ঢাকা ওয়াসার মেগা প্রজেক্ট
২০২৫ সালের মধ্যে পুরো ঢাকা শহরকে বর্জ্য-জল শোধন প্রক্রিয়ার মধ্যে নিয়ে আসার পরিকল্পনা নিয়েছে ঢাকা পানি সরবরাহ ও পয়োনিষ্কাশন কর্তৃপক্ষ (ওয়াসা)। বর্তমানে সংস্থার একমাত্র পয়োশোধনাগারটি পাগলায় অবস্থিত। এতে ঢাকার মোট বর্জ্য-জলের মাত্র ২০ শতাংশের পরিশোধন সম্ভব হয়। ৫ শতাংশ বর্জ্য-জল শোধন হয় বিভিন্ন বাড়ির সেপটিক ট্যাংকগুলোতে। বাকি ৮০ শতাংশ অপরিশোধিত অবস্থায় নগরীর খাল ও নদীতে চলে যায়। এর ফলে জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশগত, দুটো ক্ষেত্রেই সমস্যা তৈরি হচ্ছে।
ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী তাকসিম এ খান নিজেও মনে করেন, এমনটা হওয়া উচিত ছিল না, কিন্তু কিছু বাস্তবতা রয়েছে যেজন্য ঢাকায় এই অব্যবস্থাপনা চলছে বলে জানান তিনি।
তাকসিম বললেন, “পুরো ঢাকায় বর্জ্য-জল পরিশোধন প্ল্যান্ট বসাতে হলে বড়সড় বিনিয়োগ দরকার। বিশ্ব ব্যাংকের মতো আমাদের উন্নয়ন সহযোগীরা এতদিন পয়োশোধনাগারের জন্য অর্থ দিত না। ওরা শুধু পানীয় জল সরবরাহের প্রকল্পগুলোতে টাকা ধার দিয়েছে।”
তিনি জানালেন, বিশুদ্ধ পানি সরবরাহে ঢাকা ওয়াসা সম্প্রতি উল্লেখযোগ্য উন্নতি করেছে। তাই উন্নয়ন সহযোগীরা ঢাকার পয়োশোধনাগার প্রকল্পে ঋণ দিতে সম্মত হয়েছে।
২০১১ সালে এ বিষয়ে একটি মহাপরিকল্পনা গৃহীত হয়েছিল। যেটি ১৪ বছর সময়ের মধ্যে বাস্তবায়িত হবার কথা। কিন্তু ৮ বছরে এর কাজের মাত্র ২০ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে। সেজন্য নগর পরিকল্পনাবিদরা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রকল্পটির বাস্তবায়ন নিয়ে সন্দিহান।
তবে, দশেরকান্দি পয়োশোধনাগারের (স্যুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট) কাজ চলছে বলে জানালেন তাকসিম এ খান। ২০২১ সালের মধ্যে প্ল্যান্টটি চালু হবে। সেটি হলে সেখানে প্রতিদিন ৫০০ মিলিয়ন লিটার বর্জ্য-জল পরিশোধন সম্ভব হবে।
প্ল্যান্টটি গুলশান, বাড্ডা, আফতাবনগর, হাতিরঝিল, তেজগাঁও এবং এর সংলগ্ন এলাকাগুলোতে কাজ করবে।
দশেরকান্দির প্ল্যানটির অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল ২০১৫ সালে। কিন্তু কাজ শুরু হয় এর তিন বছর পর, গত বছরের আগস্ট মাসে। চীন সরকারের সহায়তায় নির্মিত এই মহাপরিকল্পনার অধীনে রয়েছে একটি বর্জ্য-জল শোধন প্ল্যান্ট, পাম্প স্টেশন ও পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থার নেটওয়ার্ক স্থাপন। ঢাকার পূর্বাঞ্চলের ৫০ লাখ মানুষ এ পরিকল্পনার আওতায় আসবেন।
প্রথম পরিকল্পনা অনুযায়ী, ২০১১ সালের জানুয়ারিতে কাজ শুরু হয়ে ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে প্রকল্পটি শেষ হবার কথা ছিল। কিন্তু ২০১৪ সালের নভেম্বরে হাইড্রো চায়নার সঙ্গে চুক্তি হবার আগে কাজ শুরু করতে পারেনি ঢাকা ওয়াসা। প্রকল্পের নির্মাণ-ব্যয় সাড়ে ৪১ কোটি মার্কিন ডলার। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে এটির শেষ হবার কথা রয়েছে।
এই মহাপরিকল্পনার অধীনে ৪টি নতুন পয়োশোধনাগার (স্যুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট,এসটিপি) নির্মাণ করবে ঢাকা ওয়াসা। পাশাপাশি, পাগলা পয়োশোধনাগারের ক্ষমতা বাড়ানো হবে যাতে এটি আরও বেশি পরিমাণে বর্জ্য-জল শোধন করতে পারে।
তাকসিম এ খান আরও জানালেন, নতুন ৪টি পয়োশোধনাগারের (এসটিপি) জন্য বিশ্ব ব্যাংক ৩০ কোটি মার্কিন ডলার দিচ্ছে। পাশাপাশি, পাগলায় চালু বর্তমানের পয়োশোধনাগারটির জন্যও একই পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ দিচ্ছে।
অন্য তিনটি শোধনাগার তৈরি হবে উত্তরা, মিরপুর ও রায়েরবাজারে। মিরপুর ও উত্তরার প্রকল্পগুলোর জন্য ইতোমধ্যে ভূমি জরিপ ও সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ সম্পন্ন হয়েছে।
প্রতিদিন ৬০ কোটি লিটার বর্জ্য-জল উৎপন্ন হয় এই শহরে। এখন পর্যন্ত এর ৭৫ শতাংশ, মানে প্রায় ৪৫ কোটি লিটার অপরিশোধিত অবস্থায় নদী ও খালে চলে যায়।
নগর পরিকল্পনাবিদ এবং স্থপতি ইকবাল হাবিব মনে করেন, ঢাকা ওয়াসার এই ব্যর্থতা ক্ষমার অযোগ্য।
পাগলার পয়োশোধনাগারটি এ ধরনের একমাত্র স্থাপনা হিসেবে সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ, অর্থাৎ ১২ কোটি লিটার বর্জ্য-জল শোধনের কাজ করছে।
এর পাশাপাশি শহরের ৫ শতাংশ গৃহস্থালী নিজস্ব সেপটিক ট্যাংক (মল শোধনাগার) স্থাপন করেছে, যেগুলো রোজ ৩ কোটি লিটার উৎপাদিত বর্জ্য-জল পরিশোধন করে।বাকি ৪৫ কোটি লিটার বর্জ্য-জল বিভিন্ন খাল ও নালার মাধ্যমে সরাসরি নদীতে গিয়ে পড়ে।
বর্জ্য-জল ব্যবস্থাপনার এই বিপন্ন চিত্র নিয়ে স্বভাবতই উদ্বিগ্ন বিশেষজ্ঞরা।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক এম এ মতিন পুরনো জরাজীর্ণ পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থাকেই এজন্য দায়ী করলেন।
“ওয়াসার পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থায় পাইপগুলোর অবস্থা অনেক জায়গাতে খুবই খারাপ হয়ে আছে। কিন্তু সময়মতো সেগুলো মেরামত করেনি ওরা।ফলে, মানব-বর্জ্য মিশে যাচ্ছে নর্দমায়, এমনকি ওয়াসার পানীয় জল সরবারাহের লাইনেও চলে আসছে সেসব।”
এই পরিবেশকর্মী মনে করেন, ওয়াসা যেসব মহাপরিকল্পনার ঝোঁকে আছে, তাদের উচিত ছিল বর্জ্য-জল শোধন প্রক্রিয়ার জন্য তহবিল সংগ্রহের ক্ষমতা রাখা।
ওয়াসার পয়োনিষ্কাশন বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মাসুদ-উল-করিম একটি তথ্য দিলেন। ঢাকার উত্তরা, মিরপুর, বনশ্রী, আফতাবনগর, বাড্ডা, তেজগাঁও, বারিধারা ও মোহাম্মদপুরসহ রাজধানীর আরও অনেক এলাকা এখনও বর্জ্য-জল পরিশোধনাগ প্রক্রিয়ার বাইরে রয়ে গেছে।
সূত্রমতে, বাড্ডা, আফতাবনগর, তেজগাঁও এবং হাতিরঝিল এলাকার বর্জ্য-জল বেগুনবাড়ি খালের মাধ্যমে বালু নদীতে চলে যায়। এরপর আরও কিছু খাল ও নালা বেয়ে পড়ে বুড়িগঙ্গা, তুরাগ ও শীতলক্ষ্যায়।
ওয়াসার পয়োনিষ্কাশন বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী সাজিয়া আফরীন জানালেন, ঢাকায় বর্জ্য-জল পরিশোধনের ক্ষমতা বাড়াতে আরও একটি মহাপ্রকল্প রয়েছে ওয়াসার। যা ২০৩৫ সালের মধ্যে বাস্তবায়িত হবে।
এই প্ল্যান্টটির আওতায় থাকবে রাজধানীর আশপাশের কিছু এলাকা, যেমন গাজীপুর, সাভার ও কেরানীগঞ্জ।
পাগলার শোধনাগারটি ১৯৭৮ সালে নির্মিত হয়। তবে এটি কাজ শুরু করে ১৯৯১ সালের জানুয়ারিতে। প্রতিদিন গড়ে ১২ কোটি বর্জ্য পরিশোধন করে এটি।
ওয়াসার পরিচালক (উন্নয়ন) এম এ কাশেম জানান, পাগলার শোধনাগারে এখনও বর্জ্য-জল শোধনের ক্ষেত্রে পলি-জমানো পুকুরের ব্যবহার হচ্ছে। সেখানে শোধনের পর পরিশোধিত পানি বিশেষ ধরনের বিশাল আকারের খালে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ‘লেগুন’ নামে পরিচিত এসব খালে পরিশোধিত পানি তিন দিন রাখা হয়। এ সময় লেগুনে থাকা ব্যাকটেরিয়াগুলো পানির বাকি ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস করে। এভাবে পানি পুরোপুরি শোধনের পর শীতলক্ষ্যা নদীতে পাঠানো হয়।