বাজেটে বরাদ্দকৃত পুরো অর্থ ব্যয়ে ব্যর্থ শিক্ষা মন্ত্রণালয়গুলো
কোভিড-১৯ মহামারির কারণে এক বছরের দীর্ঘ সময় ধরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ থাকায় ২০২০-২১ অর্থবছরে বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দকৃত অর্থের পুরোটা ব্যয় করতে পারেনি শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়।
চলতি অর্থবছরে সরকার দেশের শিক্ষা খাতে ৬৬ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দিলেও মন্ত্রণালয়গুলোর ব্যয়ের পরিমাণ ৫৬ হাজার কোটি টাকা।
কোভিড-১৯ মহামারির কারণে সকল ধরনের দক্ষতা বিকাশ প্রকল্প ও প্রশিক্ষণ বন্ধ আছে বলে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সৈয়দ গোলাম ফারুক।
দেশব্যাপী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় মহামারিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত খাতগুলোর মধ্যে আছে শিক্ষা খাতের নাম।
কিন্তু পাঠদানে ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে এখন পর্যন্ত কোনো সরকারি গবেষণা পরিচালিত হয়নি। লক্ষ্যপূরণে ব্যর্থতার পুনরুদ্ধারেও গৃহীত হয়নি কোনো ব্যবস্থা। বিদ্যালয় থেকে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া ঠেকাতে নেই কোনো পদক্ষেপ।
এমনকি অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মুখে বন্ধ হয়ে পড়া বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকেও কোনো আর্থিক সহায়তা দেয়নি শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এ ধরনের বহু প্রতিষ্ঠানের একাডেমিক কার্যক্রম পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। একইসঙ্গে বহু মানুষ হারিয়েছে কর্মসংস্থান।
সরকার অনলাইন ক্লাস পরিচালনার পেছনে অর্থ ব্যয় করলেও অধিকাংশ শিক্ষার্থী ব্যয়বহুল ইন্টারনেট সংযোগ, টেলিভিশন ও স্মার্টফোন সুবিধা না থাকায় প্রযুক্তিগত প্রতিবন্ধকতার কারণে শ্রেণিকক্ষের বাইরে পাঠদান থেকে বঞ্চিত হন।
২০২০ সালের জুন মাসের পর থেকে আইসিটির মাধ্যমে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার প্রচলনে দ্বিতীয় পর্যায়ের প্রকল্পের অগ্রগতি নেই। অথচ, মহামারির সময় দূরবর্তী পাঠদান প্রক্রিয়ায় দেশে আইসিটি ভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থার চাহিদা ছিল তুঙ্গে।
২০১৬ সালে দেশের ৩১ হাজার ৩৪০টি মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্কুল এবং মাদ্রাসায় মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপনের লক্ষ্যে এক হাজার ৩৫৩ কোটি টাকার অর্থায়নে প্রকল্পটি গৃহীত হয়।
এর মধ্যে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ এবং ডিজিটাল সরঞ্জামাদি কিনতে ৪০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। দেশের পাঁচ লাখ ৭২ হাজার শিক্ষককে ছয় থেকে ১২ দিনের প্রশিক্ষণ প্রদানের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত হয়। তবে এখন পর্যন্ত প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন মাত্র এক লাখ ৫০ হাজার শিক্ষক।
মহামারির কারণে এই প্রকল্পের সঙ্গে অন্যান্য প্রশিক্ষণ এবং দক্ষতা বিকাশ কর্মসূচীও বন্ধ হয়ে যায়।
শিক্ষা বিষয়ক মন্ত্রণালয়গুলো বাজেটে বরাদ্দকৃত অর্থ সুপরিকল্পিতভাবে ব্যবহার করতে পারেনি বলে মন্তব্য করেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল মজিদ। ফলস্বরূপ বহু উন্নয়ন কর্মসূচী বাস্তবায়নে দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন পড়ছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে তিনি বলেন, 'আমার মনে হয় আমাদের শিক্ষা খাতে তহবিল কোনো চিন্তার বিষয় নয়। বরং, বাজেটে বরাদ্দকৃত অর্থ কাজে লাগানোয় আমাদের ভয়াবহ দুর্বলতা আছে। বরাদ্দকৃত অর্থ সঠিকভাবে ব্যবহৃত হলে অনেক কিছু অর্জন করা সম্ভব হবে।'
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক মঞ্জুর আহমেদ বলেন, 'গত বছর আমি শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া কমাতে এবং পাঠদানে ক্ষয়ক্ষতি নিরুপণে জেলা এবং উপজেলা পর্যায়ের প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত কমিটির জন্য বাজেটে বিশেষ বরাদ্দ রাখার প্রস্তাব দিয়েছিলাম। তবে শিক্ষা মন্ত্রণালয় কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি।'
'শিক্ষা মন্ত্রণালয় কদাচিৎ আমাদের পরামর্শ গ্রহণ করে। আমরা মন্ত্রণালয়কে গরিব শিক্ষার্থীদের বৃত্তির পরিমাণ বাড়ানোর আহ্বান জানিয়েছিলাম, যাতে তাদের পরিবার আর্থিক সহায়তা লাভ করে। কিন্তু তারা আমাদের পরামর্শ উপেক্ষা করেছে,' বলেন তিনি।
অধ্যাপক মঞ্জুর আহমেদ আরও বলেন, 'উন্নয়ন বাজেট যথাযথভাবে ব্যবহৃত হওয়া জরুরি। যদি মন্ত্রণালয় তা করতে পারে, অন্তত শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার হার যাচাই করা উচিত। বর্তমানে প্রাথমিক শিক্ষা থেকে প্রায় ১৮ শতাংশ শিক্ষার্থী ঝরে গেছে। মাধ্যমিক পর্যায়ে এই হার ৩৭ শতাংশ।'
পাশাপাশি সকল স্তরে শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত করতে বরাদ্দ বৃদ্ধির প্রয়োজন বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
শিক্ষা খাতের উন্নয়নে বাজেট বরাদ্দের পরিমাণ সামান্য বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে মহামারি থেকে পুনরুদ্ধারের জন্য এই বরাদ্দ যথেষ্ট নয়। ২০২০-২১ অর্থবছরে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ ১১ হাজার ৮৬৫ কোটি টাকার উন্নয়ন বরাদ্দ পায়। আগের অর্থবছরে বরাদ্দকৃত অর্থের পরিমাণ ছিল ৯ হাজার ১৫০ কোটি টাকা।
কারিগরি ও মাদ্রাসা বিভাগ উন্নয়নের জন্য এক হাজার ৯৭৬ কোটি টাকা বরাদ্দ পায়। আগের বছর এই বিভাগের জন্য এক হাজার ৩৫৫ কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় আগের বছর ৯ হাজার ১৬ কোটি টাকা বরাদ্দ পেলেও চলতি বছর বরাদ্দের পরিমাণ ছিল ৯ হাজার ৪০৪ কোটি টাকা।