৩,৩০০ কোটি টাকা ঋণ; ডুবতে বসেছে এক সময়ের সফল প্রতিষ্ঠান প্রভিটা গ্রুপ
২০০১ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত প্রায় দুই দশক ধরে দেশের পোল্ট্রি খাতে নেতৃত্বস্থানীয় প্রতিষ্ঠান ছিল বেসরকারি খাতের প্রভিটা গ্রুপ। এ সময়ের মধ্যে ভালো ব্যবসা করায় ব্যাংকগুলো উদার হস্তে ঋণ দেয় গ্রুপটিকে। গ্রুপটি তখন দেশের বিভিন্ন জায়গায় জমি কিনে বিলাসী প্রকল্প গড়ে তোলে।
তবে কোভিড-১৯ মহামারিতে বিপাকে পড়ে প্রভিটা গ্রুপ। সারাদেশে মুরগির চাহিদা কমে যাওয়ায় একদিনের বাচ্চা বিক্রি কমে যায়। তখন বাচ্চা পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটে। এভাবে টানা লোকসানে পড়ে ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল সংকটে পড়ে গ্রুপটি।
করোনা পরবর্তী সময়ে গ্রুপটি নতুন করে ব্যবসা শুরু করতে চাইলে তখন ব্যাংকগুলো হাত গুটিয়ে নেয়।
সেই ধারাবাহিকতায় এখন ৩,৩০০ কোটি টাকা ঋণ মাথায় নিয়ে ডুবতে বসেছে প্রভিটা গ্রুপ।
করোনা পরবর্তী সময়ে ভালোভাবে ব্যবসায় ফিরতে না পারায় প্রতিষ্ঠানটির কাছে ২০টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগকৃত ঋণ খেলাপি হতে শুরু করেছে।
ঋণখেলাপি হওয়ায় গ্রুপটির কর্ণধারদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেওয়াও শুরু করেছে পাওনাদার ব্যাংকগুলো।
পাওনাদার ব্যাংক ও আদালতের তথ্যমতে, প্রভিটা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক, চেয়ারম্যান ও পরিচালকের বিরুদ্ধে ঋণ খেলাপি (অর্থঋণ- ২টি) ও চেক প্রত্যাখানের (এনআই অ্যাক্ট- ১৮ টি) ঘটনায় এ পর্যন্ত কমপক্ষে ২০টি মামলা দায়ের হয়েছে।
এরমধ্যে ব্যাংক এশিয়ার দায়ের করা মামলায় প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক নুরুন নবী ভূঁইয়া, তার স্ত্রী ও গ্রুপের চেয়ারম্যান সুলেখা ইব্রাহিম এবং তাদের ছেলে ও গ্রুপের পরিচালক রিদওয়ানুল হক ভূঁইয়ার বিরুদ্ধে দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন আদালত।
১৭৩ কোটি টাকা ঋণ আদায়ে ব্যাংক এশিয়ার দায়ের করা মামলায় চট্টগ্রাম অর্থ ঋণ আদালতের বিচারক মুজাহিদুর গত ৮ জানুয়ারি এই আদেশ দেন। অর্থঋণ আদালতের তথ্যমতে, ১৭৩ কোটি টাকা খেলাপি পাওনা আদায়ে গত বছরের ১২ নভেম্বর প্রভিটার কর্ণধারদের বিরুদ্ধে অর্থঋণ মামলা দায়ের করে ব্যাংক এশিয়া।
ব্যাংক এশিয়ার খাতুনগঞ্জ শাখার ব্যবস্থাপক সুবির পাল বলেন, "প্রভিটা গ্রুপের চারটি প্রতিষ্ঠান প্রভিটা ফিড, প্রভিটা ব্রিডার্স, প্রভিটা চিকস এবং প্রভিটা হ্যাচারিতে বিনিয়োগকৃত ১৭৩ কোটি টাকা দীর্ঘদিন ধরে ফেরত দিচ্ছে না গ্রুপটির কর্ণধার। তাই টাকা আদায়ে তাদের বিরুদ্ধে ঋণ খেলাপি মামলা দায়ের করা হয়েছে।"
তিনি বলেন, "এই ঋণের বিপরীতে নোয়াখালীর সুবর্ণচর ও চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে ৪ হাজার শতক জমি বন্ধক রয়েছে। যার বাজার মূল্য সর্বোচ্চ ৮৮ কোটি টাকা।"
এর আগে গত বছরের বিভিন্ন সময়ে গ্রুপটির স্বত্বাধিকারীদের বিরুদ্ধে ৫টি চেক প্রত্যাখান (এনআই অ্যাক্ট) মামলাও দায়ের করে ব্যাংকটি।
ব্যাংক এশিয়া ছাড়াও প্রভিটার দুই প্রতিষ্ঠানের কাছে ইউসিবিএল'র ৪১৬ কোটি টাকা, দুই প্রতিষ্ঠানের কাছে স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের ৩৬৭ কোটি টাকা, তিন প্রতিষ্ঠানের কাছে ওয়ান ব্যাংকের ৩২৬ কোটি টাকা, দুই প্রতিষ্ঠানের কাছে পূবালী ব্যাংকের ২৫৭ কোটি টাকা, দুই প্রতিষ্ঠানের কাছে আল আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকের ২১৯ কোটি টাকা, দুই প্রতিষ্ঠানের কাছে ন্যাশনাল ব্যাংকের ১৭৫ কোটি টাকা, সাউথ বাংলার ১৫৯ কোটি টাকা, মার্কেন্টাইলের ১৪৪ কোটি টাকা, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের ১০৬ কোটি টাকা, ব্র্যাক ব্যাংকের ৯৯ কোটি টাকা, ইসলামী ব্যাংকের ৯৪ কোটি টাকা, ইউনিয়ন ব্যাংকের ৯২ কোটি টাকা, সিটি ব্যাংক ৮৯ কোটি টাকা, ট্রাস্ট ব্যাংক ৮৬ কোটি টাকা, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক ৮৪ কোটি টাকা, লিজিং প্রতিষ্ঠান এবিআইবিএ ৬৫ কোটি টাকা, মিচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ৪৬ কোটি টাকা, যমুনা ব্যাংকের ২১ কোটি টাকা, ডাচ বাংলা ব্যাংকের ১৭ কোটি টাকা, আইএফআইসি'র ১২ কোটি টাকা, আইডিএলসি'র ১১ কোটি টাকা এবং আইপিডিসি'র ৩.৫ কোটি টাকা পাওনা আটকে আছে।
প্রভিটা গ্রুপের প্রতিষ্ঠান– প্রভিটা চিকস লিমিটেড, প্রভিটা হ্যাচারিজ লিমিটেড, প্রভিটা ব্রিডার্স লিমিটেড, প্রভিটা ফিড লিমিটেড, প্রভিটা ফিশ ফিড, ক্ল্যাসিক প্রভিটা এগ্রো, প্রভিটা পোল্ট্রি ফিড, এবিএইচ করপোরেশন, আফ্রা ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, আরএইচ করপোরেশন, রিদওয়ান ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, এমএন ট্রেড ইনটারন্যাশনাল, গ্যালাক্সি ট্রেডিং ইন্টারন্যাশনালের নামে বিভিন্ন সময়ে এসব ঋণ নেওয়া হয়েছে।
ইসলামী ব্যাংক খাতুনগঞ্জ শাখার ব্যবস্থাপক মো. জামাল উদ্দিন বলেন, "প্রভিটা গ্রুপের এবিএইচ করপোরেশনের কাছে ১০০ কোটি টাকা ঋণ খেলাপি হয়ে গেছে। এর আগে ঋণটি রিসিডিউলের প্রস্তাব দিলেও ডাউন পেমেন্ট পরিশোধ করেননি প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার। ফলে পাওনা আদায়ে এখন অর্থঋণ মামলা দায়েরের প্রক্রিয়া চলছে। এরমধ্যে প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধারদের বিরুদ্ধে ৮টি চেকের (এনআই অ্যাক্ট) মামলা দায়ের হয়েছে।"
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা বলেন, "প্রভিটা গ্রুপের কাছে বিতরণ করা জুবলি রোড শাখার ঋণটি ইতোমধ্যে রিসিডিউল করে রেগুলার রাখা হয়েছে। তবে গ্রুপটিকে নতুন কোনো অর্থায়ন বা আমদানি সুবিধা দেওয়া হচ্ছে না।"
ওয়ান ব্যাংক লিগ্যাল ডিপার্টমেন্টের একজন কর্মকর্তা জানান, প্রভিটার কাছে কারওয়ান বাজার শাখার ২৩০ কোটি টাকার বেশি পাওনা আটকে রয়েছে। এরমধ্যে ৭৬ কোটি টাকা ঋণ খেলাপি হওয়ায় প্রভিটা ফিশ ফিডের নামে ৫টি এনআই অ্যাক্ট মামলা দায়ের করা হয়েছে। খেলাপি হওয়া ৭৬ কোটি টাকার বিপরীতে ব্যাংকের কাছে কোলাটারেল রয়েছে মাত্র ৪ কোটি ৮৩ লাখ টাকা।
উপরোক্ত ব্যাংক ছাড়াও প্রভিটা গ্রুপের কাছ থেকে ২২ কোটি ৮৫ লাখ টাকা পাওনা আদায়ে গত ২৫ নভেম্বর যমুনা ব্যাংক একটি খেলাপি মামলা দায়ের করেছে বলে নিশ্চিত করেছেন চট্টগ্রাম অর্থঋণ আদালতের বেঞ্চ সহকারি রেজাউল করিম।
সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট এ এম সালেহ উদ্দিন কুতুবী বলেন, "গ্রুপটির তিন প্রতিষ্ঠান রিদওয়ান ট্রেড, প্রভিটা হ্যাচারি এবং প্রভিটা ফিডের কাছে ৯০ কোটি টাকা ওভারডিও হয়ে গেছে। এই পাওনা আদায়ে আমরা আইনি প্রক্রিয়া শুরু করেছি।"
পাওনাদার ব্যাংক ও সংশ্লিষ্ট গ্রুপের কর্মকর্তারা জানান, ২০০১ সালের দিকে চট্টগ্রামে পোল্ট্রি ফিডের ব্যবসা শুরু করেন প্রভিটা ফিডের কর্ণধার নুরুন্নবী ভূঁইয়া।
প্রথমে ফিডের মাধ্যমে ব্যবসা শুরু করলেও পরবর্তীতে পোল্ট্রি ফিড, ফিশ ফিড, হ্যাচারি, ডে-ওল্ড চিকেন, কমার্শিয়াল চিকেন, লেয়ার চিকেনসহ বিভিন্ন খাতে ব্যবসা সম্প্রসারণ করে প্রভিটা।
প্রথমে খাতুনগঞ্জের রওশন মঞ্জিল থেকে ব্যবসা পরিচালিত হলেও ২০১৫-১৬ সালের দিকে গ্রুপটি কার্যালয় ঢাকায় নিয়ে আসেন নুরুন্নবী ভূঁইয়া।
নোয়াখালীর সুবর্ণচর, চৌমুহনী, চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড, কক্সবাজারের চকরিয়া, ময়মনসিংহ-সহ দেশের বিভিন্ন স্থানে গ্রুপটির পোল্টি খাতের বিলাসী প্রকল্প রয়েছে বলে জানিয়েছেন বিনিয়োগকারী ব্যাংকের কর্মকর্তারা।
সার্বিক বিষয়ে জানতে প্রভিটা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নুরুন্নবী ভূঁইয়ার মুঠোফোন ও হোয়াটস অ্যাপে যোগাযোগ করেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।