তিন প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণে ভুগছে রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংক
হাতেগোনা তিনটি প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণের কারণে ভুগছে রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংক। বর্তমানে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের প্রায় অর্ধেক ক্রিসেন্ট গ্রুপ, রিমেক্স ফুটওয়্যার ও অ্যানন টেক্স গ্রুপের কাছে। এই প্রতিষ্ঠানগুলোর খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল হলে জনতা ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ অর্ধেকের বেশি নেমে আসবে।
জনতা ব্যাংকের মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ চলতি বছরের জুন শেষে ১৩ হাজার ৫০৯ কোটি টাকা। এরমধ্যে তিন প্রতিষ্ঠানের মার্চ পর্যন্ত খেলাপির পরিমাণ ৬,৬২৯ কোটি টাকা। যা মোট খেলাপি ঋণের ৪৮.৫৬ শতাংশ।
তফসিলি ব্যাংকগুলো ব্যাংকিং খাতের সামগ্রিক উন্নয়ন ও সম্ভাব্য ঝুঁকি রোধে ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সভায় শীর্ষ-২০ ঋণগ্রহীতা ব্যাক্তি বা প্রতিষ্ঠানের ক্রেডিট রিস্ক ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড রিজল্যুশন রিপোর্ট উপস্থাপন করে।
সম্প্রতি ১৪ সেপ্টেম্বর পরিচালনা পর্ষদের ৬৮২ তম সভায় অনুমোদিত প্রতিবেদনে জনতা ব্যাংকের এমন চিত্র পাওয়া গেছে।
জনতা ব্যাংকের শীর্ষ খেলাপি অ্যানন টেক্স গ্রুপ। এ গ্রুপটির দুটি প্রতিষ্ঠান জনতা ব্যাংকের স্থানীয় শাখা থেকে ২৫৫ কোটি ৪৮ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছে।
এছাড়া জনতা ভবনের কর্পোরেট শাখা থেকে একই গ্রুপের ২০টি প্রতিষ্ঠান ৬,৩৫২ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। এ ঋণের মধ্যে ৩,৩৯৮ কোটি টাকা খেলাপি। পুরো চিত্র অনুযায়ী এ ব্যাংকের মোট খেলাপি ঋণের ২৬.৭৭ শতাংশ এই গ্রুপটির।
ঋণ পুনঃতফসিলের বিশেষ নীতিমালায় দু'বছর আগে দুই শতাংশ ডাউনপেমেন্টে অ্যানন টেক্স গ্রুপের সাত প্রতিষ্ঠানের ঋণ নিয়মিত করেছিল জনতা ব্যাংক। পুনঃতফসিলের পর এক টাকা না দিলেও করোনার কারণে গত বছরও এসব ঋণ নিয়মিত ছিল।
তবে নিয়মবহির্ভূত সুবিধা দেওয়ায় অ্যানন টেক্সের পুনঃতফসিল ও সুদ মওকুফ সুবিধা বাতিল করে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে করে ঋণ অনিয়ম ও জালিয়াতিতে অভিযুক্ত গ্রুপটির ৩ হাজার ৬৫৩ কোটি টাকার ঋণ এখন খেলাপি। অ্যানন টেক্স গ্রুপের নামে সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ জালিয়াতির তদন্ত করছে দুদক।
অ্যানন টেক্স গ্রুপের চেয়ারম্যান এবং ম্যানেজিং ডিরেক্টর ইউনুস বাদল বলেন, "খেলাপি ঋণের বিষয়ে আমি কিছু বলব না, জনতা ব্যাংকের এমডির সঙ্গে কথা বলেন। আমরা জনতা ব্যাংকের সঙ্গে এখন কার্যক্রম করছি না।"
দ্বিতীয় শীর্ষ খেলাপি ক্রিসেন্ট গ্রুপের জনতা ব্যাংকের ফান্ডেড ও নন-ফান্ডেড মোট ঋণের পরিমাণ হলো ২ হাজার ৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে তাদের খেলাপির পরিমাণ ১ হাজার ৮৯৬ কোটি টাকা। যা মোট খেলাপি ঋণের ১৩.৮৯ শতাংশ।
সরকারি ব্যাংক থেকে ক্রিসেন্ট গ্রুপের ঋণ জালিয়াতির অভিযোগেও দুদক তদন্ত করছে। এর মধ্যে ১ হাজার ৭৪৫ কোটি ৬৬ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে গ্রুপের কর্ণধার এম এ কাদেরসহ ২২ জনের বিরুদ্ধে ৫টি মামলা করে দুদক। এর মধ্যে ব্যাংক কর্মকর্তা রয়েছেন ১৫ জন ও ৭ জন গ্রুপের কর্মকর্তা। মামলাগুলো বিচারাধীন রয়েছে। গত ৩০ জানুয়ারি গ্রেফতার করা হয়েছে ক্রিসেন্ট লেদার প্রোডাক্টস লিমিটেড ও ক্রিসেন্ট ট্যানারিজ লিমিটেডের চেয়ারম্যান এম এ কাদেরকে।
ক্রিসেন্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান এম এ কাদেরের ছোট ভাই রিমেক্স ফুটওয়্যার লিমিটেডের চেয়ারম্যান ও জাজ মাল্টিমিডিয়ার মালিক আব্দুল আজিজ। তার প্রতিষ্ঠান রিমেক্স ফুটওয়্যার জনতা ব্যাংকের তৃতীয় শীর্ষ খেলাপির তালিকায়।
প্রতিষ্ঠানটি জনতা ব্যাংকের স্থানীয় শাখা থেকে ফান্ডেড ও নন-ফান্ডেড ঋণ নিয়েছে ১,১৩৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে এখন পর্যন্ত ব্যাংকের নিয়মিত ঋণের পরিমাণ মাত্র ৫৫ কোটি টাকা। বাকি ১০৭৮ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ। তবে, জনতা ব্যাংক জাজ মাল্টিমিডিয়ার সম্পত্তি নিলামে বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
এদিকে রাষ্ট্র-মালিকানাধীন চারটি ব্যাংকের ২১ সালের সমঝোতা স্মারকে জনতা ব্যাংকের শীর্ষ ২০ খেলাপি গ্রাহক থেকে জুন পর্যন্ত ৮০০ কোটি টাকা উত্তোলনের লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও ব্যাংকটি মাত্র ৭ কোটি ৪০ লাখ টাকা আদায় করেছে। যা মোট লক্ষ্যমাত্রার ০.৯ শতাংশ।
একইসঙ্গে এই শীর্ষ ২০ খেলাপি ব্যাতিত অন্যান্য ২০ খেলাপি গ্রাহক থেকে ৪০০ কোটি টাকা আদায়ের লক্ষ্য নির্ধারণ করলেও ব্যাংকটি ৩১ কোটি টাকা আদায় করেছে। যা লক্ষ্যমাত্রার ৭.৮৯ শতাংশ।
জনতা ব্যাংক চার বছর আগে রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকগুলোর মধ্যে অর্থনীতির সব কয়টি সুচকে ভালো অবস্থানে ছিল। ২০১৬ সালের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকটির মোট খেলাপির পরিমাণ ছিল ৪,১১৬ কোটি টাকা বা ১১.৪৬ শতাংশ। এরপর ২০১৭ সালের খেলাপি ঋণ কিছুটা বেড়ে ৫,৮১৮ কোটি টাকায় পৌঁছে। ২০১৮ সালে খেলাপি ঋণ প্রায় তিন গুণ বেড়ে ১৭,২২৪ কোটি টাকায় দাঁড়ায়। ২০১৯ এর ডিসেম্বর শেষে দাঁড়ায় ১৪,৪৫২ কোটি টাকা। ২০২০ এর ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকটির খেলাপির পরিমাণ দাঁড়ায় ১৩,৬২২ কোটি টাকা বা ২৪.৯১ শতাংশ।
শীর্ষ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণের কারণে নানা সমস্যার চিত্র জনতা ব্যাংকের ক্রেডিট রিস্ক ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড রিজল্যুশন রিপোর্টে উঠে এসেছে। এরমধ্যে অন্যতম হলো খেলাপি ঋণের সুদ আয় খাতে নেয়া যায় না, যার ফলে ব্যাংকটির আয় কমে যাচ্ছে। এছাড়া শ্রেণিকৃত ঋণের বিপরীতে অতিরিক্ত প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হচ্ছে, যার কারণে নীট মুনাফার পরিমাণ কমে যাচ্ছে।
একইসঙ্গে খেলাপি ঋণের কারণে নগদ অর্থ কমে যাওয়ায় ফান্ড ম্যানেজমেন্টে বিঘ্ন সৃষ্টি হয়। ব্যাংকের নীট মুনাফা ও মূলধনের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ে। এছাড়া, নতুন ঋণ দেওয়ার প্রক্রিয়াও ব্যাহত হচ্ছে।
ব্যাংকটি শ্রেণিকৃত ঋণ থেকে ঝুঁকি নিরসনে কয়েকটি প্রস্তাবনা নিয়েছে। এর মধ্যে নতুন করে শ্রেণিকৃত না হওয়ার ব্যাপারে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো, যেসব শ্রেণিকৃত ঋণের বিপরীতে এখনও মামলা হয়নি তাদের সঙ্গে আলোচনা করে সমঝোতার মাধ্যমে ঋণ আদায় চেষ্টা করা, অন্যথায় মামলা দায়েরের ব্যবস্থা গ্রহণ করাসহ বিভিন্ন লক্ষ্যমাত্রা গ্রহণ করার কথা বলা হয়েছে।
এদিকে খেলাপি ঋণ ও মন্দ ঋণের বিপরীতে জনতা ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে রাখা সঞ্চিতি সংরক্ষণে বড় ধরনের সমস্যায় ভুগছে। ব্যাংকটি ৬,৯০০ কোটি টাকা প্রভিশন সংরক্ষণের মধ্যে মাত্র ৩,০৮৪ কোটি টাকা সংরক্ষণ করতে পেরেছে। এখনও প্রতিষ্ঠানটির প্রভিশন ঘাটতি রয়েছে ৩,৮১৮ কোটি টাকা।