নোয়াখালীতে বন্ধ ১,৩০০ পোলট্রি খামার, প্রতিমাসে ক্ষতি ২০ কোটি টাকা
পোলট্রি খামার ব্যবসায়ী আল মামুন (৩৫) ২০১৫ সালে নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার চরএলাহি ইউনিয়নের গাংচিলে প্রথমে ৩২ হাজার মুরগি নিয়ে পোলট্রি খামার ব্যবসা চালু করেন। পরবর্তীতে ব্যবসায় সফলতা আসলে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে সুদে ঋণ নিয়ে একে একে ৯টি খামার গড়ে তুলেন তিনি। ব্রয়লার, লেয়ার, সোনালী- এ তিন প্রজাতির প্রায় ৫৫ হাজার মুরগি ছিল তার খামারগুলোতে। ২০১৯ সাল থেকে তার খামারগুলোতে রোগের আক্রমণ শুরু হয়। রাণীক্ষেত, গামবোরা, ককসিডিওসিস, পুলোরাম, ঠান্ডাজনিত ও বার্ডফ্লুসহ বিভিন্ন রোগে মরতে থাকে খামারের মুরগি। বর্তমানে তার ৮টি খামারই বন্ধ হয়ে গেছে। একই অবস্থা জেলার অনেক খামারির।
জেলা পোলট্রি খামার এসোসিয়েশনের তথ্যমতে, গত কয়েক মাসে বন্ধ হয়ে গেছে অন্তত ১৩শ মুরগির খামার। আর তাতে প্রতিমাসে প্রায় ২০ কোটি টাকার মুরগি ও ডিম উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের বেশির ভাগই ব্যাংক ঋণে জর্জরিত হয়ে পড়ছেন। খামারগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ায় খামারের মালিকরা যেমন আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তেমনি কর্মচারীদের কাজ না থাকায় জেলায় বেকারত্বের হারও বাড়ছে।
খামারিদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, পোলট্রি খামার দেশের একটি পরিচিত নাম। দেশের মাংসের চাহিদার প্রায় ৮০ ভাগই আসে পোলট্রি খামারে উৎপাদিত মুরগি থেকে। গরীবের আমিষের যোগান হিসেবে পরিচিত বিভিন্ন প্রজাতির পোলট্রি মুরগি। কম দামে পাওয়ায় দেশের প্রতিটি এলাকায় ব্যাপক জনপ্রিয় এ মুরগি। এ মুরগির বিভিন্ন জাত রয়েছে। তার মধ্যে ব্রয়লারসহ কিছু মুরগি মাংস ও লেয়ার জাতের মুরগি ডিম উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত। আবার সোনালী প্রজাতি মাংস ও ডিম দুটোই উৎপাদনের জন্য জনপ্রিয়। ৭ থেকে ৮ সপ্তাহের মধ্যে একটি ব্রয়লার মুরগির ওজন দুই থেকে আড়াই কেজি হয়ে থাকে। এরপর তা বাজারজাত করা যায়। পাঁচ থেকে ছয় মাসের মধ্যে ডিম দেয় লেয়ার মুরগি। একবারে তারা ২৫০ থেকে ৩০০টি ডিম দিয়ে থাকে। মুরগির জাত হিসেবে ডিমের রং লাল ও সাদা হয়।
জেলা পোলট্রি খামার এসোসিয়েশনের তথ্যমতে, ২০২০ সালের শেষের দিকে জেলার ৯টি উপজেলায় প্রায় ৬ হাজার পোলট্রি খামার ব্যবসায়ী ছিল। খামারগুলোতে মুরগির মাংসের পাশাপাশি ডিমও উৎপাদিত হয়ে থাকে। উৎপাদিত মুরগি ও ডিম জেলার মানুষের চাহিদা মিটিয়ে পাশ্ববর্তী চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলার বিভিন্ন স্থানে বিক্রি করা হয়। খামারগুলো থেকে প্রতিমাসে ৬০০ টন মুরগি ও ১ কোটি পিস ডিম উৎপাদন করা হয়। কিন্তু বিভিন্ন সময় রাণীক্ষেত, গামবোরা, ককসিডিওসিস, পুলোরাম, ঠান্ডাজনিত ও বার্ডফ্লুসহ বিভিন্ন রোগে খামারগুলোর লাখ লাখ মুরগি মারা গেছে। আর তাতে নিজেদের পুঁজি হারিয়ে গত ৫-৬ মাসে বন্ধ হয়ে গেছে জেলার অন্তত ১,৩০০টি খামার। মুরগির খাদ্য, ওষুধ ক্রয়ের একটি অংশ সরকারি রাজস্বে যোগ হয়ে থাকে। কিন্তু বর্তমানে খামারগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ায় লাখ লাখ টাকা রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার।
সংগঠনটি আরও জানায়, ২০১৯ সালে প্রতিটি মুরগির বাচ্চা ক্রয়ে খরচ হতো ৪০-৫০ টাকা, মুরগির খাদ্য প্রতি ৫০ কেজির ফিডের বস্তার মূল্য ছিল ২০৫০ টাকা। দুই বছরের ব্যবধানে বর্তমানে প্রতিটি বাচ্চার মূল্য ৬০ থেকে ৬৫ টাকা, আর খাদ্যপ্রতি বস্তা ২৪৫০ টাকা। খামারে প্রতি হাজার ব্রয়লার মুরগি উৎপাদনে খরচ হয় দুই লাখ টাকা। যার মধ্যে ওষুধ বাবদ ২০ হাজার ও খাদ্য বাবদ ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা খরচ হয়।
গাংচিল গ্রামের ক্ষতিগ্রস্ত খামারি আল মামুন বলেন, গত ২০১৯ সালের জুনে রাণীক্ষেত রোগে তার ৯টি খামারের ১ কোটি ১৭ লাখ টাকা মূল্যের ১৮ হাজার ব্রয়লার মুরগি মারা যায়। দ্বিতীয় ধাপে ২০২০ সালে জানুয়ারিতে বার্ডফ্লু রোগে মারা যায় ৩৭ হাজার মুরগি। যার বাজারমূল্য ছিল ২ কোটি ৪ লাখ টাকা। নিরূপায় হয়ে ওই বছরের ডিসেম্বরে খামারগুলো বন্ধ করে দেন তিনি। বর্তমানে তিনি বিভিন্ন ব্যাংকের সাড়ে ৩ কোটি টাকার ঋণে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। এতকিছুর পরও সরকার ঘোষিত কোন প্রণোদনা পান নি বলে অভিযোগ করেন মামুন।
কোম্পানীগঞ্জের চরযাত্রা গ্রামের খামারি জাহাঙ্গীর আলম জানান, তার দু'টা খামারে তিনটি ঘরে প্রায় তিন হাজার মুরগি ছিল। কিন্তু মুরগির বাচ্চা, ওষুধ, খাদ্যের মূল্য বৃদ্ধি, যাতায়াত ব্যবস্থা ও খামার পরিচালনায় খরচ বেড়ে যাওয়ায় গত তিন মাস আগে খামার দুটি বন্ধ করে দিয়েছেন। বর্তমানে তিনি এবং তার খামারের ৪ জন কর্মচারী বেকার হয়ে গেছেন।
চরএলাহী ইউনিয়নের খামারি আরিফুল ইসলাম বলেন, পোলট্রি শিল্পের বর্তমানে বেহাল অবস্থা। দেশের পরিস্থিতি, বাজারে ওষুধ ও খাদ্যমূল্যের উর্ধ্বগতির কারণে আমার তিনটি খামার দীর্ঘদিন থেকে বন্ধ হয়ে আছে। বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়ায় বর্তমানে নতুন করে শুরু করার সাহসও পাচ্ছিনা।
জেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, জেলার ৯টি উপজেলায় ব্রয়লার ১৫২১টি, লেয়ার ১৬৯টি, সোনালী/ফাউমি ১৪৭টি ও টার্কি মুরগির ১০৭টিসহ মোট ১৯৪৪টি মুরগি উৎপাদন খামার রয়েছে। যার মধ্যে ব্রয়লারের ৩৪৩টি ও লেয়ারের ৬০টি খামারের নিবন্ধন রয়েছে। তবে এর বাইরে জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে ব্যক্তিগত উদ্যোগে তৈরি আরও মুরগি খামার আছে। জেলায় মাংসের চাহিদা রয়েছে ৩ দশমিক ৮৪ লাখ মেট্রিক টন আর উৎপাদন হচ্ছে ৩ দশমিক ৮৯ মেট্রিক টন। ডিমের চাহিদা রয়েছে ৩৩ দশমিক ৯০ কোটি কিন্তু তার বিপরীতে উৎপাদন হচ্ছে ২৯ দশমিক ৭৩ কোটি। চাহিদা ও উৎপাদনে মাংসের দিক থেকে এগিয়ে থাকলেও খামারগুলোতে ডিম উৎপাদন কম হচ্ছে। বিভিন্ন সমস্যার কারণে কিছু মুরগির খামার প্রতিনিয়ত বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এদের মধ্যে কেউ কেউ নতুন করে শুরু করেছেন।
জেলা পোলট্রি খামার এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার বেলায়েত হোসেন জানান, জেলার বর্তমান পোলট্রি খামারিরা একটা সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি হয়ে আছে। এ সিন্ডিকেট কোন প্রকার পূর্বঘোষণা ছাড়াই মুরগির বাচ্চা, খাদ্য ও ওষুধের মূল্য বাড়িয়ে দেয়। সরকারি কোন সংস্থার নিয়ন্ত্রণ না থাকায় তারা নিজেদের মত করে কয়েক মাস পরপর এসব করে যাচ্ছে। গত কয়েক বছরে মুরগি খামারিরা বিভিন্নভাবে ক্ষতির মুখে পড়লেও বেশিরভাগই সরকারি প্রণোদনা ও স্বল্প সুদে ব্যাংকগুলো থেকে ঋণ পাননি। বর্তমানে করোনা পরিস্থিতিতে খামারিরা আরও বিপাকে পড়েছেন। ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা করে প্রণোদনা ও সুদ বিহীন ঋণ প্রদান করতে সরকারের কাছে অনুরোধ করেছেন তিনি। প্রণোদনায় ক্ষতিগ্রস্তদের কিছুটা হলেও উপকার হবে।
জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. শহিদুল ইসলাম আকন্দ জানান, করোনাকালীন সময় ও তার আগে বিভিন্ন রোগে মুরগি মারা যাওয়ায় কিছু খামারি তাদের খামারগুলো বন্ধ করে দিয়েছে। এরমধ্যে কেউ কেউ আবার নতুন করে চালুও করছেন। জেলার ক্ষতিগ্রস্থ ৭৭৮ জন খামারি প্রণোদনার জন্য আবেদন করেছিলেন। যার মধ্যে গত মার্চে ৭৩৬ জনকে ১৬ কোটি ১৭ লাখ ১৫ হাজার টাকা সরকারি প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে। এ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত ও তালিকার বাইরে ক্ষতিগ্রস্ত যেসব খামারি রয়েছেন উপজেলা পর্যায়ে তাদের তালিকা তৈরি করে প্রণোদনার ব্যবস্থা করা হবে।
মুরগির বাচ্চা, ওষুধ ও খাদ্যে মূল্য বৃদ্ধির বিষয়টি স্বীকার করে এ কর্মকর্তা বলেন, বাচ্চা, ওষুধ ও খাদ্য বাজার নিয়ন্ত্রণে আমাদের কোন হস্তক্ষেপ নেই। তবে খামারিদের সুবিধার্থে এসবের বাজার একটি নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার মধ্যে রাখার উচিত বলে মনে করেন তিনি।