দেশের বৃহত্তম রুফটপ সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করছে ইয়াংওয়ান
কোরিয়ার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ইয়াংওয়ানের মালিকানাধীন চট্টগ্রামের কোরিয়ান রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চলে (কেইপিজেড) ৪০ মেগাওয়াট সমন্বিত সক্ষমতাসম্পন্ন দেশের বৃহত্তম ছাদ সৌর বিদ্যুৎ বা রুফটপ সোলার পাওয়ার প্রজেক্ট চালু হতে চলেছে।
কেইপিজেড কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, প্রায় ৪০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয়ে তিন ধাপে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হবে। এছাড়া, এই ইপিজেডের সকল ভবন সৌরশক্তির সুবিধা পাবে।
প্রথম ধাপে, একটি ১৬ মেগাওয়াট সৌর ফটোভোলটাইক (পিভি) বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপিত হয়েছে। ১৬ মিলিয়ন ডলার ব্যয়ে স্থাপিত এই কেন্দ্র আজ বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ উদ্বোধন করবেন। এখন পর্যন্ত, দেশের বৃহত্তম পিভি ব্যবস্থার ছাদ সৌরশক্তির উৎস হবে এই কেন্দ্র।
দ্বিতীয় ধাপে, চলতি বছরের অক্টোবর নাগাদ ৪.৩ মিলিয়ন ডলায় ব্যয়ে ৪.৩ মেগাওয়াট সৌর প্যানেল স্থাপনের সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে।
তৃতীয় ধাপে, ২০ মেগাওয়াটের অপর একটি কেন্দ্র ইনডিপেন্ডেন্ট পাওয়ার প্ল্যান্ট (আইপিপি) হিসেবে স্থাপনের পরিকল্পনা করা হয়েছে। ১২ মাস মেয়াদী এই প্রকল্প সরকারি অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে বলে জানিয়েছেন কেইপিজেড করপোরেশনের কর্মকর্তারা।
পাওয়ার প্ল্যান্টটি জাতীয় গ্রিডের সাথে সংযুক্ত থাকবে এবং নেট মিটারিং সিস্টেমের অধীনে গ্রিডে অতিরিক্ত বিদ্যুৎ সরবরাহের উপযুক্ত হবে।
বাংলাদেশ রপ্তানী প্রক্রিয়াকরণ কর্তৃপক্ষের (বেপজা) মহাব্যবস্থাপক নাজমা বিনতে আলমগীর দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "অন্য কোনো ইপিজেডে ১৬ মেগাওয়াটের মতো উচ্চ সক্ষমতাসম্পন্ন সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থা নেই। ইপিজেডগুলোতে আমাদের কিছু সড়ক বাতি রয়েছে। তা সত্ত্বেও, জাতীয় গ্রিডের ওপর নির্ভরতা কমাতে আমরা শিল্প-কারখানাগুলোকে স্বতন্ত্র সৌর বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের জন্য উৎসাহিত করছি।"
টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (স্রেডা) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলাউদ্দিন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "বাংলাদেশের অধিকাংশ ছাদ সৌর বিদ্যুৎ কেন্দ্র মেগাওয়াট সক্ষমতার নিচে। হবিগঞ্জ জেলায় একটি কারখানার ছাদে এক মেগাওয়াটের একটি সোলার প্ল্যান্ট আছে। কেইপিজেডের ছাদের প্ল্যান্টটি দেশের মধ্যে বৃহত্তম।"
বাংলাদেশ বেসরকারি ইপিজেড আইনের অধীনে ১৯৯৬ সালে প্রথম প্রতিষ্ঠান হিসেবে দক্ষিণ কোরিয়ার ইয়াংওয়ান করপোরেশন দেশে বেসরকারি রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চল স্থাপন করে। অঞ্চলটির প্রচার, উন্নয়ন এবং ব্যবস্থাপনার স্বার্থে "কোরিয়ান ইপিজেড করপোরেশন (বিডি) লিমিটেড" নামের একটি প্রতিষ্ঠান গঠিত হয়।
কেইপিজেডে বর্তমানে ৩৪টি বিশ্বমানের কারখানায় ফুটওয়্যার, পোশাক শিল্প এবং টেক্সটাইল পণ্য উৎপাদিত হচ্ছে। এখন পর্যন্ত এখানে প্রায় ২৬ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে।
বর্তমানে, অঞ্চলটি বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি) থেকে সরবরাহকৃত ১৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ব্যবহার করছে। ক্রমবর্ধমান শিল্প-কারখানার জন্য অঞ্চলটি বিপিডিবি থেকে আরও ১৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ব্যবহারের অনুমোদন পেয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে, ছাদ সৌর বিদ্যুৎ থেকে উৎপাদিত শক্তির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করতে, ইয়াংওয়ান করপোরেশন (বিডি) অতিরিক্ত বিদ্যুৎ ব্যাক-টু-ব্যাক ব্যবস্থার অধীনে জাতীয় গ্রিডে সরবরাহের জন্য বিপিডিবির সাথে চুক্তি স্বাক্ষর করেছে।
প্রকল্পটি সম্পর্কে কথা বলতে গিয়ে কেইপিজেড করপোরেশন (বিডি) লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কর্নেল (অব.) মোহাম্মদ শাহজাহান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "সকল প্যানেল কোরিয়া থেকে আমদানিকৃত উচ্চ মানসম্পন্ন হওয়ায় আমাদের কেন্দ্রটি অন্যতম সেরা একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র।"
"প্রথম ধাপের কাজ শেষ করতে প্রায় আট মাস সময় লেগেছে। কেপিজেড কেবলমাত্র টেকসই পদ্ধতিতে এর বাড়তে থাকা বিদ্যুৎ শক্তির চাহিদাই পূরণ করবে না, বরং জাতীয় গ্রিডে অতিরিক্ত নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ শক্তি সরবরাহের মাধ্যমে সামাজিক দায়বদ্ধতাও প্রদর্শন করবে," বলেন তিনি।
চট্টগ্রামের পটিয়ায় বিপিডিবির নির্বাহী প্রকৌশলী ইসমাইল হোসেন বলেন, পরিবেশবান্ধব জ্বালানি খাতে কোনো ইপিজেডের প্রবেশের সংবাদ প্রশংসনীয়।
ইপিজেডের উদ্বৃত্ত সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহারের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, "কেইপিজেডের অতিরিক্ত বিদ্যুৎ আমাদের গ্রিডে যুক্ত হবে এবং আমরা তাদের সাথে হিসাব মিলিয়ে নেব।"
"যেহেতু তারা ১৬ মেগাওয়াট প্ল্যান্ট স্থাপন করেছে, তাই আমাদের কাছ থেকে বেশি বিদ্যুতের প্রয়োজন পড়বে না। এই বাড়তি বিদ্যুৎ থেকে প্রয়োজন অনুযায়ী আমরা ১২ হাজার থেকে ১৩ হাজার পরিবারে নতুন সংযোগ দিতে পারব," বলেন তিনি।
বাংলাদেশের শক্তি নীতিমালা অনুযায়ী, ২০২০ সালের মধ্যে ১০ শতাংশ পর্যন্ত নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের লক্ষ্যমাত্রার পাশাপাশি সরকার ২০২১ সালের মধ্যে দুই হাজার ৪০০ মেগাওয়াট এবং ২০৩০ সালের মধ্যে চার হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা অর্জনের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন বলেন, "বাংলাদেশের শক্তি নীতিমালা অনুযায়ী, ২০২০ সালের মধ্যে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের মাত্রা ১০ শতাংশে পৌঁছানোর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হলেও আমরা মাত্র ৩.৫ শতাংশ পর্যন্ত লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সফল হয়েছি। আমরা এ বিষয়ে কাজ করছি। সরকার নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের মাত্রা বাড়াতে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করছে।"
অনুর্বর ভূমি থেকে পরিবেশ-বান্ধব ইপিজেড
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অঞ্চলসমূহের পরিবেশ সম্পর্কে অনেকেই অবগত আছেন।
আমরা যখন দেশে শিল্পকারখানার জন্য বরাদ্দকৃত কোনো অর্থনৈতিক অঞ্চলের কথা চিন্তা করি, তখন বিশাল সব ভবন, ভারী শিল্পকারখানা এবং ঘন স্থাপনাপূর্ণ জায়গার কথা মাথায় আসে।
তবে, কোরিয়ান ইপিজেড এই বদ্ধমূল ধারণার পরিবর্তনে সাহায্য করবে। তবে, তা শিল্প-কারখানাগুলোর জন্য নয়, বরং চারপাশে ঘেরা সবুজ অঞ্চল, জীববৈচিত্র্য এবং কৃত্রিম জলাধারগুলোর জন্য।
চট্টগ্রামের আনোয়ারা এবং কর্ণফুলী উপজেলায় দুই হাজার ৪৯২ একর জমির ওপর অবস্থিত দেশের প্রথম বেসরকারি রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চল কেইপিজেড।
অঞ্চলটি একসময় পাহাড়ি অনুর্বর জায়গা ছিল। কিন্তু, বর্তমানে তা সবুজ শিল্পাঞ্চলে পরিণত হয়েছে। মোট অঞ্চলের ৫২ শতাংশ স্থান ৪০০ প্রজাতির প্রায় ২৪ লাখ গাছপালায় ছেয়ে আছে।
২০০৯ সালের ২৩ নভেম্বর মোট ভূমির ৫২ শতাংশ (এক হাজার ২৯৫ একর) সবুজায়নের জন্য বরাদ্দ রেখে ৪৮ শতাংশ (এক হাজার ১৯৬ একর) শিল্প-কারখানা ও অন্যান্য অবকাঠামোর জন্য ব্যবহারের শর্তে পরিবেশ অধিদপ্তর ইপিজেড কর্তৃপক্ষকে পরিবেশগত ছাড়পত্র প্রদান করে।
এক হাজার ১৯৬ একর ভূমির মধ্যে ৩৫৯ একর (৩০ শতাংশ) ভূমি রাস্তাঘাট এবং অন্যান্য আনুষাঙ্গিক স্থাপনার জন্য রাখা হয়েছে। বাকি ৮৩৭ একর ভূমি কারখানার জন্য বরাদ্দ আছে।
কেইপিজেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ শাহজাহান বলেন, "যাত্রা শুরুর পর থেকে আমরা এই অঞ্চলকে পরিবেশ-বান্ধব হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করছি। প্রকল্পের মূল বৈশিষ্ট্যসমূহ হল- নীল ও সবুজ উদ্যোগের অধীনে সবুজায়ন এবং জলাধার স্থাপন, সবুজ শিল্প-কারখানা এবং পরিবেশ-বান্ধব জ্বালানি শক্তি।"
"আমরা সকল ভবনকে পরিবেশন-বান্ধব সবুজ ভবনে পরিণত করেছি। ২৪ লাখ বৃক্ষ রোপন করেছি। এছাড়া, দেশের বেসরকারি খাতের একক বৃহত্তম জলাধার প্রকল্প হিসেবে আমরা ৫০০ মিলিয়ন গ্যালন জল ধারণকারী ২৫টি জলাধার নির্মাণ করেছি। বর্তমানে, আমরা ৪০ মেগাওয়াট সৌরশক্তি উৎপাদন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছি। সব মিলিয়ে এই ইপিজেডটি কেবল দেশের মধ্যেই নয়, বরং এই অঞ্চলেও প্রকৃত পরিবেশবান্ধব রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চলে পরিণত হয়েছে।"
স্থানীয়রাও সবুজায়নের জন্য ইপিজেড কর্তৃপক্ষের প্রশংসা করে থাকেন।
স্থানীয় বাসিন্দা মোহাম্মদ এরশাদ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, বর্তমানে প্রতিদিন বহু মানুষ জায়গাটি দেখতে আসেন।
কর্মসংস্থান এবং বিনিয়োগ
২০১১ সালের ২ অক্টোবর কর্ণফুলী শুজ ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড প্রথম কারখানা হিসেবে কোরিয়ান ইপিজেডে উৎপাদন শুরু করে।
এখন পর্যন্ত, কেইপিজেড মোট ৬৫ লাখ বর্গফুট বিশিষ্ট ৪০টি অত্যাধুনিক সবুজ কারখানা নির্মাণ শেষ করেছে।
অঞ্চলটির অবকাঠামোগত উন্নয়নে ইয়াংওয়ান করপোরেশন এখন পর্যন্ত ৩০০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে। ইপিজেডটি প্রায় এক বিলিয়ন ডলারের সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ (এফডিআই) অর্জনে সক্ষম হবে বলে আশাবাদী কোরিয়ান এই প্রতিষ্ঠান।
কেইপিজেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ শাহজাহান বলেন, "ইপিজেডটি পুরোপুরি বাস্তবায়িত হলে, এখানে সরাসরি প্রায় এক লাখ মানুষ কর্মসংস্থানের সুযোগ পাবে।"
স্থানীয় প্রায় ৯৫ শতাংশ মানুষ বর্তমানে ইপিজেডে কাজ করেন বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
মোহাম্মদ এরশাদ বলেন, "ইপিজেডটি স্থানীয়দের জীবনে পরিবর্তন এনেছে। বহু মানুষ, বিশেষত নারীরা এখানে কাজ করছেন। ফলে, তাদের পরিবারও আর্থিক সচ্ছলতা লাভ করছে।"
দেশের দ্বিতীয় বেসরকারি হাই-টেক পার্কটিও কেইপিজেডে নির্মাণাধীন। ইয়াংওয়ান করপোরেশন সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে "টেকভিশন (বিডি) লিমিটেডে" ২০০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে।
প্রতিষ্ঠানটি শিল্প কারখানায় ডিজিটালাইজেশন, ডেটা অন্তর্ভুক্তীকরণ এবং আউটসোর্সিংয়ের লক্ষ্যে সকল ধরনের সফটওয়্যার নির্মাণ করবে। অন্যান্য ভবনেও মধ্যে, ৪১ তলা বিশিষ্ট একটি বহুতল ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা আছে। ২০৪১ সালে উন্নত দেশের পর্যায়ে বাংলাদেশের উত্তরণ স্মরণীয় রাখতে ভবনটি নির্মিত হবে বলে জানায় কেইপিজেড কর্তৃপক্ষ।
দুই দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রেখে, বর্তমানে বাংলাদেশে ২০০টি কোরিয়ান প্রতিষ্ঠান কার্যক্রম পরিচালনা করছে। কোরিয়ার সাথে বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যিক সম্পর্ক প্রায় ১.৬ বিলিয়ন ডলারে গিয়ে পৌঁছেছে।