েছে স্থানীয় ব্যবসার কেন্দ্রগুলোতে।
বিশেষজ্ঞরাও বলছেন, প্রান্তিক মানুষের আয় সেভাবে পুনরুদ্ধার না হওয়ায় স্থানীয় ভোক্তা নির্ভর ছোট উৎপাদকদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ব্যবসায় ফিরতে পারেনি।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর টিবিএস;কে বলেন, 'জীবন বাঁচাতেই মানুষ নিত্যপণ্য কিনছে। স্বল্প ও মাঝারি আয়ের মানুষের খরচ সক্ষমতা কমায়, তাদের ওপর নির্ভর করে গড়ে ওঠা স্থানীয় ব্যবসা কেন্দ্রগুলো প্রচণ্ড ক্ষতির শিকার হয়।'
তিনি আরো বলেন, 'করোনায় উচ্চবিত্তদের আয়ে খুব একটা প্রভাব না পড়ায়, এই শ্রেণির ভোক্তার ব্যয় নির্ভর ব্যবসার বড় খাতগুলো পুনরুদ্ধারে ফিরেছে। তাছাড়া, দীর্ঘদিন পর রপ্তানিতেও ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছে। আর এ কারণে অর্থনীতি স্বাভাবিক দেখাচ্ছে'- যোগ করেন তিনি।
"করোনায় উচ্চবিত্তদের আয়ে খুব একটা প্রভাব না পড়ায় ব্যবসার বড় খাতগুলোও পুনরুদ্ধারে ফিরেছে। রপ্তানিতেও প্রবৃদ্ধি হয়েছে। আর এ কারণে অর্থনীতি স্বাভাবিক দেখাচ্ছে, যোগ করেন তিনি।
স্থানীয় বাজারের জন্য উৎপাদিত তৈরি পোশাকের কেন্দ্র কেরানীগঞ্জ, বুটিক ও জামদানির প্রাণকেন্দ্র নারায়ণগঞ্জ এবং নরসিংদী, তাত শিল্পের সিরাজগঞ্জ, পাবনা এবং টাঙ্গাইলের চিত্রও একই। প্রান্তিক মানুষের কেনাকাটা কমে যাওয়ায় ব্যবসা হারিয়েছে স্থানীয় ভোক্তাদের ওপর নির্ভরশীল উৎপাদন কেন্দ্রগুলো।
অল্প সংখ্যক মানুষ ছাড়া, বাকীদের আয় কমে যাওয়ার ফলেও স্থানীয় উৎপাদক ও ব্যবসায়ীদের একটা অংশ ফিরতে পারেননি বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের নির্বাহী চেয়ারম্যান ড. হোসেন জিল্লুর রহমান টিবিএস'কে বলেন, স্থানীয় চাহিদা পূরণকারী ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসার পুনরুদ্ধারে বাধা সৃষ্টি করছে ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি।
কারণ, স্থানীয় চাহিদার বেশিরভাগ উৎপাদক ও তাদের ক্রেতারা নিম্ন ও মধ্য আয় শ্রেণির। ফলে চড়ামূল্যের বাজারে তারা নিত্যপণ্য কিনতেই হিমশিম খাচ্ছেন। আরেকদিকে, বেড়ে চলেছে উৎপাদনের খরচ। সব মিলিয়েই স্থানীয় ব্যবসা কেন্দ্রগুলো আর্থিকভাবে ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না।
এই বাস্তবতায়, ভৈরব, সিরাজগঞ্জ ও কেরানীগঞ্জের উদ্যোক্তারা এখন ব্যবসা শুরু করতে মূলধন সহায়তা দানের দাবী করছেন।
এছাড়া, যারা কোনমতে ব্যবসায় ফিরেছেন তারাও সরকারের কাছে ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে জামানত মুক্ত ঋণ সুবিধা চেয়েছেন।
ড. হোসেন জিল্লুরও মনে করেন, এসব ব্যবসায়ীর সুরক্ষায় সরকারের একটি বিশেষ আর্থিক সহায়তা ঘোষণা করা উচিত।
উৎপাদনে ফেরেনি কেরানীগঞ্জের বহু কারখানা:
সারাদেশের স্থানীয় মার্কেটগুলোতে বিক্রিত শার্ট, প্যান্ট, টি-শার্ট, পাঞ্জাবী, থ্রি-পিসসহ স্থানীয় পোশাকের ৭০-৮০ শতাংশের যোগান দেয় ঢাকার কেরানীগঞ্জ ও বুড়িগঙ্গার তীরবর্তী অন্তত ৪০ শতাংশ কারখানা। নিম্ন ও মধ্যবিত্তের পোশাক উৎপাদনের কেন্দ্রস্থল হিসেবে পরিচিত এ কারখানাগুলোর অনেকেই এখানো উৎপাদনে ফিরতে পারেনি।
এখানকার পোশাক ব্যবসায়ীরা বলছেন, প্রান্তিক মানুষ মূলত ঈদেই বেশি পোশাক কিনেন। করোনার কারণে চারটি ঈদের স্বাভাবিক বিক্রির মৌসুম হারিয়ে, মূলধন হারিয়েছেন অন্তত ৫০ শতাংশ ব্যবসায়ী।
কারখানা-শো রুমের ভাড়া, শ্রমিকদের বেতন, মেশিনারি ও কাঁচামাল ক্রয় ও ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে পুরোপুরি ব্যবসা বন্ধ করেছেন কেউ কেউ।
তবে ঈদের আগে অনেকেই আবার উৎপাদনে ফিরবেন।
কেরানীগঞ্জ জেলা পরিষদ মার্কেটে নিজের কারখানার জিন্সপ্যান্ট পাইকারি বিক্রি করেন গোলেনুর গার্মেন্টেসের মালিক মুক্তার দেওয়ান। ২০১৯ সালে প্রায় চার কোটি টাকার পোশাক বিক্রি করলেও, গত মহামারির বছরগুলোয় বিক্রি এক কোটি টাকাও নয়। আগের পোশাক স্টক থাকায় এবং মূলধন সংকটে আপাতত কারখানা বন্ধ তার।
মোক্তার দেওয়ান দ্য বিজনেস স্টান্ডার্ডকে বলেন, 'পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে ঈদের আগে ঋণ করে আবার কারখানা চালু করবো।'
একই দূরাবস্থার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন, এখানকার প্রায় ১০ হাজার ব্যবসায়ী ও পাঁচ হাজারের বেশি কারখানার কারখানার মালিকরা। এসব কারখানায় কর্মসংস্থান হয়েছিল অন্তত সাড়ে তিন লাখ মানুষের। অনেক কারখানা উৎপাদনে না ফেরায় বেকার রয়েছেন বহু কর্মী।
মূলধন সংকটের পাশাপাশি চাহিদা না থাকায়, অনেকেই কারখানা চালু করেনি বলে জানিয়েছেন কেরাণীগঞ্জ ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি হাজী মুসলিম ঢালী।
তিনি বলেন, 'সাধারণত ঈদের তিন মাস আগে থেকে পূর্ণ গতি থাকে এখানকার কারখানায়। ঈদকে কেন্দ্র করে দুই থেকে আড়াই হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত পোশাক বিক্রি করেন স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। গত চার ঈদ ব্যবসা করতে না পারায়, মূলধন হারিয়ে আবার শুরু করতেও পারেননি তারা।'
অর্ডার ও উৎপাদনে শূন্যতায় বাটিক-জামদানি পল্লী:
নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার উপজেলার বাটিক গ্রামের ৩০ শতাংশ কারিগর মূলধনের অভাবে ব্যবসায় ফিরতে পারেননি।
যারা ব্যবসায় ফিরেছেন স্বল্প চাহিদার কারণে তারা অর্ডারও কম পাচ্ছেন।
প্রায় এক যুগ ধরে দেশীয় পোশাক বাটিক উৎপাদন ও বিপণন করছেন মো. বাচ্চু মিয়া। ২০২০ সালে সম্পূর্ণ পুঁজির ৬ লাখ টাকা বিনিয়োগ করে পুরো লোকসান গুনেছেন।
তিনি বলেন, 'দুই লাখ টাকা ঋণ নিয়ে আবার ব্যবসায় নেমেছি, কিন্তু আমার বিক্রি করোনার আগের অবস্থায় ফেরেনি।'
অন্যদিকে, সুতার দাম ২০-২৫ শতাংশ বেড়েছে। পোশাকের দাম বাড়েনি। ফলে কোনো রকমে টিকে থাকার জন্য কারখানা ও দোকান খুলেছি। ব্যবসায় মুনাফা নেই বললেই চলে- যোগ করেন বাচ্চু মিয়া।
বাচ্চু মিয়ার মতোই অবস্থা আড়াই হাজারের ৮-১০ হাজার উদ্যোক্তার। হারানো পুঁজি পুনরুদ্ধারের চেষ্টায় কেউ ব্যবসায় ফিরলেও অর্ডার সংকটে ভুগছেন তারা।
সংকট কাটেনি হস্তচালিত তাঁত শ্রমিকদের:
হস্তচালিত পোশাক উৎপাদনে দেশে সবচেয়ে বেশি কারিগর আছেন পাবনা-সিরাজগঞ্জে। এর মধ্যে, সিরাজগঞ্জ জেলার এনায়েতপুর, বেলকুচি, শাহজাদপুর, উল্লাপাড়া, কামারখন্দ, কাজীপুর ও সদর উপজেলাতে সাড়ে তিন লাখ তাঁত শ্রমিক শাড়ি, লুঙ্গি, গামছাসহ দেশীয় পোশাক উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত।
একইভাবে, টাঙ্গাইলের কালিহাতি, বাসাইল. নাগরপুর এবং পাবনার কয়েকটি উপজেলায় দেশীয় পোশাক উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত তিন লাখের বেশি তাঁতি।
তাঁত ব্যবসায়ীরা বলছেন, ১০ হাজার থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত পুঁজি নিয়ে ব্যবসায় নামেন তারা। তবে চাহিদা কম থাকা ও সুতার দাম বেড়ে যাওয়ায় অনেকেই ব্যবসায় নামেননি। করোনার পর বন্যার কারণেও ব্যবসায় নামতে পারেননি কেউ কেউ।
তারা বলছেন, সুতা প্রক্রিয়াজাতকরণ, নকশা তৈরিসহ তাঁতে শাড়ি, লুঙ্গি, গামছা তৈরিতে যেসব শ্রমিক কাজ করেন, তারা দীর্ঘদিন ধরে কর্মহীন থাকায় কেউ কেউ পেশা পরিবর্তন করেছেন। ফলে কারিগর সংকটও রয়েছে মালিকদের।
সিরাজগঞ্জ হ্যান্ডলুম এন্ড পাওয়ারলুম ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ফজলুর রহমান তালুকদার বলেন, করোনা ছাড়াও সুতার দাম আমাদের জন্য একটি বড় বাধা। উৎপাদন খরচ, কাঁচামাল, পরিবহন, শ্রমিক খরচ সব বাড়ায়, করোনা না থাকলেও উৎপাদনের আসছে না অন্তত ২৫-৩০ শতাংশ কারিগর।