বাংলাদেশের অর্থনীতি আবার উচ্চ প্রবৃদ্ধির দিকে যাওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছে বিশ্বব্যাংক
করোনার ধাক্কা বেশ ভালোভাবেই লেগেছে বাংলাদেশে। তবে সেই ধাক্কা কাটিয়ে দেশের অর্থনীতি আবার উচ্চ প্রবৃদ্ধির দিকে যাবে বলে ইঙ্গিত দিয়েছে বিশ্বব্যাংক।
চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) ৬ দশমিক ৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হতে পারে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে সংস্থাটি। আর জিডিপি প্রবৃদ্ধি আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরে আরও বেড়ে ৬ দশমিক ৯ শতাংশ হতে পারে।
এর আগে, গত জুনে বিশ্বব্যাংক পূর্বাভাস দিয়েছিল যে চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি হবে ৫ দশমিক ১ শতাংশ।
কিন্তু সম্প্রতি প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের সাউথ এশিয়ান ইকোনমিক ফোকাস প্রতিবেদনে সেই পরিসংখ্যানটি সংশোধন করে ১ দশমিক ৩ শতাংশ পয়েন্ট বাড়ানো হয়েছে।
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রপ্তানি পুনরুদ্ধার ও খরচ বাড়তে থাকার কারণে ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৪ শতাংশ হবে। চলতি অর্থবছরে সরকারের প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে ৭ দশমিক ২ শতাংশ।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার ধীরে ধীরে বেগবান হবে বলে আশা করা যাচ্ছে। তবে এই বেগ বৃদ্ধির বিষয়টি নির্ভর করছে টিকা দেওয়ার গতির ওপর। টিকার সরবরাহ বাড়লে এবং মহামারির অর্থনৈতিক ক্ষতিকর প্রভাবগুলো নিয়ন্ত্রণ করা গেলে বাংলাদেশের অর্থনীতির পুনরুদ্ধার গতি পাবে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, সরকারের কোভিড-১৯ প্রণোদনা কর্মসূচিগুলোর কল্যাণে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কাজ শুরুর মূলধন এবং কর্মচারীদের ধরে রাখার জন্য কম সুদে ঋণ পেয়েছে। যদিও ছোট প্রতিষ্ঠান ও অনানুষ্ঠানিক খাতে ঋণ দেওয়ার পরিমাণ কম ছিল।
তবে বিশ্বব্যাংক কিছু কাঠামোগত দুর্বলতা চিহ্নিত করেছে। এর মধ্যে রয়েছে কম প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা, অত্যন্ত কেন্দ্রীভূত রপ্তানি, আর্থিক খাতের ক্রমবর্ধমান দুর্বলতা, ভারসাম্যহীন নগরায়ন এবং ব্যবসার পরিবেশের ধীরগতির উন্নতি। এই দুর্বলতাগুলোকে বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য প্রধান চ্যালেঞ্জ হিসেবে চিহ্নিত করেছে সংস্থাটি।
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, 'জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের জন্যও বাংলাদেশ অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। ২০২৬ সালে জাতিসংঘের স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে প্রত্যাশিত গ্র্যাজুয়েশন (দেশটির সামনে) অনেক সুযোগ খুলে দেবে, কিন্তু উন্নত অর্থনীতির বাজারে অগ্রাধিকারমূলক প্রবেশাধিকার হারানোর ক্ষতিসহ অন্যান্য চ্যালেঞ্জও থাকবে।'
অবকাঠামো মেগা প্রকল্পে অধিক মূলধন ব্যয়ের কারণে বাংলাদেশের আর্থিক ঘাটতি মোট জিডিপির ৫ দশমিক ৫ শতাংশের বেশি বলে অনুমান করা হয়েছে প্রতিবেদনে।
বিশ্বব্যাংক দারিদ্র্যের হারও গত বছরের ১২ দশমিক ৯ শতাংশ থেকে সামান্য কমিয়ে ১২ দশমিক ৫ শতাংশ দেখিয়েছে। আগামী অর্থবছরে দারিদ্র্যের হার আরও কমবে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে প্রতিবেদনে।
বিশ্বব্যাংকের দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের প্রধান অর্থনীতিবিদ হ্যান্স টিমার বুধবার এক ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানে বলেন, 'দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো রপ্তানি পরিষেবা, বিশেষ করে ব্যবসায়িক প্রক্রিয়া এবং পর্যটনে তুলনামূলক সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে। তবে উৎপাদন রপ্তানি বাজারে প্রবেশ করতে তারা সংগ্রাম করেছে।'
তিনি আরও বলেন, 'পরিষেবা-নেতৃত্বাধীন উন্নয়নের সম্ভাবনা উপলব্ধি করার জন্য এই অঞ্চলকে নিয়মনীতিগুলো পুনর্বিবেচনা করতে হবে এবং উদ্ভাবন ও প্রতিযোগিতাকে সহায়তা দেওয়ার জন্য নতুন প্রতিষ্ঠান স্থাপন করতে হবে।'
হ্যান্স টিমার বলেন, বিশ্বব্যাংকের অনেক সদস্য দেশ করোনাভাইরাসের বিস্তাররোধে লকডাউন দিচ্ছে।এসব দেশের আর্থিক খাত খুবই নাজুক অবস্থায় রয়েছে।
তিনি বলেন, অনেক দেশে মুদ্রাস্ফীতি বাড়ার কারণে সাধারণ মানুষ দুর্ভোগে পড়েছে। সরবরাহ চেইন বিঘ্নিত হওয়া এবং বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দাম বৃদ্ধিকে এর প্রধান কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন তিনি।
বিশ্বব্যাংকের দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের ভাইস প্রেসিডেন্ট হার্টভিগ শেফারও হ্যান্সের সঙ্গে একমত পোষণ করেন। তিনি বলেন, 'মহামারি দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনীতিতে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। উন্নতি অনেকাংশেই নির্ভর করবে টিকাদানের গতি, নতুন কোভিড ভেরিয়েন্টের সম্ভাব্য উত্থান এবং বিশ্বব্যাপী প্রবৃদ্ধির গতি ব্যাপকভাবে কমে যাওয়ার ওপর।'
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২১-২২ অর্থবছরে দক্ষিণ এশিয়ার প্রবৃদ্ধি হবে ৭ দশমিক ১ শতাংশ।
তবে এই অঞ্চলের একেক দেশের পুনরুদ্ধার একেক রকম হবে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয় প্রতিবেদনটিতে। আগামী অর্থবছরে দক্ষিণ এশিয়ার অঞ্চলের সামগ্রিক প্রবৃদ্ধি হতে পারে ৫ দশমিক ৪ শতাংশ—যা মহামারিপূর্ব সময়ের চেয়ে ৩ শতাংশ পয়েন্ট কম।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি অর্থবছরে দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম অর্থনীতি ভারতের প্রবৃদ্ধি চলতি ৮ দশমিক ৩ শতাংশ হতে পারে।
কোভিড-১৯ এই অঞ্চলের অর্থনীতিতে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলেছে। পুনরুদ্ধারের বেলায় এই প্রভাবগুলো বড় ভূমিকা রাখতে পারে। অনেক দেশে বিনিয়োগ প্রবাহ কমে গেছে, সরবরাহ চেইন বিঘ্নিত হয়েছে, ঋণের মাত্রা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়ে গেছে। ধারণা করা হচ্ছে, মহামারিতে ২০২১ সালে দক্ষিণ এশিয়ার ৪৮ থেকে ৫৯ মিলিয়ন মানুষ দরিদ্র হয়ে যাবে অথবা দরিদ্র থেকে যাবে।