মহামারি ও ইউক্রেন যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত ক্ষুদ্র ও মাঝারি প্রতিষ্ঠান, বাড়ছে অবসায়নের ঘটনা
পর পর দুটি প্রধান বৈশ্বিক সংকট – প্রথমে কোভিড-১৯ মহামারি আর তারপরেই ইউক্রেন যুদ্ধের অভিঘাতে – বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতোন বাংলাদেশের কোম্পানিগুলোও উল্লেখযোগ্য আর্থিক লোকসানের শিকার হয়েছে। ফলে গত তিন বছর ধরে – অবসায়নের আবেদনকারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বাড়ছে, যাদের অধিকাংশই হলো ক্ষুদ্র ও মাঝারি প্রতিষ্ঠান।
যৌথমূলধন কোম্পানি ও ফার্মসমূহের পরিদপ্তর (আরজেএসসি)-র তথ্যমতে, ২০২০ সালে বিশ্বব্যাপী মহামারির তাণ্ডব দেখা দেওয়ার পর থেকে প্রতি বছর দেশে কোম্পানি অবসায়নের সংখ্যা বাড়ছে। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম নয় মাসেই অবসায়নের সম্মুখীন ৩১৭টি প্রতিষ্ঠান। গত অর্থবছরে এমন প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ছিল ৩০১টি।
এর আগের অর্থবছরগুলোয় তুলনামূলক কম সংখ্যক কোম্পানি অবসায়িত হয়েছে: ২০২০-২১ অর্থবছরে ১৭৩টি, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৯৩টি এবং ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৮৪টি।
এই সময়ে অবসায়ন হওয়া কোম্পানির সবগুলোই ক্ষুদ্র ও মাঝারি প্রতিষ্ঠান – তাদের সম্মিলিত বিনিয়োগ ছিল প্রায় ১৭,৩০০ কোটি টাকা। বেশকিছু বিদেশি মালিকানাধীন কোম্পানিও রয়েছে অবসায়নের তালিকায়। অবসায়ন হলো এমন অবস্থা যখন কোনো কোম্পানি তাদের কার্যক্রম বন্ধ করে সম্পত্তি বিক্রি করতে চায়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিবন্ধিত কোম্পানিগুলোর অবস্থা কেমন– সে বিষয়ে সরকারের সঠিক নজরদারির অভাব, ছোট ব্যবসাগুলির জন্য সীমিত সহায়তা এবং ব্যবসাকে সুরক্ষিত রাখার অভাবেই অবসায়নের প্রবণতা বাড়ছে।
এ পরিস্থিতির উন্নয়নে সরকার ও সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোকে উন্নয়নশীল দেশে অর্থনীতির মেরুদণ্ড ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসার সমর্থনে– কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।
ভবিষ্যতে এসব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়া ঠেকাতে আরো উন্নত সরকারি নজরদারি ও সহায়তার প্রতিও গুরুত্ব দেন তারা।
অ্যারোলেট বিডি লিমিটেডের ঘটনা
পিভিসি পাইপ, প্লস্টিক ড্রাম ও পানি বহনের কনটেইনার তৈরির জন্য ২০১৬ সালে গাজীপুরের কালিয়াকৈর এলাকায় একটি কারখানা করেন লালবাগের ব্যবসায়ী সৈয়দ আশরার হোসেন। কারখানা ও ব্যবসা পরিচালনার জন্য 'অ্যারোলেট বিডি লিমিটেড' (Arolet Bd Ltd) নামে একটি কোম্পানির নিবন্ধন নেন।
শুরুর দিকে ব্যবসা ভালোই চলছিল। ২০১৮ সালের এপ্রিল মাসে একটি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় কারখানাটি বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এরপর পুনরায় ব্যবসা শুরু করতে ব্যাংক ঋণ নেন আশরার হোসেন। মহামারিকালে কারাখানা বন্ধ রাখতে হয় প্রায় ৬ মাস। এতে করে উৎপাদনে ব্যাপক ব্যাঘাত ঘটে। বাজারও হাতছাড়া হয়ে যায়।
সৈয়দ আশরার হোসেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, আগে প্রায় ২৫০ জন শ্রমিক কাজ করতো। আর পণ্যের বিপণনে কাজ করতো আরো প্রায় ৩০ জন।
তিনি জানান, ২০২০ সালের শেষ দিকে সীমিত শ্রমিক নিয়ে উৎপাদন কাজ শুরু করি, এরপরেও কোম্পানির ক্ষতি পুষিয়ে উঠছিল না। মাসিক আয় দিয়ে উৎপাদন ও পরিচালনার খরচও পূরণ করা যাচ্ছিল না।
'পূর্ণদ্যমে কার্যক্রম শুরু করতে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আবারো ৮০ কোটি টাকা ব্যাংক ঋণ নেই। এরপর গত বছর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে দুর্ভাগ্যজনকভাবে কাঁচামাল আমদানি বন্ধ হয়ে যায়, প্রতিনিয়তই ব্যবসা নিম্নমুখী হচ্ছিল' বলছিলেন আশরার।
২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে কোম্পানির চার পরিচালক– আশরার এবং তার তিন ভাইবোন – কোম্পানি অবসায়নের সিদ্ধান্ত নেন। কোম্পানিতে তাদের মোট বিনিয়োগ ছিল প্রায় ২০০ কোটি টাকা, এরমধ্যে ৬০ কোটি টাকাই ব্যাংক ঋণ ছিল বলে তিনি টিবিএসকে জানিয়েছেন।
আশরার বলেন, 'এভাবে ব্যবসা করলে ঢাকার বাড়িঘর বিক্রয় করে ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করতে হতো। তাই বেশ ক্ষতি হলেও অবসায়নে বাধ্য হয়েছি আমরা। এখন আমরা পারিবারিকভাবে পরিচালিত একটি হাউজিং কোম্পানি পরিচালনা করছি।'
কোনো কম্পানি গঠন ও অবসায়ন করতে হলে যৌথমূলধন কোম্পানি ও ফার্মসমূহের পরিদপ্তর (আরজেএসসি)-তে আবেদন করতে হয়। পরিদপ্তরের তথ্যমতে 'অ্যারোলেট বিডি লিমিটেড' স্বেচ্ছা অবসায়নের অবেদন করলে সকল প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে গত বছরের নভেম্বর মাসে কোম্পানিটি অবসায়িত ঘোষণা করা হয়।
স্বেচ্ছা অবসায়নের সংখ্যা বাড়ছে
আরজেএসসি'র দেয়া তথ্য বলছে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১০৮টি অবসায়নের আবেদন আসে, এরমধ্যে ৮৪টির চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়। এরমধ্যে স্বেচ্ছায় অবসায়নের আবেদন ছিল ৭৯টি। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১৩৬টি আবেদন জমা পড়ে, ৯৩টিতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়, এরমধ্যে স্বেচ্ছায় অবসায়নের আবেদন ছিল ৯১টি। ২০২০-২১ অর্থবছরে ২০০টি আবেদনের মধ্যে ১৪৩টির চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়, যার মধ্যে স্বেচ্ছায় অবসায়নের আবেদন ছিল ১৭৩টি। ২০২১-২২ অর্থবছরে ৩৬৫টি আবেদন জমা পড়ে, এরমধ্যে স্বেচ্ছায় অবসায়নের আবেদন ছিল ৩০১টি। আর চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের মার্চ পর্যন্ত ৪৬৩টি আবেদন জমা পড়েছে, যারমধ্যে স্বেচ্ছায় অবসায়নের আবেদন ৩২৪টি।
আরজেএসসি'র একটি সুত্র জানিয়েছে, আরো ৮১টি কোম্পানির স্বেচ্ছায় অবসায়নের প্রক্রিয়া চলমান। আর হাইকোর্টের আদেশে আরো ১১টির অবসায়ন প্রক্রিয়া চলমান। সুপ্রিম কোর্টে আরো ৬১ কোম্পানির অবসায়নের আবেদন নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে।
২০২১ সালে স্বেচ্ছায় অবসায়ন নেওয়া এমন একটি কোম্পানি হলো রিটাচ ফুটওয়্যার কোম্পানি লিমিটেড। আরজেএসসি কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক পারভেজ হোসেনকে অবসায়নকারী হিসেবে নিয়োগ দেয়।
অবসায়ন নেওয়ার জন্য কোম্পানির ব্যবসার মন্দা দশার কথাই উল্লেখ করেন পারভেজ।
২০২১ সালে অবসায়ন করা হয় সাফেকো লজিস্টিক অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি লিমিটেড, অবসায়নকারী ছিলেন সিরাজুল ইসলাম খান, এফসিএ। সিরাজুল জানান, বিদেশি এই প্রতিষ্ঠান নানান কারণে বাংলাদেশে ব্যবসা পরিচালনা করতে অক্ষম হওয়ায় স্বেচ্ছায় অবসায়নের আবেদন করে।
স্বেচ্ছা অবসায়নের প্রক্রিয়াধীন থাকা অন্য কোম্পানিগুলোর মধ্যে রয়েছে– চীনা কোম্পানি ব্রিলিয়ান্স ইন্টারন্যাশনাল কোম্পানি লিমিটেড; জাপানি কোম্পানি- মিক জাপান (বিডি) কোম্পানি লিমিটেড; চীনা কোম্পানি পিএইচএফজেড কোম্পানি লিমিটেড; পাবলিক ক্লথিং কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেড; পলি শিপিং কোম্পানি লিমিটেড এবং গ্লোবাল কমার্শিয়াল কোম্পানি লিমিটেড।
এর প্রভাব কতটা?
গত তিন বছর ধরে সারা বিশ্বের ব্যবসায়ীরা নানান ধরনের সমস্যার মধ্যে পড়েছে, তারই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশে কিছু কোম্পানি বন্ধ হয়ে গেছে বলে স্বীকার করে নেন বাংলাদেশ চেম্বার্স অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি জসীম উদ্দিন।
তবে তিনি উল্লেখ করেন যে, গত পাঁচ বছরে যেসব কোম্পানি বন্ধ হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে বৃহৎ কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছিল না; ফলে এসব প্রতিষ্ঠান বন্ধ হওয়ায় অর্থনীতিতে সামান্যই প্রভাব পড়েছে।
তার সাথে দ্বিমত পোষণ করে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, এভাবে কোম্পানি বন্ধ হয়ে যাওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি দেশের অর্থনীতির জন্য ভালো লক্ষণ নয়। এতোটা পরিমাণে বৃদ্ধি বাংলাদেশের পার্শ্ববর্তী কোনো দেশেই হয়নি।
যৌথমূলধন কোম্পানি ও ফার্মসমূহের পরিদপ্তরের রেজিস্ট্রারার শেখ শোয়েবুল আলম উল্লেখ করেন যে, ২০১৯ সাল থেকে এ বছরের মার্চ পর্যন্ত কোম্পানি নিবন্ধনের পরিমাণ বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। সে তুলনায় অবসায়নের সংখ্যা খুব নগন্য।
গত পাঁচ অর্থবছর কোম্পানি অবসায়নের সংখ্যা তীব্র হারে বৃদ্ধির কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, করোনা মহামারি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে রুগ্ন প্রতিষ্ঠানগুলো টিকে পারেনি।
দোষ কার?
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের 'বিজনেস রিভিউ'র গত বছরের ডিসেম্বরর এক গবেষণা বলছে, করোনা মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে সারা বিশ্বের ব্যবসায়ীরা নানাভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। কিন্তু, দক্ষিণ-এশিয়ায় ব্যবসার এই ক্ষতি সেভাবে পুষিয়ে উঠতে না পারার কারণ হলো– সরকারের সঠিক তদারকির অভাব, ব্যবসায়ীদের সূদুর প্রসারী পরিকল্পনার ঘাটতি ও সরকারের পক্ষ থেকে ব্যবসা রক্ষার তেমন কোনো উদ্যোগ না থাকা।
সে তুলনায়, জাপানের সরকার ব্যবসাগুলোকে বিভিন্নভাবে সহায়তার পদক্ষেপ নিয়েছে। গত বছর প্রায় ১৫৩টি কোম্পানি অবসায়নের প্রক্রিয়া শুরু করলেও, সরকারের উদ্যোগে প্রায় ৯৮টি কোম্পানি আবার পুনরুজ্জীবিত করা হয়। এজন্য সরকার সহজ সুদে ঋণ প্রদান, কর-ভ্যাট মওকুফ ও ব্যবসা ভালোভাবে মনিটরিং করার জন্য বিশেষ কমিটি গঠন করে দেয়।
কোম্পানি আইন বিশেষজ্ঞ ব্যারিস্টার তানজিব উল আলম বলেন, যখন কোনো কোম্পানির পরিচালকরা সেটি পরিচালনায় অক্ষম হয়, তখন স্বেচ্ছায় অবসায়নের আবেদন করেন। আবার কোনো কোম্পানিতে যখন মালিকানা নিয়ে দ্বন্দ্ব বা শেয়ারহোল্ডারদের মধ্যে মতভেদ দেখা দেয়, তখন কোম্পানিটি অবসায়নের জন্য আদালতের কাছে অবেদন করতে হয়।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের অল্পসংখ্যক কিছু প্রভাবশালী ব্যবসায়ী নানাভাবে দেশের সকল খাতের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেন। তারা নানাভাবে সরকারের সাথে সম্পৃক্ত। ব্যবসা ভালোভাবে পরিচালনার জন্য যতো সুযোগসুবিধা তারাই পান, ছোটরা বঞ্চিত হয়। ফলে ছোট ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা অনেক সময় ব্যবসা বন্ধ করতে বাধ্য হয়।
এসব দাবি নাকচ করে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেছেন, সরকার ব্যবসায়ীদের জন্য সকল ধরনের সুযোগসুবিধা দিচ্ছে। কোভিডের সময় প্রণোদনা ঋণসহ সকল ধরনের সহায়তা দিয়েছে।
এরপরেও কিছু প্রতিষ্ঠান ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে সমস্যার সম্মুখীন হয়ে থাকতে পারে বলে স্বীকার করে তিনি বলেন, রুগ্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান চিহ্নিত করতে কাজ করা হচ্ছে। তাদের সহায়তায় যথাযথ উদ্যোগ নেওয়া হবে।