দুর্বল ব্যবস্থাপনা সম্পন্ন ব্যাংকে প্রণোদনা বাতিলের আহ্বান সিপিডি'র
দুর্বল ব্যবস্থাপনা সম্পন্ন ব্যাংকগুলোকে সরকারি প্রণোদনা সংক্রান্ত ঋণ বিতরণের দায়িত্ব থেকে বিরত রাখার পরামর্শ দিয়েছে সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি)।
প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তরা যাতে প্রণোদনা সুবিধা ভোগ করতে পারে, সেই বিষয়টি নিশ্চিত করতে ঋণ খেলাপীদের প্রণোদনার বাইরে রাখার পরামর্শ দিয়েছেন দেশের শীর্ষস্থানীয় গবেষণা সংস্থাটির গবেষকরা।
সংস্থার পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এক দশক ধরে উচ্চ খেলাপি-ঋণসহ বিভিন্ন অনিয়মের জন্য যেসব ব্যাংকের আর্থিক অবস্থার অবনতি ঘটেছে তাদের প্রণোদনা বিতরণের দায়িত্ব দেওয়া হলে; ঋণ অবলোপন, অনিয়ম ও দুর্নীতির বাড়তি চাপ সৃষ্টি হতে পারে।
গত সোমবার "২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি" শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষ্যে আয়োজিত সংবাদ ব্রিফিংয়ে এমন প্রস্তাব দেয়া হয়।
এছাড়াও, ব্যাংকিং খাতে বাড়তে থাকা তারল্য নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেন বক্তারা। অতিরিক্ত অর্থ ব্যাংকারদের ঝুঁকিপূর্ণ খাতে ঋণ সরবরাহ বৃদ্ধি করতে প্রলুদ্ধ করতে পারে বলেও মন্তব্য করা হয়। ফলস্বরূপ; বাড়বে খেলাপি ঋণের পরিমাণ।
সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, খেলাপি ঋণ বিবেচনার মাধ্যমেই প্রণোদনা বিতরণের সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।
ব্যাংকিং খাতে বর্তমানে ঋণ খেলাপির সংখ্যা তিন লাখেরও বেশি। প্রণোদনায় বিতরণকৃত অর্থের কতটুকু ফেরত আসবে সেটিও বিবেচনা করার কথা বলেন ড. ফাহমিদা।
বছরব্যাপী ঋণ পরিশোধে বিলম্বনাধিকার বা মরাটোরিয়ামের জন্য বর্তমানে প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিস্থিতি বোঝাটাও কঠিন বলে মন্তব্য করেন তিনি।
বৃহৎ দুই প্রণোদনার প্যাকেজই ঋণ-খেলাপিদের সুবিধা বিবেচনায় প্রণয়ন করা হয়েছে। ফলে, বাড়তে পারে খেলাপি ঋণের মাত্রা। আর তাই, বিতরণকৃত অর্থ কোথায় যাচ্ছে তা নির্ণয়ে, লোনের শর্ত অনুযায়ী অর্থ সাহায্যের উপরে জোর দেন তিনি।
দুর্বল ব্যবস্থাপনা ও সুশাসনের ঘাটতি আছে, এমন ব্যাংকগুলো কোভিড-১৯ প্রণোদনা পাচ্ছে কি না তা নিয়ে কোনো নির্ভরযোগ্য তথ্য নেই বলেও মন্তব্য করেন ফাহমিদা। এছাড়া, কোন ব্যাংক কী পরিমাণ সাহায্য পেয়েছে এবং কী পরিমাণ অর্থ ঋণ হিসেবে বিতরণ করছে সে সম্পর্কেও কোনো তথ্য নেই বলে উল্লেখ করেন ফাহমিদা।
কতজন ঋণখেলাপি প্রণোদনা প্যাকেজ থেকে নতুন করে ঋণ পেয়েছে সে বিষয়েও প্রশ্ন তুলেন তিনি। কোনো ঋণগ্রহীতা সন্দেহজনকভাবে বড় অংকের ঋণ নিয়েছেন কি না, প্রতিটি ব্যাংকে ঋণ খেলাপির হার কত এবং সমগ্র ব্যাংক খাতে এর পরিমাণ কী এবং ব্যাংক গুলো কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসাকে প্রণোদনার জন্য চিহ্নিত করছে সে সম্পর্কেও প্রশ্ন রাখেন তিনি।
অনুষ্ঠানে সিপিডির জ্যেষ্ঠ রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান অর্থনীতির বিভিন্ন বিষয় উপস্থাপন করেন। তিনি বলেন, কোভিড-১৯ ত্রাণ তহবিলের মাত্র ১৯ দশমিক ২৯ শতাংশ ব্যয় হবে প্রনোদনায়, যা মোট জিডিপির দশমিক ৮৩ শতাংশ ।
তিনি বলেন, তহবিলের বড় অংশই বৃহৎ এবং মাঝারি শিল্পগুলোর কাছে যাচ্ছে। অন্যদিকে, ক্ষুদ্র শিল্প উদ্যোক্তাদের সাথে ব্যাংকের সম্পর্ক, যথাযথ কাগজপত্র সরবরাহ ইত্যাদি নানা বিষয়ে জটিলতা আছে।
প্রণোদনার বৈষম্যমূলক বিতরণ অর্থনীতির পুনরুদ্ধারেও বৈষম্য সৃষ্টি করবে। বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো এগিয়ে থাকলেও, ক্ষুদ্র শিল্পগুলো পিছিয়ে পড়বে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
তারল্য সংকট নিয়ে নতুন উদ্বেগ:
আয়োজনে প্রদর্শিত প্রতিবেদন অনুসারে ব্যাংক খাতে তারল্যের পরিমাণ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে, ব্যাংক খাতে আর্থিক স্থিতিশীলতা অর্জন, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও সঞ্চয়কারীদের লভ্যাংশে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হবে বলে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।
তৌফিকুল ইসলাম জানান, ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বরের মধ্যবর্তী সময়ে ব্যাংক খাতে তারল্যের পরিমাণ ১.০৩ লাখ কোটি টাকা থেকে ২.০৫ লাখ কোটি টাকায় গিয়ে পৌঁছেছে। অর্থাৎ এক বছরে এই মান বৃদ্ধির হার প্রায় দ্বিগুণ।
রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে তারল্যের মান দ্বিগুণের বেশি বাড়লেও ইসলামী ব্যাংকগুলোতে এই হার তিন গুণেরও বেশি। অতিরিক্ত তরল সম্পদের ৪৯ শতাংশই ব্যাংক খাতের বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
তরল অর্থের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ায় সুদের হার কমার পরিমাণ পয়েন্ট টু পয়েন্ট মুদ্রাস্ফীতির গড়মানেরও নিচে নেমে এসেছে। ফলে, সঞ্চিত অর্থের মূল্য কমবে বলে মন্তব্য করেন তৌফিকুল। পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে মূল ডিপোজিটের হার ২০২০ সালের জানুয়ারিতে দশমিক ১২ শতাংশ থাকলেও, নভেম্বরে গিয়ে তা মাইনাস দশমিক ৮৮ শতাংশে গিয়ে পৌঁছায়।
ব্যাংকে আমানতের সুদের হার ঋণাত্মক হওয়ার অর্থ মহামারী চলাকালীন সময়ে মানুষের সঞ্চয় দিন দিন হ্রাস পেয়েছে। অথচ, এরকম প্রতিকূল সময়ে সঞ্চিত অর্থের প্রয়োজন সবথেকে বৃদ্ধি পায় বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
তারল্যের কারণে সৃষ্ট ক্ষতিপূরণ হ্রাসে ব্যাংকগুলো নির্বিচারে ঋণ বিতরণ করে থাকে। ফলে, ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগের কারণে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি পায় বলে জানান তৌফিকুল।
এদিকে, ব্যাংকগুলোকে বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পে বিনিয়োগের জন্য উৎসাহিত করা হচ্ছে। কিন্তু, বেসরকারি খাতে ঋণ বিতরণ কমে যাওয়ায় বিনিয়োগে ঘাটতির আশঙ্কাও করেন তিনি।
সিপিডির সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, তারল্য সংকটের প্রভাব দীর্ঘকালীন হতে পারে। তরলতা বৃদ্ধির কারণে ব্যাংকে ফান্ড খরচ বৃদ্ধি পাবে। অন্যদিকে, সঞ্চয়কারীরাও সঞ্চিত অর্থে মুদ্রাস্ফীতির চাইতে অধিক সুদ আদায় করতে ব্যর্থ হলে ব্যাংকে অর্থ আমানত রাখার ব্যাপারে নিরুৎসাহিত হবে।