২০২৫ সাল থেকেই বে টার্মিনাল প্রকল্পের নির্মাণকাজ শুরু করতে চায় সরকার
সরকার আগামী বছর চট্টগ্রাম বন্দরে বে-টার্মিনাল নির্মাণ শুরু করার পরিকল্পনা করছে। গুরুত্বপূর্ণ এ প্রকল্পটি দেশের প্রধান বাণিজ্যিক গেটওয়ের ক্ষমতা ছয়গুণ বাড়াতে সক্ষম হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
এ প্রকল্পের আওতায় সাত কিলোমিটার ন্যাভিগেশনাল এক্সেস চ্যানেল এবং ছয় কিলোমিটার ব্রেকওয়াটার নির্মাণের জন্য প্রথম বিস্তারিত প্রকল্প পরিকল্পনা (ডিপিপি) ২৫ ডিসেম্বরের মধ্যে চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হবে। অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের সভাপতিত্বে গতকাল (১২ ডিসেম্বর) অনুষ্ঠিত বিশেষ বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বৈঠকে জানানো হয়েছে, অন্যান্য ডিপিপি তৈরি সম্পর্কিত কাজও চলমান রয়েছে।
বৈঠকে উপস্থিত সূত্র দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানিয়েছে, এক্সেস চ্যানেল প্রস্তাবটি ২০২৫ সালের জানুয়ারির প্রথমার্ধে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হবে।
ব্রেকওয়াটার হলো এক ধরনের উপকূলীয় কাঠামো যা বন্দরকে ঢেউ এবং ঝড়ের আঘাত থেকে রক্ষা করে। ন্যাভিগেশনাল এক্সেস চ্যানেল হলো জাহাজ বন্দরে নিরাপদে আসা-যাওয়া করার জন্য খনন করা পথ। এ সহায়ক প্রকল্পটি মূল প্রকল্পের অধীনে তিনটি টার্মিনাল নির্মাণের পথ প্রশস্ত করবে।
এ বছরের জুন মাসে বিশ্বব্যাংক এ প্রকল্পে অর্থায়নের জন্য ৬৫০ মিলিয়ন ডলার ঋণ অনুমোদন করেছে। সরকার ঋণ চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য দ্রুত ডিপিপি প্রস্তুত করতে আগ্রহী।
অর্থ মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত বৈঠকে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়, রেলপথ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান এবং নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেনসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
ফাওজুল কবির খান টিবিএসকে জানান, বিশ্বব্যাংক ইতোমধ্যে ৬৫০ মিলিয়ন ডলার ঋণ অনুমোদন করেছে। সরকার ডিসেম্বরের মধ্যে ঋণ চুক্তি স্বাক্ষর করার পরিকল্পনা করলেও কিছু বিলম্ব হয়েছে। চুক্তি দ্রুত চূড়ান্ত করার জন্য প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে।
প্রকল্পের পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) কার্যক্রম গতিশীল করতে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, টার্মিনাল প্রকল্পের জন্য সড়ক ও রেলপথ মন্ত্রণালয়কে তাদের সংযোগ প্রকল্পগুলো দ্রুত বাস্তবায়নের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
ফাওজুল কবির জানান, জানুয়ারিতে একনেকের অনুমোদন পাওয়ার পর আগামী বছর প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু হবে।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে টিবিএসকে বলেন, 'সরকার সময়মতো বিশ্বব্যাংকের ঋণ গ্রহণ করতে দ্রুত প্রস্তাবগুলো তৈরি করছে। বিশ্বব্যাংকও চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য তাগাদা দিচ্ছে এবং প্রকল্পটি নিয়ে অত্যন্ত আগ্রহী। এমনকি চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ যে টার্মিনাল ৩ নির্মাণ করবে, তাতেও অর্থায়নের প্রস্তাব দিয়েছে।'
তিনি আরও বলেন, 'এ প্রকল্পে বিভিন্ন বিদেশি কোম্পানি আগ্রহ প্রকাশ করেছে।'
২০১৩ সালে আওয়ামী লীগ সরকার চট্টগ্রাম বন্দরের সম্প্রসারণের জন্য বে-টার্মিনাল নির্মাণের নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়। একই বছর জার্মান প্রতিষ্ঠান হ্যামবুর্গ পোর্ট কনসাল্টিং একটি প্রাক-সম্ভাব্যতা সমীক্ষা পরিচালনা করে।
২০১৭ সালে বিস্তারিত সম্ভাব্যতা সমীক্ষা এবং মাস্টারপ্ল্যান তৈরির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০২১ সালে কোরিয়ান কোম্পানি কুনহওয়া সম্ভাব্যতা সমীক্ষা এবং মাস্টারপ্ল্যান তৈরির কাজ সম্পন্ন করে। চূড়ান্ত সম্ভাব্যতা সমীক্ষা চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দেওয়া হয়েছে।
সম্ভাব্যতা সমীক্ষার ভিত্তিতে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ পুরো বে-টার্মিনাল প্রকল্পের ব্যয় প্রায় ২.৮ বিলিয়ন ডলার নির্ধারণ করেছে। এতে তিনটি টার্মিনাল, অ্যাক্সেস চ্যানেল এবং ব্রেকওয়াটার নির্মাণ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
এ ব্যয়ের মধ্যে টার্মিনাল ১ এবং টার্মিনাল ২-এর প্রতিটির জন্য ৬০৯.৪৪ মিলিয়ন ডলার এবং টার্মিনাল ৩ নির্মাণে ৭৫৫.১১ মিলিয়ন ডলার খরচ হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এছাড়া, ন্যাভিগেশনাল এক্সেস চ্যানেল এবং ব্রেকওয়াটার নির্মাণে ৮৩১ মিলিয়ন ডলার ব্যয় হবে।
টার্মিনাল ৩ চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ নিজস্ব অর্থায়নে নির্মাণ করবে। বাকি দুটি টার্মিনাল পিপিপি মডেলের আওতায় নির্মাণ করা হবে।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, পিএসএ সিঙ্গাপুর একটি টার্মিনাল নির্মাণে আগ্রহ দেখিয়েছে, তবে তাদের অংশগ্রহণের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এখনও নেওয়া হয়নি। গভীর সমুদ্রবন্দর, রেল ও অভ্যন্তরীণ সুবিধাসহ ২৬টি দেশে টার্মিনাল পরিচালনা করা পিএসএ বর্তমানে বিশ্বের বৃহত্তম পোর্ট অপারেটরগুলোর একটি।
এছাড়া, সরকার সংযুক্ত আরব আমিরাত-ভিত্তিক কোম্পানি ডিপি ওয়ার্ল্ডকে একটি নতুন টার্মিনাল নির্মাণের জন্য নিয়োগের নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ২০০৫ সালে দুবাই পোর্ট অথরিটি ও দুবাই পোর্ট ইন্টারন্যাশনালের একীভূতকরণের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত ডিপি ওয়ার্ল্ড বর্তমানে ৪০টি দেশে ৭৭টি সামুদ্রিক এবং অভ্যন্তরীণ টার্মিনাল পরিচালনা করছে।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, 'ডিপি ওয়ার্ল্ড এবং পিএসএ সিঙ্গাপুরের নিয়োগের সিদ্ধান্ত এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। আলোচনার জন্য লেনদেন উপদেষ্টা হিসেবে যুক্তরাজ্যভিত্তিক আর্নস্ট অ্যান্ড ইয়ং-এর সঙ্গে আরও আলোচনা করা হবে।'
বে টার্মিনাল প্রকল্পে দুটি প্রধান সহায়ক অবকাঠামো রয়েছে: একটি ৭ কিলোমিটার প্রবেশ পথ এবং ৬.৭১ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ।
সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ ইতোমধ্যে সড়ক নির্মাণের জন্য প্রকল্পের প্রস্তাবনা প্রস্তুত করে পরিকল্পনা কমিশনে জমা দিয়েছে। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক এ অংশের জন্য অর্থায়ন করবে। তবে, রেলপথ নির্মাণের প্রস্তাব এখনও চূড়ান্ত হয়নি।
বে টার্মিনাল প্রকল্প
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ২০১৩ সালে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) অর্থায়নে হামবুর্গ পোর্ট কনসালটিংকে দিয়ে একটি কৌশলগত মাস্টারপ্ল্যান তৈরি করেছিল। ওই প্ল্যানেই বে টার্মিনাল প্রকল্পের দ্রুত বাস্তবায়নের সুপারিশ করা হয়। ২০১৭ সালে একই কোম্পানি একটি প্রাথমিক সম্ভাব্যতা সমীক্ষাও সম্পন্ন করেছিল।
অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি ২০১৯ সালের ৪ আগস্ট প্রকল্পটি পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) হিসেবে অনুমোদন দিয়েছিল।
প্রাক্কলন অনুযায়ী, ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের কনটেইনার হ্যান্ডলিং ক্ষমতা ৬.৩ মিলিয়ন টিইইউ, ২০৩৫ সালের মধ্যে ৮.৬ মিলিয়ন টিইইউ এবং ২০৪০ সালের মধ্যে ১১.৫ মিলিয়ন টিইইউতে উন্নীত করতে হবে।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ২০২৭ সালের মধ্যে আনুমানিক ১২.৯ মিলিয়ন টন কার্গো পরিচালনা করবে, যা ২০৪০ সালের মধ্যে ১৭.০৮ মিলিয়ন টনে উন্নীত হবে।
বর্তমানে, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ একটি নদীভিত্তিক ফিডার পোর্ট হিসেবে কাজ করছে, যেখানে ১৯০ মিটার দৈর্ঘ্য, ৯.৫ মিটার ড্রাফট এবং ২৪০০ টিইইউ ক্ষমতা পর্যন্ত জাহাজ পরিচালনা করা হয়।
এ জাহাজগুলোকে প্রায়ই তিন দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। ফলে অতিরিক্ত ৪৫ হাজার ডলার খরচ হয়। তবে, বে টার্মিনালে ৩০০ মিটার দৈর্ঘ্যের, ১১.৫ মিটার ড্রাফট এবং ৪৮০০ টিইইউ ক্ষমতাসম্পন্ন জাহাজ জোয়ারের প্রভাবমুক্ত থেকে সপ্তাহের ৭ দিনই পরিচালনা করতে পারবে। এতে খরচ কমবে এবং কার্যদক্ষতা বৃদ্ধি পাবে।
পালটে যাবে দৃশ্যপট
বে টার্মিনাল ভবিষ্যতের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই), রপ্তানি-আমদানি কার্যক্রম এবং জাতীয় উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
প্রকল্পটির জন্য প্রয়োজনীয় মোট বিনিয়োগ প্রায় ৩ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে ২.৪ বিলিয়ন ডলার পিএসএ, ডিপি ওয়ার্ল্ড এবং এডি পোর্টস-এর মতো গ্লোবাল পোর্ট অপারেটরদের থেকে আসবে। বিশ্বব্যাংকসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক টার্মিনাল অপারেটররাও এ প্রকল্পে বিনিয়োগের আগ্রহ দেখিয়েছে, যা ভবিষ্যতে এফডিআইকে আরও উৎসাহিত করবে।
এই প্রকল্পে প্রায় ১৩,৫০০ কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে, যা দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক, অভ্যন্তরীণ নৌপথ এবং রেলপথের সঙ্গে সংযোগ থাকার ফলে বে টার্মিনাল লজিস্টিক কার্যক্রমের দক্ষতা বাড়াতে সহায়তা করবে।
২০৪০ সালের মধ্যে চট্টগ্রাম কন্টেইনার টার্মিনাল (সিসিটি) এবং নিউ মুরিং কন্টেইনার টার্মিনাল (এনসিটি)-এর কার্যক্ষমতা শেষ হয়ে গেলে বে টার্মিনাল চট্টগ্রামের ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণ করবে।
এটি হবে দেশের প্রথম সবুজ বন্দর, যেখানে ৩০ শতাংশ এলাকা বনায়নের জন্য বরাদ্দ থাকবে। এ পরিমাণ বনায়ন বন বিভাগের পরিকল্পিত ৫১ একরের চেয়েও বেশি।
সব মিলিয়ে, বে টার্মিনাল বাংলাদেশের জন্য একটি নতুন দিগন্তের উন্মোচন করতে যাচ্ছে। এটি রপ্তানি বাড়াবে এবং আধুনিক, সাশ্রয়ী টার্মিনাল সুবিধা দিয়ে কার্যক্রমের গতি ও দক্ষতা বৃদ্ধি করবে।