পিকে হালদারের কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা নিতেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শীর্ষ কর্তারা
কয়েক হাজার কোটি টাকা পাচারের অভিযোগ নিয়ে বিদেশে পালাতক ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেডের (আইএলএফএসএল) সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রশান্ত কুমার (পিকে) হালদার তার জালিয়াতির তথ্য চেপে রাখতে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক একজন ডেপুটি গভর্নর ও সাবেক একজন জিএমকে (বর্তমানে নির্বাহী পরিচালক) নিয়মিত আর্থিক সুবিধা দিতেন। তাদের মাধ্যমেই তিনি সব অপকর্মের তথ্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচ্চ পর্যায়ের নজর এড়াতেন।
হালদারের অন্যতম সহযোগী ও আইএলএফএসএলের আরেক সাবেক এমডি রাশেদুল হক এমন তথ্য জানিয়েছেন। আদালতসূত্র জানিয়েছে, দুদকের রিমান্ড শেষে মঙ্গলবার আদালতে ১৬৪ ধারায় দেওয়া জবানবন্দিতে এসব তথ্য তুলে ধরেন রাশেদুল হক।
ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ে জালিয়াতির ঘটনায় প্রথম পর্যায়ে করা ৫ মামলার এই আসামিকে ২৪ জানুয়ারি গ্রেপ্তার করে দুদক।
রাশেদুল হক মালয়েশিয়া থেকে বিবিএ ডিগ্রি নিয়ে দেশে এসে ২০০০ সালে আইএলএফএসএল-এ প্রবেশনারী অফিসার হিসেবে যোগ দেন। ২০০৬-০৭ সালে আইআইডিএফসিতে এভিপি হিসাবে প্রশান্ত কুমার হালদারের অধীনে চাকরি করেন তিনি। তখন থেকেই হালদারের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা। ২০১১-১২ সালে তিনি রিলায়েন্স ফিন্যান্সে এসভিপি হিসাবে যোগ দেন। ওই সময় রিলায়েন্সের এমডি ছিলেন পিকে হালদার।
দুদকের অনুসন্ধান বলছে, পিকে হালদারের আর্থিক জালিয়াতির শুরু রিলায়েন্স থেকেই। আদালতে দেওয়া জবাবনবন্দিতে রাশেদুল বলেছেন, হালদার নিজের ইচ্ছামতো গ্রাহকদের ট্রেড লাইসেন্স নিয়ে একদিনের মধ্যে কোনো যাচাই-বাছাই ছাড়াই ঋণ অনুমোদন ও বিতরণ করতেন। অনেক সময় গ্রাহক জানতেন না, তার নামে ঋণ নেওয়া হয়েছে। এভাবে শত শত কোটি টাকা অনিয়মের মাধ্যমে ঋণ নিয়ে আত্মসাৎ করেন তিনি। রিলায়েন্সের কয়েকজন কর্মকর্তা জালিয়াতির কাজে হালদারকে সহায়তা করতেন। আর বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই ডেপুটি গর্ভনরকে ম্যানেজ করতেন পিকে হালদার।
এসব তথ্য আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে রাশেদুল হক স্বীকার করেছেন বলে আদালত সূত্র নিশ্চিত করেছে।
আদালত সূত্রে আরও জানা গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের তখনকার জিএম ও বর্তমানে নিবার্হী পরিচালককে রিলায়েন্স থেকে প্রতি মাসে দুই লাখ টাকা করে মাসোহারা দেওয়া হতো। ওই টাকা নগদ তুলে নিয়ে সান্ড্রি হিসাবে, বিবিধ খরচ হিসাবে দেখানো হতো, যেন ঘুষের কোনো প্রমাণ না থাকে। এ তথ্যও জানিয়েছেন রাশেদুল।
রাশেদুল আরও জানান, পিকে হালদার এনআরবি গ্লোবালের এমডি হিসাবে চলে গেলে তিনি রাশেদুল হককে ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের এমডি হওয়ার অনুরোধ করেন। পিকে হালদারের কথামতো রাশেদুল হক ২০১৫ সালের জুন মাসে ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের এমডি হলেও প্রতিষ্ঠান চালাতেন মূলত পিকে হালদারই। হালদার নিজের কর্তৃত্ব বজায় রাখতে রিলায়েন্স লিজিংয়ে থাকা তার কয়েক অনুসারীকে ইন্টান্যাশনাল লিজিংয়ে নিয়ে আসেন। তারাই মূলত পিকে হালদারের সঙ্গে সরাসরি লেনদেন করতেন।
রাশেদুল জানান, আইএলএফএসএলের বেশির ভাগ গ্রাহকই ছিলেন পিকে হালদারের আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু বান্ধব। তারা ঋণের প্রস্তাব দিলে সহযোগীদের মাধ্যমে এমডি রাশেদুলের কাছে পাঠাতেন। তিনি শুধু সেগুলোতে স্বাক্ষর করে দিলে কোনো রকম যাচাই বাছাই ছাড়াই, কোনো মর্টগেজ না নিয়ে পিকে হালদারের নির্দেশমতো ঋণ প্রস্তাব তৈরি করে বোর্ডে উপস্থাপন করতেন। প্রতিটি বোর্ড মিটিংয়ে পিকে হালদার উপস্থিত থেকে ঋণ প্রস্তাব অনুমোদনে বাধ্য করতেন।
রাশেদুল আদালতের কাছে আরও স্বীকার করেন, বোর্ড সদস্যরা সবাই ছিলেন পিকে হালদারের লোক। তাই তারা ভূয়া-অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠান জেনেও ঋণ অনুমোদন করে দিতেন।
রাশেদুলের তথ্যমতে, নওশের উল ইসলাম, মমতাজ বেগম, পাপিয়া ব্যানার্জী, বাসুদেব ব্যানার্জী ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের পরিচালক হওয়া সত্ত্বেও বেআইনিভাবে তাদের ভূয়া প্রতিষ্ঠান এমএসটি মেরিন, এমএসটি ফার্মা, নিউট্রিক্যাল, জিএন্ডজি এন্টারপ্রাইজের নামে ঋণ নিয়ে তা জমা না দিয়ে পিকে হালদারসহ নিজের অন্য প্রতিষ্ঠান/ব্যক্তির হিসাবে স্থানান্তর করে তা উত্তোলন করেন এবং পরে তা বিদেশে পাচার করেছেন।
রাশেদুল হক আরও স্বীকার করেছেন, তাদের সহকর্মীদের সহায়তায় আনাম কেমিক্যাল, রহমান কেমিক্যাল, নর্দান জুটসহ বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানের বাস্তব অস্তিত্ব, কাঠামো ও ঋণ নেওয়ার উদ্দেশ্য যাচাই ছাড়াই, কোনো মর্টগেজ ছাড়াই ঋণ দিয়েছেন, যা পরে পিকে হালদারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে স্থানান্তর হয়েছে।
আদালত সূত্র জানায়, রাশেদুল আদালতের কাছে আরও স্বীকার করেছেন, মার্কেন্টাইল ব্যাংকের পরিচালক ও রেজা গ্রুপের চেয়ারম্যান শহিদ রেজা মূলত ছিলেন পিকে হালদারের প্রধান সহযোগী। পিকে হালদারের নির্দেশে তার বিভিন্ন কাগুজে প্রতিষ্ঠানে ২০০ কোটি ঋণ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া, সিমটেক্সের মালিক সিদ্দিকুর রহমান, ব্যাংক এশিয়ার সাবেক এমডি ইরফান উদ্দিন আহমেদ, পিপলস লিজিংয়ের চেয়ারম্যান উজ্জ্বল কুমার নন্দী, রাজীম সোম, কাজী মমরেজ মাহমুদ, স্বপন কুমার বিশ্বাস, অভিজিত অধিকারী, অমিতাভ অধিকারী, শংখ ব্যাপারী, সুস্মিতা সাহা, গোপাল চন্দ্র গাঙ্গুলী, অতশী মৃধা, অমল চন্দ্র দাস, রতন কুমার বিশ্বাস ছিলেন পিকে হালদারের সহযোগী। পিকে হালদার মূলত এদের এনআইডি কার্ড দিয়ে ভূয়া কোম্পানি বানিয়ে তা দিয়ে শত শত কোটি টাকা লিজিং থেকে লুট করেছেন।
আদালত সূত্র আরও জানায়, আদালতের কাছে মোঃ রাশেদুল হক স্বীকার করেছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের ইন্সপেকশন বিভাগ থেকে বছরে দুবার অডিট হতো এবং ২০১৫ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত দুই সদস্য বিশিষ্ট অডিট টিমকে প্রতিবারই ১০ লাখ টাকা করে দেওয়া হয়েছে। এ কারণে তারা ইতিবাচক প্রতিবেদন দিয়েছিল। পিকে হালদার বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রভাবশালী কর্মকর্তা সাবেক ওই ডেপুটি গভর্নর ও জিএমকে উপহার দেওয়ার নামে নিয়মিত মর্মে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং থেকে মোটা অংকের টাকা নিতেন।
অমিতাভ অধিকারী পিকে হালদারের আপন খালাতো ভাই এবং উজ্জ্বল কুমার নন্দী পিকে হালদারের পুরনো অফিসের সহকর্মী। উজ্জ্বল কুমার নন্দী পিপলস লিজিংয়ের চেয়ারম্যান হিসেবে এবং অমিতাভ অধিকারী একই প্রতিষ্ঠানের পরিচালক হিসেবে ২০১৫ সাল থেকে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন। তারা বেনামি প্রতিষ্ঠান দিয়ে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং থেকে টাকা বের করে সেই টাকায় পিপলস লিজিংয়ের চেয়ারম্যান ও পরিচালক হন। পরবর্তীকালে একই কায়দায় পিপলস লিজিং থেকে টাকা বের করে প্রতিষ্ঠানটিকে পথে বসিয়েছেন তারা।
রাশেদুল আরও বলেন, জেনিথ ও লিপরো ইন্টারন্যাশনাল নামের কাগুজে প্রতিষ্ঠানকে পিকে হালদারের নির্দেশে কোনো মর্টগেজ ও যাচাই ছাড়াই, বোর্ডের অনুমোদন ছাড়াই একক কর্তৃত্বে ১২৫ কোটি টাকা দিয়ে দেন। রিলায়েন্স লিজিংকে তিনটি চেকের মাধ্যমে বোর্ডের অনুমোদন ছাড়াই ভাউচারের মাধ্যমে ৮০ কোটি টাকা দিয়েছেন রিলায়েন্স থেকে আসা হালদারের সহযোগীরা।
দুদকের অনুসন্ধানের তথ্যমতে, ট্রেজারি বিভাগের কোনো ঋণ অনুমোদন ছাড়াই শর্টটাম ঋণের নামে রাশেদুল হক পিপলস লিজিংকে ২০০ কোটি টাকা দিয়েছেন। ওই সময় পিপলস লিজিংয়ের এমডি ছিলেন উজ্জ্বল কুমার নন্দী। পরে তা ভূয়া প্রতিষ্ঠানের নামে উত্তোলন দেখিয়ে আত্মসাৎ করেন।
উপ-পরিচালক গুলশান আনোয়ার প্রধানের নেতৃত্বে দুদকের একটি দল দীর্ঘদিন ধরে পিকে হালদারের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান করছে। গত ২৫ জানুয়ারি দলটি ৩১ জনকে আসামি করে মামলা করে। গ্রেপ্তার হওয়া রাশেদুল সব মামলারই আসামি। এই দল শিগগিরই আরও মামলা করবে বলে দুদক সূত্র জানিয়েছে।
প্রায় ২৭৫ কোটি টাকা অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে গত বছরের ৮ জানুয়ারি পিকে হালদারের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। ওই মামলারও তদন্ত চলমান। তদন্তের অংশ হিসেবে এরই মধ্যে পিকে হালদারের মামাতো ভাই শঙ্খ ব্যাপারি, ঘনিষ্ঠ সহযোগী অনিন্দিতা বড়াল, কর আইনজীবী সুকুমার মৃধা ও তার মেয়ে অনিন্দিতা মৃধাকে গ্রেপ্তার করেন দুদকের উপ-পরিচালক মো. সালাহউদ্দিন।