বে-টার্মিনাল প্রকল্পের অর্থায়নে এগিয়ে এসেছে বিশ্বব্যাংক
কঠিন শর্তের কারণে ভারতীয় ঋণে বে-টার্মিনাল নির্মাণ থেকে সরে আসছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। অন্য দিকে এ প্রকল্পে অর্থায়নে এগিয়ে এসেছে বিশ্বব্যাংক।
তৃতীয় লাইন অব ক্রেডিটের (এলওসি) আওতায় এ প্রকল্পে ৪০০ মিলিয়র ডলার ঋণের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল। ২০১৭ সালের অক্টোবরে ভারতের সঙ্গে তৃতীয় এলওসি চুক্তি সই হয়।
এদিকে বিশ্বব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, বে-কন্টেইনার প্রকল্পের ব্রেক ওয়াটার এবং চ্যানেল ড্রেজিংয়ে ৩৫০ মিলিয়ন ডলার ঋণ দিতে প্রাথমিক সম্মতি জানিয়েছে সংস্থাটি।
তবে সরকার মূল টার্মিনাল নির্মাণসহ এ প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের কাছে আরও বেশি ঋণ চায়। সে লক্ষ্যে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে আলোচনা চলছে বলে জানান চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ এবং নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়।
নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (উন্নয়ন) সুলতান আব্দুল হামিদ বলেন, "বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে আলোচনা চলছে। চূড়ান্ত আলোচনা শেষে জানা যাবে বিশ্বব্যাংক থেকে কি পরিমাণ ঋণ পাওয়া যাবে। তবে উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাটি প্রাথমিকভাবে অর্থায়নে সম্মতি জানিয়েছে"।
তিনটি বে-টার্মিনালের একটি নির্মাণ ও পরিচালনা করবে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। এ টার্মিনাল নির্মাণে উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার অর্থায়নের পাশাপাশি সরকারি তহবিল ও বন্দরের নিজস্ব তহবিলের অর্থ ব্যয় করা হবে। বিশ্বব্যাংকের ধারণা চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের অংশে মোট ব্যয় হবে ১১৫০ মিলিয়ন ডলার।
এদিকে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, ভারতীয় এলওসি ঋণের শর্ত অনুযায়ী ইট, বালি, সিমেন্টসহ নির্মাণ উপকরণ ভারত থেকে আনতে হয়। এছাড়া ভারতীয় পরামর্শক প্রতিষ্ঠান, ঠিকাদারও নিয়োগ দেওয়া বাধ্যতামূলক। ভারতীয় ঋণের প্রকল্প বাস্তবায়ন পর্যায়ে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সম্মতি নিতে হয়। এতে প্রকল্প বাস্তবায়ন বিলম্ব হয়। ভারতীয় অর্থায়নে বাস্তবায়ন হওয়া এবং বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পের অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, এ ধরণের প্রকল্প পুরোপুরি ভারতীয় ঠিকাদারের নিয়ন্ত্রণে থাকে।
কিন্ত বিশ্বব্যাংক বা এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) ঋণের প্রকল্পে এ ধরণের সমস্যা নেই। আন্তর্জাতিক মানের ঠিকাদার নিয়োগ দিয়ে বে-কন্টেইনার টার্মিনাল নির্মাণের লক্ষ্যে ভারতীয় ঋণের পরিবর্তে বিশ্বব্যাংকের ঋণ ব্যবহার অনেক বেশি যুক্তিসংগত হবে। বে-টার্মিনালে ভারতীয় ঋণ ব্যবহার না করার সিদ্ধান্ত ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগকে (ইআরডি) অবহিত করা হয়েছে বলে তিনি জানান।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান টিবিএসকে বলেন, "যে ঋণ বাংলাদেশের পক্ষে বেশি অনুকূল সে ঋণই নেওয়া উচিত। এক্ষেত্রে ঋণের সুদ, গ্রেস পিরিয়ড, ঠিকাদার নিয়োগ পদ্ধতিসহ অন্যান্য শর্ত পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আর এ বিষয়ে ভারতের সঙ্গে যদি আগে আলোচনা হয়ে থাকে, তাদের অবহিত করতে হবে। তাদের কাছে যৌক্তিকতা তুলে ধরতে হবে"।
সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী চট্টগ্রামের হালিশহর সমুদ্র উপকূলে মোট তিনটি বে-টার্মিনাল নির্মাণ করা হবে। এর মধ্যে একটি নির্মাণ ও পরিচালনা করবে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। এছাড়া ব্রেক ওয়াটার, চ্যানেল নির্মাণের কাজ করবে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। রেলপথে কন্টেইনার পরিবহনে রেল স্থাপনার আরো একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে বাংলাদেশ রেলওয়ে। এছাড়াও সড়ক পথে বে-টার্মিনালের জন্যও প্রকল্প নেওয়া হবে।
বাকি দুটি টার্মিনাল হবে সরকারি বেসরকারি অংশীদারিত্বের (পিপিপি) ভিত্তিতে। এ দুটি টার্মিনাল নির্মাণ ও পরিচালনা করবে ডিপি ওয়ার্ল্ড, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং পিএসএ সিঙ্গাপুর।
বে-টার্মিনাল নির্মাণে ইতোমধ্যে ডিপি ওয়ার্ল্ড ও পিএসএ সিঙ্গাপুরের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের পিপিপি কর্তৃপক্ষ সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেছে। এর আগে ভারতের আদানি গ্রুপ, সৌদি আরবের রেড সি গেটওয়ে টার্মিনাল (আরএসজেটি) এবং দক্ষিণ কোরিয়া সরকারের ওশান এন্ড ফিসারিশ মিনিস্ট্রি বে-টার্মিনাল নির্মাণের প্রস্তাব দিয়েছিল। আন্তর্জাতিক পোর্ট পরিচালনায় অভিজ্ঞতা ও বিভিন্ন দেশের প্রস্তাবনা বিশ্লেষণ করে ডিপি ওয়ার্ল্ড ও পিএসএ সিঙ্গাপুরকে প্রাথমিকভাবে মনোনীত করা হয়।
প্রতিটি টার্মিনালে ৩০০ মিটার করে ছয়টি জেটি থাকবে। কমপক্ষে ৫০০০ টিইইউএস ধারণক্ষমতার প্রায় ১২ মিটার ড্রাফট ও ২৮৫ মিটার দৈর্ঘ্যের জাহাজ নোঙর করতে পারবে।
প্রায় ৩৫টি জাহাজ এই টার্মিনালে নোঙ্গর করতে পারবে এবং অতিরিক্ত ৫০ লাখ কন্টেইনার হ্যান্ডেলিং সম্ভব হবে। জাহাজ চলাচলের জন্য জোয়ার-ভাঁটার অপেক্ষা করতে হবে না।
আগামী বছর শুরু করে ২০২৬ সালের মধ্যে বে-টার্মিনাল নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।
২০১৮ সালের ১ নভেম্বর বে-টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্পের উদ্বোধন করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্ত চূড়ান্ত সম্ভাব্যতা সমীক্ষা, অর্থায়নসহ নানা জটিলতায় প্রকল্পের বাস্তবায়ন কাজ এখনও শুরু করা সম্ভব হয়নি। এর আগে ২০১০ সালে বে-টার্মিনাল নির্মাণে প্রাথমিক ব্যয় ধরা হয়েছিল ২.১ বিলিয়ন ডলার। তবে এ ব্যয় আরও বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে।